ষড়ঋতুর এই দেশে ‘গ্রীষ্ম’ শব্দটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত প্রচণ্ড তাপদাহ, খরা কিংবা কালবৈশাখী। এর বাইরেও রয়েছে এই ঋতুটির এক ভিন্ন রূপ। তা হলো গ্রীষ্মে ফোটা অগণিত অসাধারণ সব ফুল। চোখজুড়ানো সুন্দর সে রূপে আমরা মুগ্ধ হই। বাংলাদেশে ছয় হাজারের বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুলের উদ্ভিদ। গ্রীষ্মের ফুল অন্যতম। গরমের এই সময়ের কিছু ফুলের নান্দনিকতা যেন তাপদাহ কমিয়ে দেয়। জারুল, কৃষ্ণচূড়া, স্বর্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জিনিয়া– এমন ফুলগুলো যে কারও চোখ ও মনের জন্য বয়ে আনে দুর্দান্ত এক প্রশান্তি।
কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের আইকনিক ফুল। এ সময়ে গাছটি মূলত আগুনরাঙা ফুলে ঢেকে যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রমনার ফুটপাত, বিজয় সরণি পার হয়ে গণভবনের দিকে যেতে রাস্তার দুই পাশ ধরে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময়ে যে কোনো ক্লান্ত পথিক একবার অন্তত থমকে দাঁড়াবে– এমনই তার রূপ। ফুলগুলো গুচ্ছ আকারে চোখে পড়ে। কৃষ্ণচূড়া গাছ ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চারটি পাপড়ির সমষ্টি দিয়ে গঠিত এ ফুল বাতাসের দোলায় ঝরে পড়ে। কখনও মনে হবে যেন গাছের নিচে আগুন জ্বলছে।
রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর সংসদ ভবন এলাকা ছাড়াও নানা প্রান্তে বিস্তৃত হয়েছে কনকচূড়া। অনেকেই ফুলটিকে চেনেন রাধাচূড়া নামে। আদতে রাধাচূড়া গুল্ম শ্রেণির দুর্বল কাণ্ডের উদ্ভিদ। তা ছাড়া রাধাচূড়া ফুলের রকমফেরও রয়েছে। কনকচূড়া ফুলের একটিই রং। হলদে রঙের এই ফুল ফোটে নির্দিষ্ট সময়ে, গ্রীষ্মকালে। বেশিদিন থাকে না। কনকচূড়া আমাদের দেশি বৃক্ষ নয়। ভিনদেশি এ ফুলের নাম দিয়েছেন বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। অনেকের কাছে এ গাছ হলুদ কৃষ্ণচূড়া নামেও পরিচিত। তবে কৃষ্ণচূড়া আর কনকচূড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার একটি হলুদ প্রজাতিও রয়েছে। কারণ, গাছের শীর্ষে ফোটা ফুলগুলো উজ্জ্বল সোনালি রঙের। ইদানীং ঢাকার বিভিন্ন পার্ক ও পথের ধারে বেশকিছু কনকচূড়া চোখে পড়ে।
রাধাচূড়া ফুলের গাছ আকারে ছোট হয়, আর রং হয় হলুদ, লাল। অনেক সময় একই গাছে লাল-হলুদ দুই রঙের ফুলই দেখা যায়। অন্যদিকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ অনেক বড় আকারের হয়। ফুলের রংটাও হয় টকটকে লাল, আর একসঙ্গে সমস্ত গাছে অনেক ফুল আসে। আকারে ছোট হওয়ায় রাধাচূড়া গাছে ফুল আসে অনেক কম।
রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তন প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে এ সময়ে রোদে জ্বলজ্বল করে গুচ্ছ গুচ্ছ সোনালু ফুল। যেন কাঁচা হলুদ রঙের উৎসব চলছে। ফুলভর্তি সোনালু গাছ দেখলে মনে হয়, হলুদ রঙের কৌটা উপুড় করে দিয়েছে কেউ।
গ্রীষ্মের আরেকটি অসাধারণ ফুলের নাম জারুল। বাংলাদেশের গ্রামেই বেশি জারুল গাছ দেখা যায়। মাঝারি সাইজের শাখা-প্রশাখাযুক্ত গাছ। ফুলের রং বেগুনি। গাছজুড়ে থোকায় থোকায় ফোটে থাকে। একেকটি জারুল গাছ ২০ থেকে ৩০ মিটার উঁচু হয়। ফুল হয় ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার লম্বা। প্রতিটি ফুলের ছয়টি করে পাপড়ি থাকে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো গাঁয়ের বধূ বেগুনি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে।
শীত আর গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই দেখা মেলে জিনিয়ার। বর্তমানে গরমকালের ফুল হিসেবে বেশি পরিচিত। উর্বর মাটি আর পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকলে ছাদবাগান, বারান্দা বা উদ্যানে এ গাছ ফুলে ভরে ওঠে। অনায়াসে সে তার স্নিগ্ধতায় মোহিত করতে সক্ষম।
গ্রীষ্মের মনোমুগ্ধকর এক ফুল হিমচাঁপা। সবুজ লম্বাটে গড়নের বৃক্ষ জাতীয় ফুল গাছ এটি। গাছ ৬ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বসন্তের শেষদিকে গাছে ফুলের কলি আসে। গ্রীষ্মের শুরু থেকে গাছের শাখায় শাখায় ফুলের দেখা মেলে। এর সুবাস বেশ মিষ্টি। ছয় থেকে বারোটি পাপড়ি থাকে হিমচাঁপা ফুলে।
সূর্যমুখী গ্রীষ্মকালীন উদ্ভিদ। উজ্জ্বল হলুদ পাপড়ি এবং সূর্যের মতো চেহারার জন্যই এ নাম; যা সূর্যের উষ্ণতা এবং জীবনীশক্তির প্রতীক। গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় সূর্যমুখীর ফলন ভালো হয়। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।
গ্রীষ্মের আরেকটি জনপ্রিয় ফুল জবা। অনেক বাড়িতে এই ফুলের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। সাজসজ্জা ছাড়াও ভেষজ চা এবং চুলের তেলে এর ব্যবহার রয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এ ফুলের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই মহুয়ার দেখা পাওয়া যায়। শীতে সব পাতা ঝরে যায়। স্থানভেদে একে মহুলা, মধুকা, মোহা, মোভা, মহুভা, মাদকম ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মহুয়া ২০ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এর গুঁড়ি তুলনামূলকভাবে ছোট এবং শীর্ষদেশ গোলাকার ও বিস্তৃত। এই বৃক্ষের শিকড়গুলো ছড়ানো এবং তার বেশি অংশ মাটির উপরিভাগে থাকে। এর ফুলগুলো মাংসল, হালকা ধূসর রঙের এবং গাছে যখন সম্পূর্ণ ফুল ফোটে, তখন ফুল থেকে আকর্ষণীয় মিষ্টি সুগন্ধ বের হয়। মহুয়া গাছ বাড়ে খুব ধীরে। এটি ১০ বছর বয়স থেকে ফুল দিতে শুরু করে।
এ ছাড়াও ভাঁটফুল, মধুমঞ্জুরি, কাঠগোলাপ, কুরচি, করবী, কনকচাঁপা, নাগেশ্বর, আকরকাঁটা, মাধবী, নীলমণি, মণিমালা, রক্ত কাঞ্চন, সাদা কাঞ্চন, দেবদারু, স্বর্ণশিমুল, অশোক, পারিজাত, শিমুল, পলাশসহ নানা ফুলের রং-বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আমাদের গ্রীষ্মকাল।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কনকচ ড়
এছাড়াও পড়ুন:
এই সময়ের ফুল
ষড়ঋতুর এই দেশে ‘গ্রীষ্ম’ শব্দটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত প্রচণ্ড তাপদাহ, খরা কিংবা কালবৈশাখী। এর বাইরেও রয়েছে এই ঋতুটির এক ভিন্ন রূপ। তা হলো গ্রীষ্মে ফোটা অগণিত অসাধারণ সব ফুল। চোখজুড়ানো সুন্দর সে রূপে আমরা মুগ্ধ হই। বাংলাদেশে ছয় হাজারের বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুলের উদ্ভিদ। গ্রীষ্মের ফুল অন্যতম। গরমের এই সময়ের কিছু ফুলের নান্দনিকতা যেন তাপদাহ কমিয়ে দেয়। জারুল, কৃষ্ণচূড়া, স্বর্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জিনিয়া– এমন ফুলগুলো যে কারও চোখ ও মনের জন্য বয়ে আনে দুর্দান্ত এক প্রশান্তি।
কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের আইকনিক ফুল। এ সময়ে গাছটি মূলত আগুনরাঙা ফুলে ঢেকে যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রমনার ফুটপাত, বিজয় সরণি পার হয়ে গণভবনের দিকে যেতে রাস্তার দুই পাশ ধরে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময়ে যে কোনো ক্লান্ত পথিক একবার অন্তত থমকে দাঁড়াবে– এমনই তার রূপ। ফুলগুলো গুচ্ছ আকারে চোখে পড়ে। কৃষ্ণচূড়া গাছ ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চারটি পাপড়ির সমষ্টি দিয়ে গঠিত এ ফুল বাতাসের দোলায় ঝরে পড়ে। কখনও মনে হবে যেন গাছের নিচে আগুন জ্বলছে।
রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর সংসদ ভবন এলাকা ছাড়াও নানা প্রান্তে বিস্তৃত হয়েছে কনকচূড়া। অনেকেই ফুলটিকে চেনেন রাধাচূড়া নামে। আদতে রাধাচূড়া গুল্ম শ্রেণির দুর্বল কাণ্ডের উদ্ভিদ। তা ছাড়া রাধাচূড়া ফুলের রকমফেরও রয়েছে। কনকচূড়া ফুলের একটিই রং। হলদে রঙের এই ফুল ফোটে নির্দিষ্ট সময়ে, গ্রীষ্মকালে। বেশিদিন থাকে না। কনকচূড়া আমাদের দেশি বৃক্ষ নয়। ভিনদেশি এ ফুলের নাম দিয়েছেন বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। অনেকের কাছে এ গাছ হলুদ কৃষ্ণচূড়া নামেও পরিচিত। তবে কৃষ্ণচূড়া আর কনকচূড়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার একটি হলুদ প্রজাতিও রয়েছে। কারণ, গাছের শীর্ষে ফোটা ফুলগুলো উজ্জ্বল সোনালি রঙের। ইদানীং ঢাকার বিভিন্ন পার্ক ও পথের ধারে বেশকিছু কনকচূড়া চোখে পড়ে।
