আজকের সমাজে আমরা নানা ধরনের অন্যায়, অবক্ষয় ও অমানবিকতার মুখোমুখি হচ্ছি। খবরে প্রায়ই উঠে আসে হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, প্রতারণা, পারিবারিক সহিংসতা কিংবা সামাজিক বৈষম্যের চিত্র। এসব দেখে আমরা আতঙ্কিত ও বিরক্ত হই। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদও করি। আমরা প্রায়ই বলি, সমাজে অন্যায় বেড়ে গেছে; মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে; নৈতিকতা যেন শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় বন্দি। আমার বিশ্বাস, সমাজে প্রচলিত অন্যায় ও অবক্ষয়ের মূল কারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার অভাব বা অপবিকাশ। মানুষ যেমন চিন্তা করে, তেমনি তার আচরণ গড়ে ওঠে। কম্পিউটারের ভাষায় একটি কথা আছে– গার্বেস ইন গার্বেস আউট। যা ইনপুট করব তাই আউটপুট হবে। চিন্তার ক্ষেত্রেও এমন, যা জানব তা-ই দেব। চিন্তার এই ভিত্তি তৈরি হয় শেখার মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু একাডেমিক সাফল্য গুরুত্ব পাচ্ছে। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিকতা, মানবিকতা ও বিশ্লেষণী শক্তির চর্চা হচ্ছে না বললেই চলে।
আজকের প্রজন্ম বড় হচ্ছে পরীক্ষার ফলের পেছনে ছুটতে ছুটতে। তারা ভালো চাকরি, ভালো জীবন চাইছে। কিন্তু কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়, সে শিক্ষা পাচ্ছে কি? একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও যে এক বিশাল জগৎ আছে, যেখানে মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে, তা তারা জানতেই পারছে না। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কেউ কিছু পড়তে চায় না; নতুন চিন্তা করতে চায় না। প্রশ্ন করতে ভয় পায়।
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার চিন্তার বিপ্লব। আমাদের এমন একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শুধু পাঠ্যবই নয়; শেখানো হবে কীভাবে ভাবতে হয়; নিজেকে প্রশ্ন ও আত্মসমালোচনার চর্চা করতে হয়। সেখানে আলোচনার মাধ্যমে চিন্তার বিকাশ ঘটবে; শেখানো হবে কীভাবে মানবিক হতে হয়; কীভাবে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই প্ল্যাটফর্ম হতে পারে কোনো সামাজিক উদ্যোগ; স্কুল-কলেজের বাইরে বিশেষ কর্মশালা বা অনলাইন চিন্তা উন্নয়ন কোর্স। এর মূল উদ্দেশ্য হবে নৈতিকতা ও মানবিকতার চর্চা, মুক্তচিন্তার অনুশীলন এবং মননশীল সমাজ গড়ে তোলার পথ তৈরি করা।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তার বিপ্লব ঘটানোর জন্য স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ক্লাব গঠন; গল্প ও নাটকের মাধ্যমে নৈতিক চিন্তার বার্তা দেওয়া; রোল মডেলদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং নিজস্ব ‘ভাবনার ডায়েরি’ লেখার অভ্যাস গড়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া রচনা, বক্তৃতা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয়ে মনোযোগী করা যায়। শিক্ষকদের ক্লাসে নিয়মিত নৈতিক চিন্তার প্রশ্ন আলোচনা এবং অভিভাবকদের সঙ্গে সচেতনতা সভার আয়োজন করাও কার্যকর। ভালো চিন্তার স্বীকৃতিস্বরূপ শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করলে তারা চিন্তা করতে আরও আগ্রহী হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একমাত্র ভালো চিন্তাই পারে অসাধারণ মানুষ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে। একটি দেশের উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো কিংবা প্রযুক্তির বিকাশে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটে যখন মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে; অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং নিজের আচরণ দিয়ে সমাজকে পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে শেখে।
এখন সময় এসেছে চিন্তার জায়গায় পরিবর্তন আনার। আমাদের সন্তানদের শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যাংকার নয়; ভালো মানুষ হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। চিন্তার এই বিপ্লব ঘটাতে পারলে আমাদের সমাজে অন্যায়-অবিচার অনেকটা কমে যাবে। দেশ এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
মো.
