চারটি মোটরসাইকেলকে ধাওয়া করছে আরও চারটি মোটরসাইকেল। পেছন থেকে ছোড়া হচ্ছে গুলি। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। এটি কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়, রাউজানের বর্তমান নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খণ্ডচিত্র।
এক সময় ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাউজানে মানুষের আশা ছিল ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এলাকায় শান্তি আসবে, আওয়ামী লীগের এমপি এবিএম ফজলে করিমের ‘পতনের পর’ বন্ধ হবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুনের রাজনীতি। কিন্তু বিএনপির দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতির কারণে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা। গ্রুপিং, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঘটছে একের পর এক হত্যার ঘটনা। গত ২৮ আগস্ট থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত ৭ মাসে ৭ জন খুন হয়েছেন রাউজানে। এর মধ্যে পৌরসভায় দু’জন, নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দু’জন, চিকদাইর ইউনিয়নে একজন, হলদিয়া ইউনিয়নে একজন ও পূর্বগুজরা ইউনিয়নে একজন খুন হয়েছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের রাজনীতির বিভেদ রাউজানকে রক্তাক্ত করেছে। দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও হামলা-মামলার ঘটনা ঘটছে। আবার একই গ্রুপের নেতাদের মধ্যেও হচ্ছে সংঘাত। ৫ আগস্টের পর বিএনপির দুই গ্রুপে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীসহ অন্তত তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, ‘দলে অনুপ্রবেশকারীরাই অরাজকতা সৃষ্টি করছে। দলে আওয়ামী বাকশালীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এ অনুপ্রবেশকারীরা অস্থিরতা ও অরাজকতার জন্য দায়ী। আমার গ্রুপেও অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে।’
গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে স্বৈরাচার সরকার বাংলাদেশ শাসন করেছে। ওই সময় রাউজানের মানুষও অসহায় ছিল। সাধারণ মানুষ এলাকায় থাকতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর আমাদের নেতাকর্মীরাও রাউজানে আসে। আমার একটি বক্তব্য ছিল, রাউজানে ১৭ বছর ধরে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলেছে এখন আর সেভাবে চলবে না। কোনো চাঁদাবাজি হবে না, দখলদারিত্বের রাজনীতি করা যাবে না। সুতরাং কোনো চাঁদাবাজি হবে না, কোনো চাঁদাবাজকে দল আশ্রয় দেবে না, কোনো সন্ত্রাসীকে আমরা দলীয়ভাবে প্রশ্রয় দেব না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে চারটি মোটরসাইকেলকে অন্য চারটি মোটরসাইকেলের ধাওয়ার ঘটনা নিজের চোখে দেখলাম। এ ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটছে। দিনদুপুরে গুলির শব্দ শুনে এখন আর আমরা আশ্চর্য হই না। রাউজান এখন অশান্ত জনপদ।’
৫ আগস্ট পরবর্তী কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও মারামারি ঘটনা ঘটলেও হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ২৮ আগস্ট। ওইদিন বিকেলে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিকলীগ নেতা আব্দুল মান্নানকে (২৭)। তিনি বেতবুনিয়া সুগারমিল ডাকবাংলো এলাকার কবির আহাম্মদের ছেলে। এরপর ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো.
