বাণিজ্যযুদ্ধে ট্রাম্প নাকি চিন পিং—কে আগে হার মানবেন
Published: 18th, April 2025 GMT
বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মুখোমুখি অবস্থানে। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে এর প্রভাব। এ অবস্থায় ট্রাম্প নাকি চিন পিং—কে আগে হার মানবেন, সেদিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্বের অনেকেই।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ১৪৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। জবাবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
গত মঙ্গলবার গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের আমদানির ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্প তাঁর বাণিজ্য কৌশল আরও জোরদার করেছেন। এসব খনিজ সম্পদের বেশির ভাগই আসে চীন থেকে।
এর আগে ব্লুমবার্গ নিউজের খবরে বলা হয়, বোয়িং কোম্পানির উড়োজাহাজের সরবরাহ না নিতে ও মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ কেনা স্থগিত করতে নিজেদের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে চীন। হংকংয়ের ডাক বিভাগ বলেছে, তারাও আর যুক্তরাষ্ট্রে চিঠি পাঠানোর সেবা দেবে না।
কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা ও কৌশল বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাদজিবুল্লা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পণ্য বিক্রি করাটা চীনের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুই দেশের অর্থনীতিতেই বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।’
১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পণ্য বিক্রি করাটা চীনের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুই দেশের অর্থনীতিতেই বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।ভিনা নাদজিবুল্লা, কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্টভিনা নাদজিবুল্লা মনে করেন, ট্রাম্প ও চিন পিংয়ের মুখোমুখি অবস্থানে কে আগে হার মানবেন, তা নির্ভর করছে কে বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবেন এবং কে বেশি প্রস্তুত, তার ওপর।
ট্রাম্প অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে চীন। তবে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, সে সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বচ্ছ ধারণা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকেরা।
আরও পড়ুনচীনের যেভাবে ট্রাম্পের শুল্কের জবাব দেওয়া উচিত১৭ এপ্রিল ২০২৫যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্যতম প্রধান আলোচক হ্যারি ব্রডম্যান মনে করেন, ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে চান, নাকি দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে চান, তা স্পষ্ট নয়।
ব্রডম্যান আল–জাজিরাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানায় কাজ চালাতে চীনা পণ্য প্রয়োজন হয়, সেগুলো ট্রাম্প কীভাবে সামাল দেবেন? এটা যেনতেন বিষয় নয়।’
‘বাজারের উৎপাদন স্তরে স্তরে বিভক্ত। আপনার কাছে সারা বিশ্ব থেকে জিনিসপত্র আসছে। বিশ্ব অর্থনীতি খুব সুন্দর করে উল্লম্বভাবে সাজানো। তাই বিজয়ী ও পরাজিত কে, তা স্পষ্ট নয়,’ বলেন ব্রডম্যান।
ব্রডম্যানের মতে, বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের ভাবনা অবাস্তব। তিনি আবাসন ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের ক্ষেত্রে নন। কীভাবে নিজে জিতবেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাবেন, সেটা নিয়েই ভাবতে থাকেন তিনি।
আরও পড়ুনট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধে চীন কি মার্কিন ঋণ ব্যবহার করতে পারে১৫ এপ্রিল ২০২৫ভুল হিসাবনিকাশ
ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আলোচনার টেবিলে আসা না–আসার বিষয়টি চীনের ওপর নির্ভর করছে বলে তিনি মনে করেন।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বল চীনের কোর্টে।’ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘চীনের আমাদের সঙ্গে চুক্তি করা প্রয়োজন। আমাদের তাদের সঙ্গে চুক্তি করার প্রয়োজন নেই।’ লেভিটের দাবি, এ বক্তব্য সরাসরি ট্রাম্পের কাছ থেকে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন অর্থনীতি চীনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধে প্রবেশ করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকেই বাণিজ্যযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বেইজিং।
ট্রাম্প অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে চীন। তবে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, সে সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বচ্ছ ধারণা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকেরা।আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেক্সটার টিফ রবার্টস বলেন, ‘চীন দ্রুত আলোচনার টেবিলে আসবে ও হুমকিগুলো নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে ভুল হিসাবনিকাশ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।’