saidurpstu53@gmail.com
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বন্ধু কি আপনাকে ঈর্ষা করেন? যেভাবে বুঝবেন
বন্ধুর জন্য নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের বহু উদাহরণ আছে। তবে সব বন্ধুত্ব একই রকম নয়। বন্ধু নামের আড়ালে অনেক রকম মানুষই থাকেন। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ আপনাকে ঈর্ষাও করতে পারেন। তবে বন্ধুত্বে ঈর্ষা থাকলে সেটি সব সময় একইভাবে প্রকাশিত না-ও হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, ঈর্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ঈর্ষার ব্যাপারটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে ‘বন্ধু’ আপনার ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারেন। বন্ধু হিসেবে কারও ক্ষতি করা বেশ সহজ। কারণ, বন্ধুত্বে থাকে দৃঢ়বিশ্বাস। তাই বন্ধুত্বে ঈর্ষা থাকলে আগেভাগে সাবধান হওয়া ভালো। কিছু ক্ষেত্রে এর সমাধানও করা যেতে পারে। সাধারণ কিছু বিষয় লক্ষ করলে আপনি অনুভব করতে পারবেন, আপনার প্রিয় বন্ধু হয়তো আপনাকে ঈর্ষা করছেন। যদিও বন্ধুত্বের মায়ায় আমরা অনেক সময় বন্ধুর ঈর্ষাকে ঠিক ঈর্ষা বলে মানতে চাই না। এমনটাই বলছিলেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক।
আরও পড়ুনছদ্মবেশী বন্ধু চিনবেন কীভাবে২২ মে ২০২৪আচরণে ঈর্ষার ছাপঈর্ষার প্রশ্ন তখনই আসে, যখন আপনি সফলতা পান কিংবা সুখে থাকেন। আপনার ক্যারিয়ার বা ব্যক্তিগত জীবনের নানান দিক নিয়েই কারও ঈর্ষা হতে পারে। যে বিষয়টি নিয়ে আপনি ভালো আছেন, আপনার বন্ধু যদি সেই বিষয়টিকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন তিনি হয়তো আপনাকে ঈর্ষা করছেন। তাঁর কথার ধরন এবং আচরণ থেকেই আপনি বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবেন। আপনি যখন পরিশ্রমের ফল হিসেবে পদোন্নতি পান, আপনার বন্ধু তখন এই সফলতাকে ‘ভাগ্য’ বলে আখ্যা দিতে পারেন কিংবা ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার সুফল হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। আবার সাফল্যের উদ্যাপনে আপনি একজন ঈর্ষান্বিত বন্ধুকে না-ও পেতে পারেন। কিংবা আপনি যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কে সুখী, তখন হয়তো অতীতের কোনো তিক্ততার কথা তিনি মনে করিয়ে দিলেন। আবার আপনি যখন ভালো আছেন, তখন তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়েও দিতে পারেন। বুঝতেই পারছেন, নির্দিষ্ট একধরনের আচরণেই ঈর্ষা প্রকাশিত হয় না। বরং তাঁর আচরণ, কথা, কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়েই আপনি পাবেন ঈর্ষার ছাপ।
আরও পড়ুনআপনার বন্ধু মোটে এক বা দুজন? জেনে নিন আপনি মানুষ হিসেবে কেমন২১ নভেম্বর ২০২৪সমাধান যেভাবেবন্ধু আপনাকে ঈর্ষা করছেন বলে মনে হলেই যে আপনি বন্ধুত্বের ইতি টানবেন, তা কিন্তু নয়। খোলামেলাভাবে তাঁর সঙ্গে আলাপ করুন। তবে সরাসরি ঈর্ষার প্রসঙ্গ তুলবেন না। ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণেও তিনি নেতিবাচক আচরণ করে থাকতে পারেন, যেটিকে হয়তো আপনি ঈর্ষা ভেবে ভুল করছেন। তাই তাঁর আচরণের অসংগতিগুলো নিয়ে কথা বলুন। এর কারণ জানতে চান। আপনার সাফল্যের যে তিনিও একজন অংশীদার, সেটি তাঁকে বুঝিয়ে দিন। তিনি কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায় থাকলে তা সমাধানে সাহায্য করুন অবশ্যই।
সাবধানের মার নেইসব চেষ্টার পরও যদি বন্ধুর আচরণের সেই খারাপ দিকগুলোর কিছুটা রয়েই যায়, তাহলে একটি সীমারেখার ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ভালো। এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর এই বন্ধুটির সঙ্গে ভাগ করে নেবেন না, যেটির কারণে আপনার কিংবা আপনার পরিবারের ক্ষতি হতে পারে। এটা ঠিক যে বন্ধুত্ব নষ্ট হলে আপনার কষ্ট হবে। তবে জীবনে নিরাপদ থাকাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালো থাকার জন্য তাই নিজের পরিবার এবং ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিন। নতুন বন্ধুত্বও গড়ে তুলতে পারেন, তবে অবশ্যই বুঝেশুনে।
আরও পড়ুনআপনার জীবনে কি এই সাত ধরনের বন্ধু আছে?১৪ ডিসেম্বর ২০২৪