মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি নির্মাণ প্রকল্প বাতিল
Published: 19th, April 2025 GMT
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সারা দেশে সমাধি নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, সমাধি নির্মাণের জন্য জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও সমাধি চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এসব কারণে ২০ হাজারের মধ্যে ১৫ হাজার ৬০৪টি সমাধি আর নির্মাণ করা হবে না। তবে ‘যুদ্ধসমাধি’ ধরনের কিছু করার কথা ভাবা হচ্ছে।
সারা দেশে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মোট ২০ হাজার সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০১৮ সালে। ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয় ৪৬১ কোটি টাকা। পরে ব্যয় কমিয়ে করা হয় ৩৯৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৫ হাজার সমাধি করার সিদ্ধান্ত হয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকা ধরে। আর ১৫ হাজার সমাধি করার কথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) দেওয়া তালিকা অনুযায়ী।
আমি দুটি সমাধি পরিদর্শনে গিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, সমাধি দুটি ছোট ছোট। সমাধির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন সমাধির পরিবর্তে ওয়ার সিমেট্রির (যুদ্ধসমাধি) মতো করা হবে। ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টাসরকারের উন্নয়ন প্রকল্প নজরদারি করা সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর থেকে এ পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকা দেওয়া ৫ হাজার সমাধির মধ্যে ৪ হাজার ১২৬টির কাজ শেষ হয়েছে। ২৭০টির কাজ চলমান। ইউএনওদের মাধ্যমে কোনো সমাধি নির্মিত হয়নি। আইএমইডির তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৮০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
মূলত জমির জটিলতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি করা যাচ্ছে না বলে জানান প্রকল্প পরিচালক পলি কর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে ভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
সমাধির নকশা নিয়ে জটিলতার কারণেও প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।চার সমস্যা চিহ্নিত
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হন। মূলত সেসব স্থানে সমাধি নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। সমাধি নির্মাণ করতে গিয়ে মোটা দাগে চারটি সমস্যার কথা বলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এক.
সমাধি নির্মাণের জন্য উপজেলাগুলোতে ইউএনওকে সভাপতি করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির বাকি দুজন সদস্য ইউএনও মনোনীত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। তবে বিভিন্ন উপজেলা থেকে জানানো হয়, বেশির ভাগ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেখানে সমাধি করা কঠিন। নির্ধারিত জায়গার বাইরে সমাধি করতে গেলে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অনেকেই জমি দিতে আগ্রহী নন। আবার কোথাও কোথাও সরকার অনুমোদিত জায়গার মধ্যে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি নেই।
এ বিষয়ে গত ২৯ মার্চ রংপুর, জামালপুর ও নোয়াখালীর তিন উপজেলার ইউএনওদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাঁরা নতুন কর্মস্থলে এসেছেন। তাঁরা বলেন, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমাধির কোনো তথ্য জানা নেই। সমাধির তালিকা সম্পর্কেও কিছু জানেন না তাঁরা।
উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ২৩ মার্চ তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, সমাধি নির্মাণের জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন তাঁরা।নকশা নিয়েও জটিলতা
সমাধির নকশা নিয়ে জটিলতার কারণেও প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য মূল নকশায় সমাধির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি, প্রস্থ ৫ ফুট এবং উচ্চতা ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি নির্ধারণ করা হয়। আর হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য দৈর্ঘ্য ৫ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি, উচ্চতা ৩ ফুট নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ নকশা ধরে কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। পরে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি নির্মাণ প্রকল্পটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, ততটা দেওয়া হয়নি। দায়সারাভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদল হয়েছে অন্তত পাঁচবার। চাহিদা অনুযায়ী বাজেটও দেওয়া হতো না। সব দিক বিবেচনা করে প্রকল্পটি সমাপ্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের কাজ শূন্য
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা আইএমইডির পরিচালক (উপসচিব) নিশাত জাহান গত ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার তিনটি সমাধি পরিদর্শনে যান। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী চৌধুরীর সমাধি পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন তিনি। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে কোনো সমাধি নির্মাণ করা হয়নি। বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২৭০টি সমাধির নির্মাণকাজ চলছে। ৪ হাজার ১২৬টির কাজ শেষ হয়েছে। গত বছরের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে বাকি কাজ শেষ করতে আরও এক বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
‘যুদ্ধসমাধি করা হবে’
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ২৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প পর্যালোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম প্রকল্পটি স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। পরে অক্টোবর মাসে এডিপি সভায় প্রকল্পের আওতায় নতুন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করার নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। শুধু গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে নির্মাণাধীন সমাধিগুলোর বাকি কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ২৩ মার্চ তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, সমাধি নির্মাণের জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘আমি দুটি সমাধি পরিদর্শনে গিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, সমাধি দুটি ছোট ছোট। সমাধির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন সমাধির পরিবর্তে ওয়ার সিমেট্রির (যুদ্ধসমাধি) মতো করা হবে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স দ ধ ন ত হয় ন র ম ণ র জন য ফ র ক ই আজম কর মকর ত র জন য জ দ র জন য সরক র র উপদ ষ ট উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কুয়েটে ভিসির প্রতীকী চেয়ারে আগুন দিলেন শিক্ষার্থীরা
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসির প্রতীকী চেয়ারে অগ্নিসংযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে ক্যাম্পাসের দুর্বার বাংলার পাদদেশে প্রতীকী চেয়ারে আগুন ধরিয়ে দেন তারা।
শিক্ষার্থীরা এসময় বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। প্রতীকী চেয়ারের পেছনের দিকে শিক্ষার্থীরা ‘ইন্টেরিম কী অন্ধ?’ লেখা ব্যানার ধরে ছিলেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীরা শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে জড়ো হতে থাকেন। তারা ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন প্রদক্ষিণ করে দুর্বার বাংলা পাদদেশের গিয়ে শেষ হয়। সেখানে ভিসির প্রতীকী চেয়ারে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
আরো পড়ুন:
সিকৃবিতে ‘ম্যানার’ শেখানোর নামে গভীর রাতে ডেকে নিয়ে র্যাগ
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সারা দেশে ‘কাফন মিছিল’
শিক্ষার্থীরা অচিরেই বর্তমান ভিসির পদত্যাগ দাবি করেন। নতুন ভিসি নিয়োগের মাধ্যমে ঘটে যাওয়ার ঘটনার সঠিক তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা। দাবি মানা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েট ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কুয়েট ভিসি, প্রো ভিসি, ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ ও ছাত্র রাজনীতি বন্ধসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসের একাডেমিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় কুয়েট কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা জোর করে ক্যাম্পাসের প্রবেশে করে হল খোলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। গত ১৫ এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ ছাত্রকে বহিষ্কার এবং আগামী ২ মে হল খুলে দেওয়া ও ৪ মে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত দেয় সিন্ডিকেট সভা।
এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গত ১৬ এপ্রিল ছয়টি আবাসিক হলের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন কুয়েটের শিক্ষার্থীরা। একই দিন দুপুরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। শিক্ষার্থীদের মিছিলের পরপরই উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিপক্ষে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক দফার পক্ষে ক্যাম্পাসে মশালমিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) একই দাবিতে গ্রাফিতি এঁকেছেন তারা।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/মাসুদ