আরও পড়ুনছাড় সাময়িক, সেমিকন্ডাক্টরের ওপর শুল্ক আসছে: ট্রাম্পের হুমকি১৪ এপ্রিল ২০২৫গত সপ্তাহে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলির প্রতিবেদনে বলা হয়, আট বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা চলাকালে ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা চীন এখন শুল্কের খড়্গ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রবার্টস বলেন, ‘বাণিজ্য ও নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই এটি (ট্রাম্পের উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ) চীনের জন্য অনেকটা অস্তিত্বের লড়াই।’ সি চিন পিংয়ের একটি বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি এ কথা বলেন। সি বারবারই বলেছেন, পূর্ব দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে এবং পশ্চিমে কমেছে।
বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেকে দূরে রেখে বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে চীন, যেমন সয়াবিনের মতো মার্কিন কৃষিপণ্যগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে তারা। এখন এসব কৃষিপণ্যের বেশির ভাগ ব্রাজিল থেকে আসে।
২০২৪ সালে চীনের মোট রপ্তানি করা পণ্যের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। ২০১৮ সালে দেশটিতে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ রপ্তানি হয়েছিল।
গত সোমবার থেকে সি চিন পিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঁচ দিনের সফর শুরু করেছেন। মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষক হিসেবে চীনের স্বঘোষিত ভাবমূর্তি শক্তিশালী করা এবং এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এ সফর করছেন তিনি।
ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে চান নাকি দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে চান, তা স্পষ্ট নয়।হ্যারি ব্রডম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধিচীনের জন্য কিছু রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়ও আছে। রবার্টস মনে করেন, সি চিন পিং একজন শক্তিমান নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলে এ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। দেশের অভ্যন্তরে ও অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো ঝুঁকি চিন পিং নেবেন না।
রবার্টস বলেন, ‘হতে পারে তাঁরা দুই পক্ষকেই বিজয়ী ঘোষণা করার মতো কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেন। আর তা না হলে বড় বিপদ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্কযুদ্ধে কতটা বাড়বে আইফোনের দাম১১ এপ্রিল ২০২৫সি চিন পিং ও ডোনাল্ড ট্রাম্প.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র চ ন র জন য র ওপর অবস থ ধরন র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ফেসবুকের বন্ধুতালিকা ‘রিসেট’ করার ভাবনা ছিল জাকারবার্গের
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিযোগিতা নস্যাৎ করে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে চলছে মেটার বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত মামলার বিচার। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ সোমবার এই মামলায় সাক্ষ্য দেন। শুনানিতে আদালতে উপস্থাপন করা হয় মেটার অভ্যন্তরীণ কিছু ই–মেইল, যেখানে উঠে আসে এক সময় সবাইকে ফেসবুকে বন্ধু তালিকা ‘শূন্য’ থেকে শুরু করতে বাধ্য করার এক অভিনব প্রস্তাব।
২০২২ সালে পাঠানো একটি ই–মেইলে জাকারবার্গ লেখেন, বন্ধু তৈরিতে দ্বিগুণ জোর। সবাইকে তাঁদের বন্ধুতালিকা (গ্রাফ) মুছে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিশোর-তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ইনস্টাগ্রামের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ায় ফেসবুকের ব্যবহার কমছিল। এই প্রেক্ষাপটে ফেসবুকে ব্যবহারকারীদের সক্রিয়তা বাড়াতে নতুন কিছু ভাবনার অংশ হিসেবেই জাকারবার্গ ওই প্রস্তাব দেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে মেটার অভ্যন্তরেই প্রস্তাবটি নিয়ে আপত্তি ওঠে। ফেসবুক বিভাগের প্রধান টম অ্যালিসন ই–মেইলের জবাবে লেখেন, আপনার প্রস্তাবিত প্রথম বিকল্পটি (বন্ধু সংযোগে জোর) আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে না। ইনস্টাগ্রামে বন্ধু সুবিধাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি অকার্যকর হলে ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জাকারবার্গ আরও একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন। ফেসবুককে বন্ধুভিত্তিক মাধ্যমের বদলে অনুসরণভিত্তিক (ফলোয়ার) মাধ্যমে রূপান্তর করার চিন্তা ছিল তাঁর। যদিও এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি, তবে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে উঠে আসা এসব ভাবনা থেকে প্রযুক্তি মাধ্যমটি ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটতে চায়, তার একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়।
মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ২০২০ সালে মেটার বিরুদ্ধে এই প্রতিযোগিতা-বিরোধী মামলা করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রতিযোগীদের ঠেকিয়ে দিয়েছে। এফটিসির ভাষ্য, সম্ভাবনাময় প্রতিযোগীরা যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তখন মেটা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার বদলে কিনে নিয়ে সেই ‘হুমকি’ দূর করেছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি উদ্ভাবনশীল মাধ্যমগুলোকে হুমকিস্বরূপ মনে করে অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাবিরোধী একক আধিপত্য গড়ে তুলেছে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস