সংস্কার কেন ভোটাধিকার আর গণতন্ত্রের বিকল্প হবে, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, যে ভোটাধিকারের জন্য ১৫ থেকে ১৬ বছর সংগ্রাম করেছেন, সেই ভোটাধিকার কেন বিলম্বিত হচ্ছে? সেটা নিয়ে কেন এত কথা হচ্ছে? কেন নির্বাচন ও ভোটাধিকারের বিকল্প হিসেবে সংস্কারকে দাঁড় করানো হচ্ছে?

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় আয়োজিত এক দোয়া মাহফিলে এমন প্রশ্ন তুলেছেন রুহুল কবির রিজভী। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর সন্ধানে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘ইলিয়াস আলী গুম প্রতিরোধ কমিটি’।

অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপির নেতা রিজভী বলেন, ‘আমরা ভোট, নির্বাচন ও ভোটাধিকারের কথা বললে সরকার আরও কিছু কথা বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। গণতন্ত্র মানেই তো নির্বাচন। গণতন্ত্র মানেই তো ন্যায়বিচার। সেগুলো নিয়ে কি করছেন?

বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে হওয়া রাজনৈতিক মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহার না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করে রিজভী বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের নামে ৬০ লাখ মামলা। আট মাস ক্ষমতায় আছেন, এসব মামলা তো প্রত্যাহার করা যেত। এর জন্য কিছুই করেননি। আজও কেন আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে হবে?’

ডিসেম্বর-জুনের দোলনার মধ্যে কেন বাংলাদেশের নির্বাচনী ওয়াদা ধুলছে, এমন প্রশ্ন তুলে বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা ডিসেম্বর আর জুনের মধ্যে পেন্ডুলামের মতো দুল খাচ্ছে কেন? অন্তর্বর্তী সরকারকে এটার জবাব দেওয়া দরকার।

বিএনপি পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয় না উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, তার মানে, কোনো একটা এজেন্ডা বা পরিকল্পিত নকশার মধ্য দিয়ে এই সরকার চলছে। এটাই তো মানুষের কাছে সব থেকে বড় প্রশ্ন। এই কারণেই তো আজ এত ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে।

বিএনপির ১৫ থেকে ১৬ বছরের আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে রিজভী বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছি একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমরা চেয়েছি, আমাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। আমরা চেয়েছি, আইনের শাসন নিশ্চিত করা। অন্তর্বর্তী সরকারকেই জায়গাটি নিশ্চিত করা দরকার।’

রিজভী বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অবদানকে আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এটা যদি এ রকম হয় যে তাদের কথায় প্রশাসন চলবে, সব সরকারি কর্মকাণ্ড হবে—এটাকে বলে নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্য কেন হবে? ডিসি-এসপিরা বলেন, এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বলে গেছেন, এভাবে করা যাবে না। তাহলে জনপ্রশাসন কেন?’

অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস সময় অতিবাহিত হলেও ইলিয়াস আলীসহ বিএনপির অন্য নেতাদের খোঁজ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রুহুল কবির রিজভী। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আট মাস হয়ে গেল। গুম কমিশন কী কার্যক্রম করছে? কোথায় ইলিয়াস আলী? কোথায় চৌধুরী আলম? কোথায় সুমনসহ অন্যরা? তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কী দায়িত্ব পালন করছেন?

সিলেট সীমান্তে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদে কর্মসূচি করার কারণে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন বলে বিশ্বাস করেন রিজভী। তিনি বলেন, যারা সহ্য করতে পারেনি, তৎকালীন যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের যৌথ প্রযোজনায় ইলিয়াস আলীকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে।

দোয়া মাহফিলে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, স্বেচ্ছাসেবক দলের সম্পাদক সরাফত আলী, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ‘নিখোঁজ’ এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা প্রমুখ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র ব কল প হ সরক র র ব এনপ র

এছাড়াও পড়ুন:

সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুপক্ষীয় মত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনপ্রক্রিয়া। বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ও ২০০৮ সালের নিবন্ধন বিধিমালার অন্তর্নিহিত কঠোরতা সদ্য গঠিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। রক্তস্নাত গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতির হাত ধরে যখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হচ্ছে, সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যে সময়সীমা নির্ধারণ করতে দেখা গেছে, তা বাস্তবতার নিরিখে অসংগত, অপর্যাপ্ত এবং নবীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য কার্যত একপ্রকার নিষেধাজ্ঞারই নামান্তর।

এমন প্রেক্ষাপটে সদ্যোজাত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি) নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধিসংক্রান্ত যে দাবি তুলেছে, তা বিবেচনা করতে হবে রাজনৈতিক ন্যায়বোধ ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের নিরিখে।

নির্বাচন কমিশন গত ১০ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে, যার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরবর্তী ৪০ দিনকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের মতো একটি জটিল ও বিস্তৃত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ প্রায় এক দশক ধরে এ নিবন্ধনপদ্ধতি অকার্যকর ছিল। উপরন্তু এ সময়ের মধ্যেই দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও টানা সরকারি ছুটি পড়ে যাওয়ায় প্রশাসনিক গতিশীলতা ও কার্যসম্পাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে।

এ বাস্তবতা বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো যে নিবন্ধনের সময়সীমা ন্যূনপক্ষে তিন মাস বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে, সেটি নিছক একটি সুবিধার আরজি নয়; বরং তা বর্তমান বাস্তবতার গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত এক গণতান্ত্রিক দাবিমাত্র। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এ আবেদনকে আন্তরিকতা ও যুক্তিনিষ্ঠতার সঙ্গে গ্রহণ করা এবং দ্রুত সময়সীমা বৃদ্ধির ঘোষণা প্রদান করা।

উল্লেখ্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে নিবন্ধনের কড়াকড়ি শর্তাবলি শিথিল করার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের মতে, নিবন্ধনের পূর্বশর্ত হিসেবে দেশের ১০০টি থানা বা ৪০টি জেলার স্বীকৃত কার্যালয়, নির্ধারিত হারে নারী প্রতিনিধিত্ব, পাঁচ বছরে একবার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি শর্ত আজকের বাস্তবতায় অনেকটাই ভারসাম্যহীন ও নবীন দলবিরোধী। এ অবস্থায় একদিকে যখন শর্ত পূরণের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন, তখন অপর দিকে নিবন্ধনের আবেদন আহ্বান এবং এর জন্য কড়াকড়ি সময়সীমা নির্ধারণ একপ্রকার নীতিগত অসংগতি হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

রাজনৈতিক পরিসরকে সুসংবদ্ধ ও বহুমাত্রিক করার জন্য কেবল বৃহৎ ও পুরোনো দলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নবাগত দলগুলোর সামনে দেয়াল তুলে রাখলে তা গণতান্ত্রিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। বরং একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের উচিত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রক্রিয়াকে সময় ও শর্ত—উভয় ক্ষেত্রেই আরও সহনীয়, বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমুখী করা।

আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন অবিলম্বে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধি করবে এবং সেই সঙ্গে শর্ত শিথিলসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে। গণতন্ত্রের শক্তি বহুমতের স্বীকৃতি ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির বিস্তারে নিহিত—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলের হাত-পা বেঁধে দিয়ে তরঙ্গসংকুল নদীতে সাঁতার কাটতে বাধ্য করা নয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত
  • বাম বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার আহ্বান
  • ‘আমাদের রাজনীতিতে ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে’
  • ‘গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে’
  • সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে: মান্না 
  • নির্বাচনের বিকল্প সংস্কার কেন, প্রশ্ন রিজভীর
  • রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে: মান্না
  • প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠিতে যা বলল বিএনপি
  • নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ জানতে যমুনায় বিএনপির প্রতিনিধি দল