জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে ডাকাতেরও ভয়
Published: 17th, April 2025 GMT
দেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। এই বনের গহিনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর সেই চাক খুঁজে বের করে মধু সংগ্রহ করেন একদল মানুষ। তাঁদের বলা হয় মৌয়াল। মধু আহরণের মৌসুম এলেই দল বেঁধে সুন্দরবনে ছুটে যান তাঁরা।
ঘ্রাণ ও স্বাদ ‘অতুলনীয়’ সুন্দরবনের এই মধু সংগ্রহ করতে ‘জীবনবাজি’ রাখতে হয় মৌয়ালদের। এত দিন শুধু নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয় ছিল। কিন্তু এবার যুক্ত হয়েছে বনদস্যুদের ভয়। মৌয়ালরা বলছেন, কয়েকটি দস্যু দল মৌয়ালদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে।
সুন্দরবনে এখন চলছে মধু সংগ্রহের মৌসুম। গতকাল বুধবার খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় মৌয়াল আকতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাপ-দাদার পেশা হিসেবে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে আসতিছি। প্রতিটি বছর মধু কাটার মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। বনের সাপ, কুমির ও বাঘের ভয়ে কখনো পিছুপা হইনি। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে জঙ্গলের বেশি ভেতরের দিকে যাইনি। তাই মধু একটু কম পাইছি। মঙ্গলবার এলাকায় ফিরে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিছি।’
১ এপ্রিল শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত টানা দুই মাস বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে চলবে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ।
গতকাল সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে ১৭ মণ মধু নিয়ে আজ লোকালয়ে ফিরে এসেছি। আমরা এক নৌকায় ৭ জন ছিলাম। আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না।’
আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না।আবুল কালাম, মৌয়ালপ্রতিবছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যান কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বনজীবী মনিরুল ইসলাম। গতকাল সকালে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয়ের সঙ্গে এবার ডাকাতেরও ভয়। তবে জীবন বাজি রেখে ৮ জনের মৌয়াল দলের সঙ্গে একটি নৌকায় আমিও সুন্দরবনে এসেছি। ভয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি বনে থাকায় মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি। তবে বনের মধ্যে এবার চাকের পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। মধুও ভালোই পাচ্ছি।’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, গত বছর মধু আহরণ থেকে ৫০ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৪ হাজার ৪৬০ জন মৌয়াল ৬৭৫টি নৌকা নিয়ে মধু আহরণে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি নিয়েছেন। সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল।
দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।দস্যুদলের উৎপাত
কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকা থেকে মধু কাটতে যাওয়া কয়েকজন মৌয়াল বলেন, সুন্দরবনে ঢুকতেই তাঁদের দস্যুদল ‘দয়াল বাহিনীকে’ জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ‘দুলাভাই বাহিনী’ নামের আরেক দস্যুদলকে দিতে হয়েছে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। এভাবে কয়েকটি দস্যুদল বনজীবীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে।
জেলে-বাওয়ালিরা বলছেন, এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মামা-ভাগনে বাহিনীসহ কয়েকটি বনদস্যু দল। এসব বাহিনীর হাতে অনেক জেলে ও মৌয়াল মাছ, মধু ও টাকা খোয়াচ্ছে।
এসব দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।
এর আগে ৭ এপ্রিল সুন্দরবনের পুরোনো ঝাপসি ফরেস্ট অফিসসংলগ্ন এলাকায় কোস্টগার্ড সদস্যরা অভিযানে গেলে তাঁদের দেখে ২টি একনলা বন্দুক, ১১টি ফাঁকা কার্তুজ ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম ফেলে পালিয়ে যায় ডাকাত করিম শরীফের বাহিনী।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ইশমাম হাসান ফাহিম বলেন, ‘বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স্থির হতে দিচ্ছি না। একের পর এক অভিযান চলছে। জননিরাপত্তায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
যেভাবে মধু সংগ্রহ