অন্যদিকে, ১১ নভেম্বর নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (৪৮) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১১ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় উপজেলার চিকদাইর ইউনিয়নের কালাচাঁন চৌধুরী সেতুর পাশে সর্তাখাল থেকে তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি রাউজান উপজেলার চিকদাইর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আকবর শাহ (রহ.) বাড়ির প্রয়াত আবদুল মান্নানের ছেলে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় তাহেরের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেল যোগে জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাওয়ার পথে দিনদুপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫০) নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। চাঁদা না দেওয়ায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নিহত জাহাঙ্গীর আলম উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরামিশপাড়ার আবু ছৈয়দ মেম্বারের বড় ছেলে। জাহাঙ্গীর চট্টগ্রাম নগরীর খাতুনগঞ্জের পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ী।
১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরীহাট বাজারের কাছে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত হাসান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আহমেদ হোসেন মেম্বার বাড়ির মো. বজল আহমেদ ড্রাইভারের ছেলে।
গত ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ছুরিকাঘাতে কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদলকর্মী নিহত হন। ওই দিন রাতে উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নে আমির চৌধুরী হাটে তাকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নিহত কমর উদ্দিন জিতু হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের মুহাম্মদ আলীর ছেলে।
সর্বশেষ ২১ মার্চ উপজেলার পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে মো. রুবেল (৩৫) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গরু চোর সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত রুবেল চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার প্রয়াত নুরুল আলমের ছেলে।
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূইঁয়া বলেন, ‘এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দিনরাতে কাজ করছে। রাউজানকে শান্ত রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যারা অপরাধ তৎপরতা চালাচ্ছে বা অপরাধ কর্মকাণ্ড করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপজ ল র ন য় প ড় ৫ আগস ট র ব এনপ র এল ক য় র জন ত র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
সড়কে রক্তের দাগ
ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সংক্রান্ত সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক খবরগুলো বড় বেদনার। স্বাভাবিক সময়েই অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। শহীদ রওশনের মায়ের চোখের পানি এখনও শুকায়নি। ২০১৮ সালের সেই জুলাইয়ের সকালে তিনি তাঁর ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন স্বপ্ন নিয়ে। ফিরে পেয়েছিলেন রক্তাক্ত দেহ। একটি বেপরোয়া বাসের চাকায় শুধু একটি প্রাণই নয়, একটি পরিবারের সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে গড়ে ২২ জন প্রাণ হারান। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে একটি পরিবারের অশ্রু আর অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গত দশকে আমরা হারিয়েছি ৭৫ হাজার প্রাণ, যা একটি ছোট শহরের জনসংখ্যার সমান।
আমাদের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর মিছিল চলার উন্মুক্ত প্রান্তর। প্রতি ১০০টি গাড়ির মধ্যে ৩৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ। ৪০ শতাংশ চালক বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালায়। এর পেছনে রয়েছে জটিল নেটওয়ার্ক– দুর্নীতি, অদক্ষতা। সর্বোপরি আমাদের সামাজিক অবক্ষয়।
২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। কিন্তু ছয় বছর পর আমরা কতটুকু এগিয়েছি? ডিজিটাল লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু হয়েছে, কিন্তু অনেক আবেদনকারী এখনও
দালালের কারণে হয়রানির শিকার। আইন হয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল।
আমাদের সমস্যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়। এটি মূলত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের ছাপ। আমরা যেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছি, সেখানে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ পিছিয়ে পড়ছে।
সরকারের নতুন উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন সামাজিক বিবেককে জাগ্রত করা। প্রত্যেক চালক যেন বুঝতে পারে, তার হাতে শুধু স্টিয়ারিং নয়, অসংখ্য প্রাণের দায়িত্বও রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে গাড়ি পরিদর্শন– সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু সড়ক নয়, আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত যানবাহন ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
২০১৮ সালের সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল– পরিবর্তন সম্ভব। আজ আমাদের প্রয়োজন সেই চেতনাকে আবার জাগিয়ে তোলা। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য, প্রতিটি দুর্ঘটনা অপ্রয়োজনীয়। রওশনের মায়ের মতো চোখের জল যেন আর কোনো মাকে ফেলতে না হয়। সড়কগুলো যেন আর না হয় কবরস্থান। এটি শুধু একটি স্বপ্ন নয়, অধিকার। আসুন,সবাই মিলে গড়ে তুলি এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা হবে অতীতে ঘটে যাওয়া করুণ ইতিহাস, যা বর্তমানে নেই।
মো. রাইসুল ইসলাম: স্বেচ্ছাসেবক, চট্টগ্রাম