গতকাল ১৭ এপ্রিল ছিল ‘বিশ্ব বাদুড় ভালোবাসা দিবস’। বিষয়টি অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগছে নিশ্চয়। ইংরেজিতে দিনটিকে বলা হয়েছে ‘গ্লোবাল ব্যাট অ্যাপ্রিসিয়েশন ডে’। বাংলা অভিধানে অ্যাপ্রিসিয়েশন শব্দটির নানা অর্থ খুঁজে যা পেলাম, তার মধ্যে ভালোবাসা শব্দটিই ভালো লাগল। সে যা-ই হোক, বাদুড়কে ভালো করে জানাশোনা, গবেষণা করা, বাদুড়ের নানা উপকারিতা কিংবা ক্ষতিকর দিক সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যেই এই দিনের সূচনা করেছে আন্তর্জাতিক বাদুড় গবেষণা সংস্থা ব্যাট কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল। কারণ, বাদুড়কে সাধারণত বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিকর কিংবা ভীতিকর প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে গবেষকেরা বলছেন, বাদুড়ের ক্ষতি যৎসামান্য, সে তুলনায় উপকারিতার পরিমাণ অনেক বেশি।
বাদুড় মোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ। সে তুলনায় এই বিশাল প্রাণিবৈচিত্র্য নিয়ে বিজ্ঞানীদের জানাশোনা খুবই কম। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে তো বাদুড় নিয়ে আছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার। বিষম আকার-আকৃতি, গুপ্ত বাসস্থান কিংবা রাতবিরাতে বিচরণ করে বলে বাদুড় নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব কুসংস্কার বাসা বেঁধেছে। অনেকে এদের অমঙ্গলের প্রতীক বলেও মনে করেন। আবার অনেকের কাছে বাদুড় নানা ধরনের প্রাণঘাতী জীবাণুবাহক হিসেবে পরিচিত। আসলে প্রাণিজগতের নানা প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল, গন্ধগোকুল কিংবা বানর নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের যেমন বাহক; তেমনি বাদুড়ও বিভিন্ন প্রকার জীবাণু বহন করতে পারে। তাই অন্যান্য প্রাণীর মতো বাদুড়েরও কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। যেমন আমাদের দেশে কলাবাদুড় নিপাহ ভাইরাস বহন করে, যা খেজুরের কাঁচা রসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। তেমনি কুকুরের কামড়ে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে জলাতঙ্ক।
এই দিবসে কেন বাদুড়কে ভালোবাসা, কদর করা কিংবা মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। দু–একটি বিষয় ছোট করে বলি। বাদুড় যেসব ইকোসিস্টেম সার্ভিস প্রদান করে, তার মধ্যে অন্যতম পেস্ট কন্ট্রোল, উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে উদ্ভিদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া। গবেষণামতে, তিন শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদের পরাগায়ন ফলভোজী বাদুড়ের মাধ্যমে ঘটে। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত আম, পেয়ারা ও কলা অন্যতম। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে যে ডোরিয়ান ফল, সেটির পরাগায়ন ঘটে এই বাদুড়ের মাধ্যমে। সারা দুনিয়ায় যে ১ হাজার ৪০০ প্রজাতির খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদ আছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশের পরাগায়নের জন্য নানা ধরনের পরাগায়নকারী প্রাণীর উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। এর মধ্যে নীরবে–নিভৃতে কাজ করে চলেছে নানা জাতের বাদুড়সহ অন্যান্য প্রাণী।
অন্যদিকে সারা দুনিয়ার ১ হাজার ৪০০ প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে ৭০ শতাংশ কীটপতঙ্গ খায়। গবেষণা বলছে, বাদুড় যেসব কীটপতঙ্গ শিকার করে, তার ৬০ শতাংশ ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড়। সাধারণ অবস্থায় একটি বাদুড় প্রতি রাতে তার দেহের ওজনের অর্ধেক পরিমাণ পোকামাকড় শিকার করে। আর গর্ভধারী কিংবা পোয়াতি বাদুড় তার দেহের ওজনের সমপরিমাণ পোকামাকড় শিকার করে প্রতি রাতে। এই পোকামাকড়ের মধ্যে থাকে নানা প্রজাতির মশাও। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে বাদুড় প্রতিবছর আনুমানিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ফসলের ক্ষতিসাধন রোধ করে।
যেসব বাদুড় কীটপতঙ্গ শিকার করে, এরা সাধারণত ছোট আকৃতির। সাধারণভাবে এরা আমাদের কাছে চামচিকা নামে পরিচিত। ঘরের কার্নিশে, ঘন গাছের পাতার আড়ালে কিংবা কোনো গাছের কোটরেও এরা সারা দিন বিশ্রাম করে কাটায়। সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে। এই বর্ষাকালে সন্ধ্যাবেলায় আকাশে তাকালে দেখবেন, অসংখ্য ছোট প্রাণী দিগ্বিদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে এগুলোকে পাখি ভেবে ভুল করেন। এরা আসলে বাদুড় বা চামচিকা। সন্ধ্যা নামলে ভূমিতল, ফসলের খেত ও গাছপালা থেকে নানা কীটপতঙ্গ, মশা-মাছি বেরিয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় বাদুড়ও বেরিয়ে পড়ে তাদের রাতের খাবার শিকার করতে। উড়ে উড়ে শিকার করে কীট, পোকামাকড়।
