বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় আইইউসিএন-বাংলাদেশ ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রাণীদের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণের জন্য লাল তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় ১৯ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে উল্লেখ করা হয়। এগুলোর মধ্যে স্থলজ পাখির সংখ্যাই বেশি। ময়ূরও রয়েছে এর মধ্যে।
গত ৩ মার্চ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসে ময়ূর বনে ফিরিয়ে আনার পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের আলোচনা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যদিও দেশ থেকে অনেক বছর আগেই ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বন বিভাগ আমাদের বন ও বন্য প্রাণীর জিম্মাদার। বিভাগটি দীর্ঘদিনের ‘উৎপাদন বনায়নের’ জায়গা থেকে সরে এসে ইদানীং ‘সংরক্ষণ বনায়নের’ অনুশীলন করছে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। ময়ূর বিলুপ্তির অবসান ঘটিয়ে বন বিভাগ ‘সংরক্ষণবিদ’ হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। তবে কিছুটা অনিশ্চয়তা তো থেকেই যায়। যেমন গাজীপুরে যদি ময়ূর অবমুক্ত করা হয়, তবে সেখানকার আবাসস্থলের উপযুক্ততা মূল্যায়ন করা জরুরি। যে পাখিগুলো ছাড়া হবে, তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন করা দরকার এবং যে স্টক থেকে নেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে সেই একই স্টক থেকে আনা যাবে কি না, সেটি যাচাই করে দেখতে হবে। যে এলাকায় অবমুক্ত করা হবে, সেখানকার স্থানীয় জনগণকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ময়ূর ‘ধুলাবালি গোসল’ করে থাকে পালকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং শরীরের বাইরের অংশ পরজীবীমুক্ত রাখতে। তাই এদের বসবাসের এলাকায় বেশ কিছুটা খোলা জায়গা রাখতে হবে।
ভারতবর্ষে ময়ূর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নৃত্যপরায়ণ পাখি। মোগল সম্রাটেরা ‘মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে’ বসে দীর্ঘ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। সুধীন দাশগুপ্তের লেখা ও সুরে সম্ভবত ১৯৫৯ সালে আশা ভোসলে গাইলেন, ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে, রুম ঝুমা ঝুম নাচরে।’ ময়ূরী কিন্তু নাচে না, প্রজননকালে ময়ূর নাচে তার হেরেমের ২-৫টি ময়ূরীকে আকর্ষণ করার জন্য। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গীত, সুধীন দাশের ‘ময়ূরীকণ্ঠী রাতেরও নীলে আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে’ গানটিও অনেক ভালো লাগার মতো একটি গান। শাহ আবদুল করিমের লেখা ও সুরে ‘ময়ূরপঙ্খি নাও’ গানটিও বহুল শ্রুত একটি গান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলও অবাক বিস্ময়ে জানতে চেয়েছেন, ‘ওরে বনের ময়ূর কোথায় পেলি এমন চিত্রপাখা।’
ময়ূর মানুষের মধ্যে এক অতি অলৌকিক স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়। অনেকের কাছে এটি সত্যের প্রতীক।
আজ থেকে বহু বছর আগে আমি দিল্লি থেকে ট্যাক্সিতে রাজস্থানে যাই। দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে, গাছে ময়ূর দেখেছি। রাজস্থানের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম, সব গাড়ি দুই পাশে থেমে যাচ্ছে ময়ূরের রাস্তা পারাপারের কারণে। রাজস্থানের কৃষিনির্ভর একটি গ্রামের আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা হলো। ঘুম থেকে উঠে অসহ্য গরমে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল এতগুলো ময়ূর একসঙ্গে দেখে—নির্ভয়ে ঘুরছে, গ্রামটি যেন ওদেরই।
এর কয়েক বছর পর মহারাষ্ট্রের পুনেতে যাই বন্ধুদের নিমন্ত্রণে। শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে বেড়াতে গেলাম একদিন। গাড়ি দূরে রেখে হেঁটেই গ্রাম দেখতে গিয়ে চারপাশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো ময়ূরের ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ক্যামেরা বের করতেই এক ভদ্রমহিলা মাঠের কাজ রেখে আমার কাছে দৌড়ে এসে অনুরোধ করলেন আমি যেন ময়ূরদের বিরক্ত না করি। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো সেদিন। ওই গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ময়ূরেরই নামে। মারাঠি ভাষায় ‘মোর’ অর্থ ময়ূর এবং ‘চিনচ’ অর্থ তেঁতুল, এই নিয়ে ‘মোরাচি চিনচোলি’, অর্থাৎ ময়ূরের জন্যই তেঁতুলগাছ। মনে হলো, ভারতের লক্ষাধিক ময়ূরের অর্ধেকই এখানে বাস করে। এ গ্রামে কোনো কৃত্রিম রাসায়নিক ব্যবহার না করেই উৎপাদিত হয় কৃষিপণ্য। ওখানে সবকিছুই মাঠ থেকে সরাসরি খাবার টেবিলে আসে গ্রামবাসী ও পর্যটকদের জন্য।
আমরা দীর্ঘদিন শুধুই আমাদের বন্য প্রাণী বিলুপ্তির আক্ষেপ পুষে রেখেছিলাম। এদের ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। ময়ূর ফিরিয়ে আনার উদ্যোগটি সে কারণেই প্রশংসার দাবি রাখে। আগামী যেকোনো বর্ষায় আমাদের চিরচেনা ময়ূর প্রকৃতিতে পেখম মেলে নাচবে, আমরা বন্য প্রাণী সুরক্ষার এ উদ্যোগ অব্যাহত রাখব—এ স্বপ্ন তো দেখতেই পারি।
মো.
আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য প র ণ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
হারিয়ে যাওয়া ময়ূর
বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় আইইউসিএন-বাংলাদেশ ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রাণীদের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণের জন্য লাল তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় ১৯ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে উল্লেখ করা হয়। এগুলোর মধ্যে স্থলজ পাখির সংখ্যাই বেশি। ময়ূরও রয়েছে এর মধ্যে।
গত ৩ মার্চ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসে ময়ূর বনে ফিরিয়ে আনার পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের আলোচনা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যদিও দেশ থেকে অনেক বছর আগেই ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বন বিভাগ আমাদের বন ও বন্য প্রাণীর জিম্মাদার। বিভাগটি দীর্ঘদিনের ‘উৎপাদন বনায়নের’ জায়গা থেকে সরে এসে ইদানীং ‘সংরক্ষণ বনায়নের’ অনুশীলন করছে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। ময়ূর বিলুপ্তির অবসান ঘটিয়ে বন বিভাগ ‘সংরক্ষণবিদ’ হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। তবে কিছুটা অনিশ্চয়তা তো থেকেই যায়। যেমন গাজীপুরে যদি ময়ূর অবমুক্ত করা হয়, তবে সেখানকার আবাসস্থলের উপযুক্ততা মূল্যায়ন করা জরুরি। যে পাখিগুলো ছাড়া হবে, তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন করা দরকার এবং যে স্টক থেকে নেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে সেই একই স্টক থেকে আনা যাবে কি না, সেটি যাচাই করে দেখতে হবে। যে এলাকায় অবমুক্ত করা হবে, সেখানকার স্থানীয় জনগণকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ময়ূর ‘ধুলাবালি গোসল’ করে থাকে পালকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং শরীরের বাইরের অংশ পরজীবীমুক্ত রাখতে। তাই এদের বসবাসের এলাকায় বেশ কিছুটা খোলা জায়গা রাখতে হবে।
ভারতবর্ষে ময়ূর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় নৃত্যপরায়ণ পাখি। মোগল সম্রাটেরা ‘মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে’ বসে দীর্ঘ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। সুধীন দাশগুপ্তের লেখা ও সুরে সম্ভবত ১৯৫৯ সালে আশা ভোসলে গাইলেন, ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে, রুম ঝুমা ঝুম নাচরে।’ ময়ূরী কিন্তু নাচে না, প্রজননকালে ময়ূর নাচে তার হেরেমের ২-৫টি ময়ূরীকে আকর্ষণ করার জন্য। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গীত, সুধীন দাশের ‘ময়ূরীকণ্ঠী রাতেরও নীলে আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে’ গানটিও অনেক ভালো লাগার মতো একটি গান। শাহ আবদুল করিমের লেখা ও সুরে ‘ময়ূরপঙ্খি নাও’ গানটিও বহুল শ্রুত একটি গান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলও অবাক বিস্ময়ে জানতে চেয়েছেন, ‘ওরে বনের ময়ূর কোথায় পেলি এমন চিত্রপাখা।’
ময়ূর মানুষের মধ্যে এক অতি অলৌকিক স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়। অনেকের কাছে এটি সত্যের প্রতীক।
আজ থেকে বহু বছর আগে আমি দিল্লি থেকে ট্যাক্সিতে রাজস্থানে যাই। দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে, গাছে ময়ূর দেখেছি। রাজস্থানের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম, সব গাড়ি দুই পাশে থেমে যাচ্ছে ময়ূরের রাস্তা পারাপারের কারণে। রাজস্থানের কৃষিনির্ভর একটি গ্রামের আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা হলো। ঘুম থেকে উঠে অসহ্য গরমে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল এতগুলো ময়ূর একসঙ্গে দেখে—নির্ভয়ে ঘুরছে, গ্রামটি যেন ওদেরই।
এর কয়েক বছর পর মহারাষ্ট্রের পুনেতে যাই বন্ধুদের নিমন্ত্রণে। শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে বেড়াতে গেলাম একদিন। গাড়ি দূরে রেখে হেঁটেই গ্রাম দেখতে গিয়ে চারপাশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো ময়ূরের ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ক্যামেরা বের করতেই এক ভদ্রমহিলা মাঠের কাজ রেখে আমার কাছে দৌড়ে এসে অনুরোধ করলেন আমি যেন ময়ূরদের বিরক্ত না করি। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো সেদিন। ওই গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ময়ূরেরই নামে। মারাঠি ভাষায় ‘মোর’ অর্থ ময়ূর এবং ‘চিনচ’ অর্থ তেঁতুল, এই নিয়ে ‘মোরাচি চিনচোলি’, অর্থাৎ ময়ূরের জন্যই তেঁতুলগাছ। মনে হলো, ভারতের লক্ষাধিক ময়ূরের অর্ধেকই এখানে বাস করে। এ গ্রামে কোনো কৃত্রিম রাসায়নিক ব্যবহার না করেই উৎপাদিত হয় কৃষিপণ্য। ওখানে সবকিছুই মাঠ থেকে সরাসরি খাবার টেবিলে আসে গ্রামবাসী ও পর্যটকদের জন্য।
আমরা দীর্ঘদিন শুধুই আমাদের বন্য প্রাণী বিলুপ্তির আক্ষেপ পুষে রেখেছিলাম। এদের ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। ময়ূর ফিরিয়ে আনার উদ্যোগটি সে কারণেই প্রশংসার দাবি রাখে। আগামী যেকোনো বর্ষায় আমাদের চিরচেনা ময়ূর প্রকৃতিতে পেখম মেলে নাচবে, আমরা বন্য প্রাণী সুরক্ষার এ উদ্যোগ অব্যাহত রাখব—এ স্বপ্ন তো দেখতেই পারি।
মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়