দোর ঘণ্টি শোনার পর শিল্পী ঢালী আল মামুন নিজে দরজা খুলে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালেন। পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে বসার ঘর। স্টিলের কাঠামোর ওপর তৈরি খুব কম উচ্চতার বসার সোফা। এক পাশে ডিভানের মতো আরেকটি বসার জায়গা করে ওপরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে গদি। ঘরজুড়ে শোভা পাচ্ছে মেলা থেকে সংগ্রহ করা নানা মুখোশ, পুতুল। ঘরের সব আসবাবে যেন শিল্পের ছোঁয়া। ঘুরেফিরে একদিকের দেয়ালে চোখ আটকে যায়। সেখানে বিশাল ক্যানভাস। সমাজের নানা অসংগতি, ক্ষমতা, দখল, নিয়ন্ত্রণ, নির্যাতন, ইতিহাস ইত্যাদির প্রভাব ফুটে উঠেছে যেন ক্যানভাসের শরীরজুড়ে। বসার ঘরের পাশে লম্বা খাবার টেবিল। সেখানে বসলেন তিনি। টেবিল-চেয়ারগুলো সাধারণের মাঝেও যেন অনন্য। টেবিলের ওপর প্লেটের নিচে দেওয়ার জন্য প্লেসমেট কিংবা চায়ের চামচ এসব থেকে চোখ সরিয়ে যেই চোখ পড়ল শিল্পীর চোখে; তখনই কেন যেন মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠল ২০১১ সালের ১৩ আগস্টের স্মৃতি। কি ভয়াবহ একটা দিন ছিল। প্রকৃতিতেও যেন নেমে এসেছিল স্থবিরতা! সেদিন মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন। সেই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ঢালী আল মামুন। দুর্ঘটনার পর তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ আগস্ট তাঁকে ব্যাংকক নেওয়া হয়। সে ঘটনার কথা তুললে নিশ্চয় তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বেন তাই সেদিকে না গিয়ে আড্ডা চলে তার গতিতে।
তবে সেই ভয়াবহতা কাটিয়ে ঢালী আল মামুন এখনও কাজ করছেন; তা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া বটে! বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পে আধুনিকতার চর্চা মূলত শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক।
বিশেষত বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদকেন্দ্রিক, যা ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ বা বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক কাঠামোর আদলে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিককার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। পশ্চিমা আধুনিকতার ধারায় তাদের একটা অংশের নেতৃত্বে বিশেষ করে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগের যাত্রা হয়। যেখানে পদ্ধতিগত দিক থেকে ঢাকা চারুকলার থেকে খুব বেশি ভিন্নতা শুরুতে লক্ষ্য করা যায়নি। ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত আধুনিকতা চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল অ্যাবস্ট্রাকশন বা নির্বস্তুকতা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী এসএম সুলতান, শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ, নভেরা আহমেদ, শামীম শিকদারের মতো কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ শিল্পী এ ধারায় কাজ করতেন। আশির দশকে নির্বস্তুকতা ও পশ্চিমা আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতাসহ স্থানিক শিল্প ভাষা অন্বেষণের মতো অসংখ্য বিষয় সামনে নিয়ে ‘সময়’ নামে একটি শিল্প সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যেখানে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে শিল্পী ঢালী আল মামুন ও দিলারা বেগম জলি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ‘সময়’ গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার। ১৯৮৮ সালে ঢালী আল মামুন শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
ঢালী আল মামুন শিল্পী হিসেবে যতটা স্বকীয় ও জনপ্রিয়, শিক্ষক হিসেবে তার চেয়েও বেশি বলাটা অত্যুক্তি নয়। শিল্পশিক্ষার পাঠদানে যতটা হাতে-কলমে শেখানোর ব্যাপার থাকে বলে মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি থাকে চিন্তার খোরাক জোগানো। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও স্বতন্ত্রতার ধরন বুঝে তাকে অনুপ্রাণিত করা। তাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ কেমন হতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করা। এক্ষেত্রে তিনি যে সার্থক, এ দাবি তার ছাত্রদেরই!