রাধাচূড়া ফুলের গাছ আকারে ছোট হয়, আর রং হয় হলুদ, লাল। অনেক সময় একই গাছে লাল-হলুদ দুই রঙের ফুলই দেখা যায়। অন্যদিকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ অনেক বড় আকারের হয়। ফুলের রংটাও হয় টকটকে লাল, আর একসঙ্গে সমস্ত গাছে অনেক ফুল আসে। আকারে ছোট হওয়ায় রাধাচূড়া গাছে ফুল আসে অনেক কম।
রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তন প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে এ সময়ে রোদে জ্বলজ্বল করে গুচ্ছ গুচ্ছ সোনালু ফুল। যেন কাঁচা হলুদ রঙের উৎসব চলছে। ফুলভর্তি সোনালু গাছ দেখলে মনে হয়, হলুদ রঙের কৌটা উপুড় করে দিয়েছে কেউ।
গ্রীষ্মের আরেকটি অসাধারণ ফুলের নাম জারুল। বাংলাদেশের গ্রামেই বেশি জারুল গাছ দেখা যায়। মাঝারি সাইজের শাখা-প্রশাখাযুক্ত গাছ। ফুলের রং বেগুনি। গাছজুড়ে থোকায় থোকায় ফোটে থাকে। একেকটি জারুল গাছ ২০ থেকে ৩০ মিটার উঁচু হয়। ফুল হয় ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার লম্বা। প্রতিটি ফুলের ছয়টি করে পাপড়ি থাকে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো গাঁয়ের বধূ বেগুনি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে।
শীত আর গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই দেখা মেলে জিনিয়ার। বর্তমানে গরমকালের ফুল হিসেবে বেশি পরিচিত। উর্বর মাটি আর পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকলে ছাদবাগান, বারান্দা বা উদ্যানে এ গাছ ফুলে ভরে ওঠে। অনায়াসে সে তার স্নিগ্ধতায় মোহিত করতে সক্ষম।
গ্রীষ্মের মনোমুগ্ধকর এক ফুল হিমচাঁপা। সবুজ লম্বাটে গড়নের বৃক্ষ জাতীয় ফুল গাছ এটি। গাছ ৬ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বসন্তের শেষদিকে গাছে ফুলের কলি আসে। গ্রীষ্মের শুরু থেকে গাছের শাখায় শাখায় ফুলের দেখা মেলে। এর সুবাস বেশ মিষ্টি। ছয় থেকে বারোটি পাপড়ি থাকে হিমচাঁপা ফুলে।
সূর্যমুখী গ্রীষ্মকালীন উদ্ভিদ। উজ্জ্বল হলুদ পাপড়ি এবং সূর্যের মতো চেহারার জন্যই এ নাম; যা সূর্যের উষ্ণতা এবং জীবনীশক্তির প্রতীক। গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় সূর্যমুখীর ফলন ভালো হয়। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।
গ্রীষ্মের আরেকটি জনপ্রিয় ফুল জবা। অনেক বাড়িতে এই ফুলের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। সাজসজ্জা ছাড়াও ভেষজ চা এবং চুলের তেলে এর ব্যবহার রয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এ ফুলের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই মহুয়ার দেখা পাওয়া যায়। শীতে সব পাতা ঝরে যায়। স্থানভেদে একে মহুলা, মধুকা, মোহা, মোভা, মহুভা, মাদকম ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মহুয়া ২০ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এর গুঁড়ি তুলনামূলকভাবে ছোট এবং শীর্ষদেশ গোলাকার ও বিস্তৃত। এই বৃক্ষের শিকড়গুলো ছড়ানো এবং তার বেশি অংশ মাটির উপরিভাগে থাকে। এর ফুলগুলো মাংসল, হালকা ধূসর রঙের এবং গাছে যখন সম্পূর্ণ ফুল ফোটে, তখন ফুল থেকে আকর্ষণীয় মিষ্টি সুগন্ধ বের হয়। মহুয়া গাছ বাড়ে খুব ধীরে। এটি ১০ বছর বয়স থেকে ফুল দিতে শুরু করে।
এ ছাড়াও ভাঁটফুল, মধুমঞ্জুরি, কাঠগোলাপ, কুরচি, করবী, কনকচাঁপা, নাগেশ্বর, আকরকাঁটা, মাধবী, নীলমণি, মণিমালা, রক্ত কাঞ্চন, সাদা কাঞ্চন, দেবদারু, স্বর্ণশিমুল, অশোক, পারিজাত, শিমুল, পলাশসহ নানা ফুলের রং-বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আমাদের গ্রীষ্মকাল।