বনের ভেতর অসংখ্য শ্বাসমূল ও বিভিন্ন গাছের কাঁটা থাকে। এসব যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন মৌয়ালরা। নিজেরা প্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নিতে হয় দা, বড় ড্রাম, বড় পাত্র ও মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচার জন্য মুখে দেওয়ার নেট জাল ও গামছা।
নৌকা থেকে বনে নেমেই মৌয়ালরা ভাগ হয়ে ২০-২৫ হাত দূরত্ব রেখে মৌচাক খুঁজতে বনে হাঁটতে শুরু করেন। ঘন জঙ্গলে কেউ যাতে দলছুট না হয়ে পড়েন, সে জন্য একটু পরপর শব্দ করা হয়। সেই শব্দ শুনে পাল্টা শব্দের মাধ্যমে বাকিরা তাঁদের অবস্থান জানান দেন। এভাবে চাক খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বনের ভেতর হাঁটতে থাকেন তাঁরা। মৌচাক খুঁজে পেলেই সবাই একত্র হয়ে শুরু হয় চাক কাটার প্রস্তুতি। চাক কাটার জন্য একজন নির্দিষ্ট গাছি থাকেন, যিনি গাছে উঠে চাক কাটেন।
বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স্থির হতে দিচ্ছি না। একের পর এক অভিযান চলছে।লেফটেন্যান্ট ইশমাম হাসান ফাহিম, কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাচাক কাটার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল একটি বিষয়। প্রথমে ধোঁয়া তৈরির জন্য শুকনা পাতা জোগাড় করে মৌয়ালদের দক্ষ হাতে শুরু হয় ‘কাড়ু’ তৈরির কাজ। হুদো নামের একধরনের লম্বাটে শুকনা গাছ আর তার চারপাশে কাঁচা গোলপাতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় কাড়ু। মূলত এই কাঁচা ডালপালা দিতে হয় ধোঁয়া তৈরির জন্য।
মুখে গামছা বা নেট জাল বেঁধে হাতে দা ও কাড়ু নিয়ে মধু সংরক্ষণের জন্য ড্রামসহ গাছের ওপর উঠতে হয়। তারপর মৌমাছি তাড়ানোর জন্য কাড়ুটা মৌচাকের কাছাকাছি ডালের সঙ্গে বেঁধে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানো হয়। আস্তে আস্তে মৌমাছি চলে গেলে মধুর চাক দৃশ্যমান হয়। পুরো চাকের তিন ভাগের মাত্র এক ভাগে থাকে মধু। মধু রাখার ড্রামটি মৌচাকের নিচে ধরে দা দিয়ে মধুর অংশটা কাটতেই মধুসমেত চাকটি পড়ে ড্রামের মধ্যে।
এরপর কাড়ু আর মধুর পাতিল নিয়ে গাছি বাকি সদস্যদের কাছে চলে আসে। বাকিদের মধ্যে একজনের দায়িত্ব থাকে মোমসহ চাক চেপে মধু ও মোম আলাদা করা। মধু পাত্রে রাখা হয়। এরপর আবার শুরু হয় নতুন চাক খোঁজা। এভাবেই সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল স ন দরবন স ন দরবন র ক ইন ট ল বন ব ভ গ বনদস য র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরের জুলাই–মার্চে পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মাসে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ; যা আগের পাঁচ অর্থবছরের একই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ দিকে টাকা খরচের দিক থেকে এবারের এডিপি বেশ পিছিয়ে আছে। গতবারের একই সময়ের (জুলাই-মার্চ) চেয়ে এবার ২৪ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। এবার জুলাই-মার্চ সময়ে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গতবার একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
আজ বৃহস্পতিবার চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের হালনাগাদ চিত্র প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন; ক্ষমতার পটপরিবর্তন এবং ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের খুঁজে না পাওয়া—সবকিছুর প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।
চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হয়েছে। পরে এডিপি কাটছাঁট করে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।
যাদের বাস্তবায়ন হার ২৫%-এর কম
চলতি অর্থবছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের দুটি প্রকল্পে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। কিন্তু ৯ মাসে এক টাকাও খরচ হয়নি। দুনীতি দমন কমিশনের এডিপি বাস্তবায়নের হার শূন্য।
এ ছাড়া এডিপিতে সব মিলিয়ে ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আছে, যারা অর্থবছরের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের বরাদ্দের ২৫ শতাংশও খরচ করতে পারেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ; প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়; স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ; জননিরাপত্তা বিভাগ; প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিভাগ; ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়; ভূমি মন্ত্রণালয়; নির্বাচন কমিশন সচিবালয়; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়; অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ; বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন।