বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পরিবারতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক রাজনীতিতে আটকে আছে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ একেবারে হঠাৎ করে পুরোনো কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারবে না। আমাদের সংস্কারগুলো যদি দেশের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে কৌশলগতভাবে পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পন্ন করা যায়, তাহলে তা টেকসই হবে।

রাতারাতি পরিবর্তনের ধারণা

জনগণের আশা, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে দ্রুত সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক, মেধাভিত্তিক দলকাঠামোতে রূপান্তরিত হবে। আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতাব্যবস্থার শিকড় অনেক গভীরে। আইনের শাসন এখানে দুর্বল। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য প্রবল। 

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐতিহাসিক বিকাশ দেখলে বোঝা যায় যে সেখানে সংস্কার কীভাবে ধাপে ধাপে ঘটেছে। অর্থবহ দলকাঠামো গড়তে তাদের প্রায় এক শতাব্দী লেগেছে। আর উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ সংস্কার বাস্তবায়নে লেগেছে আরও এক শতাব্দী। 

প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগেই আমূল পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা অগ্রগতির বদলে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। ফলে আমাদের ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোর মতো ধীরে ধীরে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ শাসনের দিকেই যেতে হবে।  

অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি শক্তিশালী করা

এই ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় না গিয়ে বিদ্যমান দলকাঠামোর মধ্যে আবশ্যকীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর একসময়ের কর্তৃত্ববাদী শাসক দল ‘গোলকার’ আঞ্চলিক চেয়ারম্যানদের জন্য মেয়াদসীমা চালু ও অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করে। পরিবারতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলো প্রভাবশালী থাকলেও এসব সংস্কার তরুণ উপযুক্তদের মূল পদগুলোতে যেতে সহায়তা করেছে। 

ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টি ছিল অভিজাতদের এক ক্লাব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তারা ধাপে ধাপে আরও গণতান্ত্রিক সংগঠন হয়ে ওঠে। প্রথমে ১৮৩০-এর দশকে স্থানীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা, এরপর ১৮৬০-এর দশকে আনুষ্ঠানিক সদস্যকাঠামো চালু করে তারা। এভাবে বিংশ শতাব্দীতে আরও উন্মুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনপ্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। 

বাংলাদেশে জেলা সভাপতির মতো মধ্যবর্তী স্তরের নেতাদের জন্য মেয়াদসীমা আরোপ এবং শীর্ষ পদগুলোর জন্য নির্বাচকমণ্ডলী সম্প্রসারণ করা হলে পর্যায়ক্রমে পরিবারতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কমে আসবে।   

আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ

অস্বচ্ছ অর্থায়ন নিয়ে হঠাৎ করে কঠোর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিলে দলীয় কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। ১৯৯০-এর দশকে ব্রাজিলে আংশিক সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সীমার ওপর অনুদান জনসমক্ষে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। পাকিস্তানের ২০১৭ সালের নির্বাচন আইন প্রার্থীদের আর্থিক আয় ও ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে আর্থিক হিসাব প্রকাশের বিধান বাস্তবায়ন এখনো অসম্পূর্ণ। 

ধারাবাহিক আর্থিক নিয়ন্ত্রণের একটি ঐতিহাসিক নমুনা হলো যুক্তরাষ্ট্র। ১৯০৭ সালের টিলম্যান অ্যাক্ট দ্বারা করপোরেট দান নিষিদ্ধ, ১৯২৫ সালের ফেডারেল করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট দ্বারা অনুদান বিষয়ে তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৭১ সালের ফেডারেল ইলেকশন ক্যাম্পেইন অ্যাক্টের মাধ্যমে আরও ব্যাপক সংস্কার করা হয়। তারপরও সেখানে অর্থ নির্বাচনকে প্রভাবিত করেই চলছে। 

বাংলাদেশে প্রথমে ১০ লাখ টাকার ওপর দানসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা যায়। এরপর ধীরে ধীরে কঠোর অডিট এবং শেষে দলগুলোর জন্য সরকারি অর্থায়নের দিকে যাওয়া যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জার্মানি এ ধরনের ধারাবাহিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। 

প্রার্থী নির্বাচনের ধারাবাহিক বিকেন্দ্রীকরণ

দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) বর্ণবাদ–পরবর্তী সময়ে একটি মিশ্র পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে। অর্থাৎ, স্থানীয় শাখাগুলো প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করে। 

মার্কিন রাজ্যগুলো ১৯০০ সালের শুরুতে প্রাইমারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেও ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি। এখনো অনেক রাজ্য প্রাইমারির পাশাপাশি দলীয় সম্মেলন বজায় রেখেছে। ভারতের বিজেপিতে যদিও চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে, তবে স্থানীয় মতামত প্রকাশের সুযোগ আছে। 

বাংলাদেশে পরামর্শমূলক মনোনয়নের মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে। স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় অনুমোদনের জন্য প্রার্থী প্রস্তাব করতে পারেন। কম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচনে আরও উন্মুক্ত নির্বাচনপদ্ধতি চালু করা যায়। যেমন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি বিংশ শতাব্দীজুড়ে ধারাবাহিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনপ্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। 

নীতিভিত্তিক প্রতিযোগিতার জন্য ধারাবাহিক ব্যবস্থা

ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে নীতিভিত্তিক প্রতিযোগিতার দিকে যেতে দলগুলোর মধ্যে সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। ২০০০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার দলগুলো কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট দ্বারা পর্যালোচিত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ শুরু করে। অন্যান্য দেশে দলনিরপেক্ষ থিঙ্কট্যাংকগুলো দলগুলোর ইশতেহারে উদ্ধৃত অঙ্গীকারের আর্থিক মূল্যায়ন ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করছে। ফলে ভোটাররা লাভবান হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আনুষ্ঠানিকতা থেকে ১৮৪০-এর দশকে আরও আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজন করেছে। বর্তমানে আর্থিক মূল্যায়নসহ ‘নীতি দলিল’ প্রকাশ করছে। চীনও একদলীয় ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে পাইলট কর্মসূচিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় সদস্যদের নির্দিষ্ট নেতৃত্বদানকারী পদে ও নীতি অগ্রাধিকারে ভোট চালু করেছে। 

বাংলাদেশে দলগুলো অর্থনৈতিক নীতির ওপর অভ্যন্তরীণ বিতর্কপ্রক্রিয়া চালু করে রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে পারে। সুইডেনের উদাহরণ অনুসরণ করে বিশ্লেষণের জন্য স্বাধীন সংস্থার কাছে ইশতেহার জমা দিতে পারে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করেও নীতি আলোচনাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। 

বিরোধী দলগুলোর অধিকার সুদৃঢ় করা 

ব্যাপক সাংবিধানিক পরিবর্তনের দাবি করার বদলে ছোট ছোট পদক্ষেপ গঠনমূলক ভিন্নমতের জন্য জায়গা তৈরি করা যায়। মালয়েশিয়ার ২০১৮-পরবর্তী সংস্কার  সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সমতা সৃষ্টি না করেও সংসদীয় কমিটির আসন প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে বিরোধী দলের প্রতি হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। নেপালের সাংবিধানিক বিধান (অনুচ্ছেদ ৯১) গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।  

বিরোধী দলের অধিকারের ঐতিহাসিক বিকাশ ও ধারাবাহিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি মডেল হচ্ছে যুক্তরাজ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘লিডার অব দ্য অপজিশন’ উপাধির অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, ১৯৩৭ সালে সরকারি বেতন এবং শেষে সংসদীয় পদ্ধতিতে বিরোধী ভূমিকা আনুষ্ঠানিকীকরণ করেছে তারা। বাংলাদেশেও আইন আছে, বাস্তবায়নের বিশাল ঘাটতি দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সময়ের দাবি।  

ধারাবাহিক সংস্কারের কৌশল

বৈশ্বিক ও ঐতিহাসিক উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায় যে ধারাবাহিক, পর্যায়ক্রমিক সংস্কার অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশের জন্য মূল বিষয় হলো আস্থা ও সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য পরিচালনা করা যায়, এমন পরিবর্তন দিয়ে শুরু করা। যেমন মধ্যবর্তী স্তরের নেতাদের জন্য মেয়াদসীমা, রাজনৈতিক অনুদান প্রকাশের বাধ্যবাধকতা, পরামর্শমূলক মনোনয়ন, স্বাধীন ইশতেহার পর্যালোচনা এবং বিরোধী দলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। এভাবে আরও কাঠামোগত সংস্কারের দিকে এগোনো সম্ভব। 

কার্যকর মডেলের অভাব বড় বাধা নয়। সংস্কারকে অব্যাহত রাখতে হলে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দলগুলোকে সরব থাকতে হবে, তারা যেন স্থায়ী চাপ তৈরি করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবের পাশাপাশি সেগুলো নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক জারি রাখা জরুরি। 

স্থিতিশীলতা, বৈধতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারে বাধ্য করতে পারলেই গণতন্ত্রের দিকে সত্যিকার অর্থে যাত্রা শুরু হতে পারে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ধারাবাহিকতা ও অধ্যবসায় থাকলে এমনকি গভীরভাবে প্রোথিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাও আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক দিকে বিবর্তিত হতে পারে। 


ড.

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর শ শত ব দ র জন য ম ব যবস থ দলগ ল র ইশত হ র আর থ ক পর য য় সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব রাস্তা বন্ধ করেই সামনে এগোবে এনসিপি, জানালেন নাহিদ

আরেকটি ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে আসবে না, তার সব রাস্তা বন্ধ করেই সামনে এগোবেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় সংসদের এলডি হলে এই বৈঠক শুরু হয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য ছিল, আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে চাই। অর্থাৎ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কেবল ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, ক্ষমতা থেকে একটি দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে বসানোর পরিকল্পনা ছিল না। বরং কীভাবে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন করে, রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক এবং গুণগত সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার রক্ষা করবে, এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ছিল।’

এনসিপির আহ্বায়ক আরও জানান, তাঁর দল পরিষ্কারভাবে বলেছে, সংস্কার বলতে তাঁরা মৌলিক সংস্কারকে বোঝেন। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘যে সংস্কার করলে রাষ্ট্র কাঠামোর একটি আমূল ও গুণগত পরিবর্তন হবে। বিগত সময়ে আমরা সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ দেখেছি। সংবিধানে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামোর বীজ বপন হয়েছিল। ফলে সেই রাষ্ট্র কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে যে-ই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাক, তার ভেতরেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা থাকবে, স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার প্রবণতা থাকবে।’

রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থাকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে যে সুপারিশগুলো পাঠানো হয়েছে, সেগুলোতে আমরা মতামত দিয়েছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হয়েছি, যেসব জায়গায় আংশিক বা দ্বিমত রয়েছে, সেখানে আমাদের সুপারিশ সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছি। আজ হয়তো বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাব।’

জাতীয় ঐকমত্য ও জুলাই সনদ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন  নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন,  জাতির সামনে আমাদের যে অঙ্গীকার, সেটি পূরণ করতে হবে যে,  আরেকটি ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে আসবে না, তার সব রাস্তা বন্ধ করেই সামনে এগোব। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য যার যার জায়গা থেকে কাজ করব।

বেলা  সোয়া ১টার দিকে বৈঠকের বিরতিতে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, বিচার এবং সংস্কার দৃশ্যমান করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে, তবে তার আগে বিচার এবং সংস্কার দৃশ্যমান করতে হবে। এ জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, সেটি সরকার পেতে পারে।

আখতার হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয়। বরং এখানে প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে সাংবিধানিকভাবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগগুলো রয়েছে। আমরা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলছি। বর্তমান সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের কথা বলছি। গণপরিষদের বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছি।’

বৈঠকে এনসিপি বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোয় শুধুমাত্র আইন প্রণয়নের ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান এবং আস্থার ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে বলেও জানান আখতার হোসেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আখতার বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই 'নির্বাচন' শব্দকে যুক্ত করতে হবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের যে দায়িত্ব পালন করবেন, আমরা সেদিকে গুরুত্বারোপ করেছি। সেই রূপরেখা কেমন হতে পারে, উপদেষ্টা হিসেবে কারা থাকতে পারেন, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করছি। আলোচনা শেষ হলে বিস্তারিত বলতে পারব।’

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দুটি নির্বাচন চাচ্ছি, এমন নয়। আমরা একটি নির্বাচনই চাচ্ছি, যেটি আইনসভার নির্বাচন। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনটিকেই গণপরিষদের স্ট্যাটাস দেওয়া হবে।’

সংবিধানের বেসিক ফান্ডামেন্টাল রিফর্মেশনের এখতিয়ার শুধুমাত্র গণপরিষদের থাকে বলেন হাসনাত। তিনি বলেন,‘ সে জন্য আমরা আসন্ন নির্বাচনে একই সঙ্গে আইনসভার নির্বাচন ও গণপরিষদের স্ট্যাটাস চাই। যাদের প্রথম কাজ হবে, সংবিধানকে পুনর্লিখন করা।  একই সঙ্গে পার্লামেন্টের রুটিন কাজ করবে।’

বিএনপি ও এনসিপি কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে দ্বিমত আছে। সে ক্ষেত্রে ঐক্য কীভাবে সম্ভব- সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে হাসনাত বলেন, ‘আলোচনার মধ্য দিয়ে ঐক্যে পৌঁছাতে হবে। ঐক্য তো দলীয় নয় বরং জাতীয় স্বার্থে।’

বৈঠকে এখন পর্যন্ত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন হাসনাত। সেগুলো হলো, নাগরিকদের অধিকার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর (পিসফুল ট্রানজিশন অব পাওয়ার) এবং সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ।

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, আমরা এখনো ওই নীতিতেই আছি।’

এর আগে, বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, এক নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের কাজ সবাই মিলে যেন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারি। যেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরত না আসে।

সংস্কার কমিশনগুলোর পক্ষ থেকে যে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে  কিছু একমত, কিছু ভিন্নমত আছে।   যেসব জায়গায় আংশিকভাবে একমত বা ভিন্নমত সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং প্রয়োজনে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেন আলী রীয়াজ।

আরও পড়ুনভিন্নমতের জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, এনসিপির সঙ্গে বৈঠকে আলী রীয়াজ৩ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