চট্টগ্রাম চারুকলা থেকে পড়াশোনা করে বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পের আঙিনায় যাদের স্বকীয় বিচরণ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম নেওয়া যেতে পারে। যেমন–তাসাদ্দুক হোসেন দুলু, শায়লা শারমিন, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, রিপন সাহা, জিহান করিম, শারদ দাস, রাজীব দত্তসহ অনেক শিল্পী ঢালী আল মামুনের সরাসরি ছাত্র। ২০০৬ সালে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও কলিগদের সঙ্গে নিয়ে ইউরোপীয় চিত্রকলার চারটি কালজয়ী পেইন্টিং অবলম্বনে চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ‘চারটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের অভিযাত্রা–স্থানের সাথে কালের সংলাপ’ শিরোনামে একটি কর্মশালাভিত্তিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তিনি। যেখানে পল সেজান, এডওয়ার্ড মনে, ইউগিন দেলাক্রয়ে ও জর্জ সুরার চারটি পেইন্টিংকে শিক্ষার্থীরা তাদের সময় ও সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগের চেষ্টাস্বরূপ নতুন করে দৃশ্যায়নের চেষ্টা করেন, যা শিক্ষক হিসেবে তাঁর একটা অনন্য প্রয়াস। তাঁর শুরুর দিকের ছাত্র শিল্পী তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর মতে, তরুণদের সঙ্গে স্যারের সম্পর্ক অসাধারণ। তিনি তরুণদের পাঠশালা। তাঁর জনপ্রিয়তা চট্টগ্রামের শিল্প শিক্ষাজগতের শেষ আশ্রয় বলে মনে করি!
নব্বই দশক-পরবর্তী বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পের আঙিনায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে; যা এখনও চলমান। প্রথাগত মাধ্যম ও চিন্তার সমন্বয় ভেঙে দৃশ্যশিল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে নিত্যনতুন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হয়। অবস্থান ও ঐতিহ্যের কারণে এ নতুন ভাষারীতির চর্চার ক্ষেত্রে ঢাকাভিত্তিক শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকলেও চট্টগ্রাম চারুকলা পিছিয়ে পড়েনি একটুও এবং সেটি যাদের কারণে সম্ভব হয়েছে, শিল্পী ঢালী আল মামুন তাদেরই প্রথম সারির একজন।
ঢালী আল মামুন দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। ইতিহাসের ক্রমাগত অনুসন্ধান তাঁর ভেতরে নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। অবচেতনে ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রভাব আমাদের মনন ও চিন্তার জগৎকে বহুলাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর স্থাপনা শিল্পকর্ম নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত বিষয় বৈচিত্র্য দারুণভাবে নাড়া দেয়। তাঁর ড্রয়িং, চিত্রকর্ম, গতিময় ভাস্কর্য এবং স্থাপনা, স্থানিক বাস্তবতায়, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার যে বহুবিধ প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, তা উদ্ভাবনে উদ্যোগী হয়। প্রাণবন্ত এক আড্ডা শেষে ফেরার পথে মনে পড়ে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার কলাকেন্দ্র গ্যালারিতে ‘চর্চা, চর্যা, উদযাপন’ নামক একটি প্রদর্শনীর কথা। যেখানে চট্টগ্রাম চারুকলার স্বাতন্ত্র্য সবচেয়ে ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে চট্টগ্রাম চারুকলার প্রতিষ্ঠাকালীন শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী ও শিল্পী মুর্তজা বশীরের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম ও চট্টগ্রাম চারুকলাকেন্দ্রিক তাদের চিন্তার কিছু তথ্য-উপাত্তসহ বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘তিন পথিকৃৎ ও তাদের আধুনিকতা’ শীর্ষক আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। এ রকম অসংখ্য কাজ তিনি করেছেন, যেগুলো তাঁর কর্মক্ষেত্র, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রামাণিক নিদর্শন হিসেবে ধরা দেয় আমাদের চোখে! v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত হয় ছ ল আল ম ম ন চ র কল র র জন য র দশক
এছাড়াও পড়ুন:
গার্দিওয়ালার ভয়, চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা হারালে বড় ট্রান্সফার হবে
পেপে গার্দিওলা যেমন শিরোপা জেতাতে পারদর্শী, ঠিক একইভাবে ট্রান্সফার মার্কেটের সবচেয়ে বড় খদ্দেরও তিনি। শীতকালীন দল বদলেই খরচ করেছেন ২০০ মিলিয়ন ইউরো। সিটি কোচের এই ধরনের বিশাল অংকের অর্থ খরচের ইচ্ছে আছে আসন্ন গ্রীষ্মকালীন দল বদলেও। তবে গার্দিওয়ালা সতর্ক করে বলেছেন যে, ম্যানসিটি চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা না পেলে তাদের শীর্ষস্থানীয় ট্রান্সফার টার্গেটগুলো মিস হয়ে যেতে পারে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ (ইপিএলে) সবশেষ ৭ মৌসুমে ৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। তবে এই মৌসুমে তারা আছে টেবিলের পাঁচ নম্বরে। সামনের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে ইপিএল থেকে ৫টি দল খেলার সুযোগ পাবে। তাই বর্তমান অবস্থানে থেকেই যদি সিটি মৌসুম শেষ করে, তাহলে তাদের চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে অসুবিধা হবে না। তবে যদি একটুও পা ফসকায়, তাহলে ঘারে নিঃশ্বাস ফেলা অ্যাস্ট ভিলা ও চেলসির কাছে হারাতে হবে ৫ নম্বর স্থানটিও। সিটি শনিবার (১৯ এপ্রিল) এভারটনের বিপক্ষে ম্যাচে নামার আগে তাদের হাতে রয়েছে আর মাত্র ছয়টি খেলা।
চলতি মৌসুমে কিছুটা হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর গার্দিওয়ালা গ্রীষ্মে দল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, যদি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবল নিশ্চিত না হয়, তাহলে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে খেলতে সেরা খেলোয়াড়দের আনতে অসুবিধা হতে পারে।
আরো পড়ুন:
ম্যানসিটির ফুটবলারদের ইচ্ছেশক্তির অভাব দেখছেন গুন্দোয়ান
ডার্বি ড্র করে ইউনাইটেড সমর্থকদের ‘ক্লাসলেস’ বললেন গার্দিওলা
গার্দিওয়ালা বলেন, “এটা নির্ভর করে আমরা কাদের নিতে চাই এবং তারা কী শুধুমাত্র আমাদেরকেই পছন্দ করে। যদি তাদের সামনে একাধিক বিকল্প থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিত, তারা অবশ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলছে এমন ক্লাবগুলোকেই বেছে নেবে।”
ইএসপিএনের দাবি, কেভিন ডি ব্রুইনার বিকল্প হিসেবে, জার্মান ক্লাব বেয়ার লেভারকুসেনের ফরোয়ার্ড ফ্লোরিয়ান উইর্টজের দিকে নজর রেখেছে সিটি। তবে রিয়াল মাদ্রিদ এবং বায়ার্ন মিউনিখও তাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী। আর এই দুই দলই আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলবে।
গার্দিওয়ালার ধারনা, “আমি জানি না। হয়তো কিছু খেলোয়াড় আসবে, আবার কেউ কেউ, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে পারছি না’ বলে আসতে চাইবে না। আমি এখনও কোনও সম্ভাব্য ভবিষ্যতের খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলিনি, তাই আসলে কিছুই বলতে পারছি না।”
ডি ব্রুইনা নিশ্চিতভাবে সিটি ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। তবে দলে বেশ কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। গার্দিওয়ালা বলেন, “আমার এখন বড় স্কোয়াড। দুই একজন খেলোয়াড় গুডিসন পার্কে (এভারটনের মাঠ) সফরে যেতে পারবেন না। এটা খুব বাজে বিষয়, ভয়ানক।
তারা বেঞ্চেও থাকতে পারবে না, বাসায় বসে ভাববে ‘আমি এখানে কী করছি?’ তারা তাদের কাজটাই করতে পারছে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেখা যে কে কতটা নির্ভরযোগ্য। যদি কোনো খেলোয়াড় নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে আর কারো দরকার নেই।”
“যদি এমন হয়, যে পুরো মৌসুমে ২০ কিংবা ২৫ শতাংশ ম্যাচ খেলে, তাহলে হয় তার নিজের বিকল্প খোঁজা দরকার, নয়তো অন্য কাউকে আনতে হবে। এটা ভারসাম্য রক্ষা, যেটা আমাদের আলোচনা, পর্যবেক্ষণ করে ঠিক করতে হবে।”
ঢাকা/নাভিদ