সারা দুনিয়ার বাদুড়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। একসময় আমাদের দেশজুড়ে তেঁতুলগাছ, বটগাছ কিংবা বড় আকারের কোনো গাছে যে বাদুড় দল বেঁধে ঝুলে থাকত, সেই বাদুড় আর আগের মতো দেখা যায় না। ঠিক তেমনিভাবে কমছে অন্যান্য জাতের বাদুড়ও। বাদুড়ের আবাস ধ্বংস, বাদুড়ের বিশ্রাম করার জায়গা নষ্ট করে ফেলা, বৃহদাকার গাছ কেটে ফেলা, খাদ্যের জন্য বাদুড় শিকার ইত্যাদি কারণে বাদুড়ের সংখ্যা দিন দিন কমেছে।
মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে পরাগায়নকারী পাখি, প্রজাপতি, মথ, মৌমাছি, বাদুড় প্রভৃতি প্রাণীর উপস্থিতি অপারিহার্য। এগুলোর মাধ্যমে ইকোসিস্টেমের সেবা কার্যকরভাবে অব্যাহত আছে। ফলে আমরা ফসল পাই, অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারি। এসব প্রাণী না থাকলে স্থলজ ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়বে, মানুষের অস্তিত্ব পড়বে মহাসংকটে। তাই বিজ্ঞানীরা বলেন, সিম্পল ট্রুথ ইজ, ‘উই ক্যান্ট লিভ উইদাউট দেম’।
এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক র কর আম দ র পর ম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
ফ্রিজ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন, প্রিমিয়ার ব্যাংককে জরিমানা
প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবালের ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় ব্যাংকটিকে বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবালের ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে বিষয়টি ধরা পড়ার পর সমপরিমাণ ১ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং ৩০ হাজার ডলার সমপরিমাণ প্রায় ৩৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বুধবার বিএফআইইউ এ-সংক্রান্ত চিঠি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএফআইইউ গত নভেম্বরে এইচবিএম ইকবাল, তার বর্তমান স্ত্রী অভিনেত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পী এবং তিন সন্তান মঈন উদ্দিন ইকবাল, ইমরান ইকবাল ও নওরীন ইকবালের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে। পাশাপাশি তাদের একক মালিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে সে হিসাবও ফ্রিজ করতে বলা হয়। এই নির্দেশনা অমান্য করে ব্যক্তি হিসাব থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং ৩০ হাজার ডলার সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। যে কারণে ব্যাংকটিকে সমপরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ আশীর্বাদে এইচবিএম ইকবাল পরিবারই এখনও প্রিমিয়ার ব্যাংক চালাচ্ছে। বিভিন্ন জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও অদৃশ্য কারণে সরকার পতনের পর প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবালের ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে এইচবিএম ইকবাল পলাতক। বিদ্যমান নিয়মে টানা তিন মাস পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে পদ হারাবেন। এ রকম ঝুঁকির কারণে গত ১২ জানুয়ারি তিনি এবং তার আরেক ছেলে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান মইন ইকবাল ই-মেইল যোগে পদত্যাগপত্র পাঠান। এরপর ১৪ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় তা অনুমোদন হয়। এছাড়া এইচবিএম ইকবালের পছন্দের অন্য পরিচালকরা বহাল আছেন। ইকবাল পরিবারের একক আধিপত্যের কারণে ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন ভবন ভাড়া দিয়ে কয়েকগুণ টাকা নেওয়া, বিভিন্ন কমিশন বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে অনৈতিক সুবিধা অব্যাহত আছে।
জানা যায়, এইচবিএম ইকবাল প্রিমিয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। গ্রুপটির অধীনে পাঁচ তারকা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সিমেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গুলশানে হোটেল রেনেসন্স, হিলটন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট এবং রয়াল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়েছে। নানা অনিয়ম হয়েছে এরকম ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিগত সরকারের সময়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আলোচনায় ছিল। ১৯৯৯ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে রাখেন। এবারই প্রথম তার ছেলেকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে।