নববর্ষের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মাসুদ-তাকাসুরের ঘরে আসে প্রথম সন্তান
Published: 16th, April 2025 GMT
পুব আকাশে রক্তিম আলোয় ফুটে ওঠে বছরের প্রথম সূর্য। ১৪ এপ্রিল। সোমবার। বৈশাখের প্রথম সকাল। ৬টা ২৫ মিনিট। ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের করিডোর তখন দম বন্ধ করা নীরবতা। কোথাও এক ফোঁটা হাসির ছাপ নেই– শুধুই উদ্বিগ্নতা। এ এক দারুণ নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ভেসে আসে নতুন এক প্রজন্ম আগমন বার্তা।
ফেনীর জাহিদুল ইসলাম মাসুদ ও বিবি তাকাসুর দম্পতির ঘর আলোকিত করে আগমন ঘটে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তানের। নতুন বছরের প্রথম দিনের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দম্পতির কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান। এই আনন্দে নিস্তব্ধতা ভাঙে আশপাশের। শিশুর জন্মের খবরে আনন্দিত ও উদ্বেলিত হয়ে পড়েন সবাই। মা-বাবা-চাচা, দাদা-দাদি, নানিসহ পুরো পরিবারে আনন্দ বিরাজ করে। নতুন অতিথির আগমনে আনন্দ অশ্রু মুছতে মুছতে যেন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন সন্তানের মা বিবি তাকসুর ও বাবা জাহিদুল ইসলাম মাসুদ।
পৃথিবীর আলোয় এসেছে ফুটফুটে এই শিশু। হাসপাতালের বেডের পাশেই জড়ো হয়েছিলেন আত্মীয় স্বজনরা। তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, ‘সোনাগাজী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চরগণেশ এলাকার বাসিন্দা আমরা। রোববার গভীর রাতে প্রসব ব্যথা শুরু হয়। এত রাতে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবার পরামর্শে প্রথমে পারিবারিকভাবে প্রসবের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনো সুফল না পাওয়ায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাকসুরের প্রসব ব্যথা আরও বাড়তে থাকে। এখন হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এত রাতে কিছু পাওয়াও মুশকিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশার ব্যবস্থা হলো। তাঁকে দ্রুত ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়।’
বৈশাখী ছুটির কারণে হাসপাতালে সাধারণ মানুষের আনাগোনা কম। শান্ত পরিবেশে আমাদের অশান্ত যাত্রা দেখে চিকিৎসক, নার্সরা তৎপর হন। রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক তথ্য নেন।
তারা জানান, ১৬-২৯ এপ্রিল প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল। কিন্তু হঠাৎ গভীর রাতে প্রসব ব্যথা শুরু হয়। পরে আমরা এখানে নিয়ে আসি–এমন তথ্য জানালে ডাক্তার প্রসূতি মাকে দ্রুত হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
একে একে আত্মীয়স্বজনরা হাসপাতালে আসতে শুরু করেন। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। প্রায় ৩০ মিনিট পর একজন নার্স ছুটে আসেন। জানান, তাকসুরের ফুটফুটে এক ছেলেসন্তান জন্ম হয়েছে। নরমাল ডেলিভারি। সিজার করার প্রয়োজন হয়নি। সবাই আগ্রহ নিয়ে জানতে চান, মা ও সন্তান কেমন আছে। তিনি জানান, মা ও ছেলে উভয়ই ভালো আছে।
নববর্ষের রঙিন দিনটি যেন আরও রঙিন হয়ে ওঠে। নতুন শিশুর আগমনের খবর শুনে হাসপাতালে আসা স্বজনরা আনন্দে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ আবার হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন নবজাতক শিশু ও মাকে যেন আল্লাহ ভালো রাখেন। কেউ আবার সন্তান জন্মের খবর মুহূর্তেই স্বজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নববর্ষের দিন সন্তান জন্ম হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়ে একসঙ্গে দু’বার মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে হেসে ওঠেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা।
হাসপাতাল থেকে পহেলা বৈশাখের প্রধান অনুষ্ঠান স্থল প্রায় দুই কিলোমিটার। এখানে বৈশাখের নানা আয়োজনের আওয়াজ শোনা না গেলেও, শিশুটিকে পিংক কালার ও হলুদ রংয়ের জামা পরিয়ে দিনটিকে বরণ করেছেন তারা।
হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালে পারিবারিকভাবে সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের চরখোয়াজ গ্রামের বিবি তাকাসুরের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন জাহিদ। বিয়ের তিন বছর পর প্রথম কন্যা এবং পাঁচ বছর পর পুত্রসন্তানের পর এবার হলো দম্পতির তৃতীয় সন্তান। শিশুর নাম এখনও রাখা হয়নি। আলাপ-আলোচনা করে রাখা হবে বলে জানান তারা। জাহিদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। শিশুর মা এসএসসি শেষ করে সংসারজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি একজন গৃহিণী। তাকসুরের বড় মেয়ে সোনাগাজী মো.
সন্তানের দিকে তাকিয়ে মা তাকাসুর বলেন, ‘সবকিছু চিকিৎসকের পরামর্শে চলায় মনে কোনো শঙ্কা ছিল না। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসক-নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেন। বাচ্চা ও আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। নববর্ষের এই দিনে বাচ্চার জন্মগ্রহণ করায় খুব খুশি লাগছে। বাচ্চাকে যেন মানুষের মতো মানুষ করতে পারি।’
পাশেই ছিলেন বাবা জাহিদুল ইসলাম। বলেন, ‘তাকাসুরের প্রসব ব্যথা শুরু হলে একটি অ্যাম্বুলেন্স খোঁজ করি। তা না পেয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করতে চেয়েছিলাম। ড্রাইভার দুই হাজার টাকা ভাড়া চান। তখন আমরা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা যোগে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এসে রোগী ভর্তি করি। শিশু জন্মের সংবাদ শুনে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। এখন খুব আনন্দ লাগছে। নববর্ষের দিনে নতুন আনন্দ যোগ হলো।’
শিশুর চাচা আবদুর রহিম রায়হান বলেন, ‘বাচ্চাকে আমরা মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। সে যেন ডক্টর ইউনূসের মতো উজ্জ্বল মানুষ হয়। আমরা এটাই চাই। সুন্দর হোক নতুন প্রজন্ম, নতুন বাংলাদেশ।’
শিশুর নানি কাউসারা বেগম বলেন, ‘সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর থেকে বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত চিকিৎকের পরামর্শে সব নিয়ম মানা হয়েছে। নতুন বছরে সন্তান জন্ম লাভ করায় খুব খুশি লাগছে।’
ডা. ফারজানা আক্তার বলেন, ‘একটু সময় লাগলেও রোগীর নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। কোনো জটিলতা নেই। মা ও বাচ্চা দুজনই সুস্থ ও ভালো আছেন। নববর্ষের দিন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। সবাই আনন্দিত।’
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স দেলোয়ার বলেন, ‘শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার বাবার কোলে তুলে দিই। শিশুর স্বাস্থ্য ভালো এবং ওজন ছিল তিন হাজার গ্রাম। মায়ের দুধ পাচ্ছে।’
হাসপাতালের উপপরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক) ডা. আবুল খায়ের মিয়াজী বলেন, ‘নববর্ষের প্রথম প্রহরে সন্তান জন্মগ্রহণ করায় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, অভিভাবকসহ সবাই আনন্দিত। এ উপলক্ষে অভিনন্দন বার্তা, উপহার এবং শিশুর জন্মের পর আজান দেওয়া হয় হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থপনায়। গভীর রাতের অন্ধকার পেরিয়ে যেমন আলো আসে, তেমনি উৎকণ্ঠা আর নিস্তব্ধতা পেরিয়ে এসেছে নতুন শিশু। তার সার্বিক মঙ্গল কামনা করেছেন সবাই।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নববর ষ র চ ক ৎসক র প রথম প রথম স জন ম র আনন দ গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
কোলজুড়ে ফুটফুটে শিশু, চোখে আনন্দ অশ্রু
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২; সোমবার সকাল ৯টা। শেরপুর শহরের বেসরকারি একতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার থেকে তোয়ালে মোড়া সদ্যোজাত এক শিশুকে বের করে নিয়ে এলেন চিকিৎসক। নতুন পৃথিবীর নতুন আলোতে তখনও ছেলে শিশুটি ধাতস্ত হতে পারেনি; চোখ পিটপিট করছে তার। সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ধকলে শিশুটির মা জামেনা খাতুন তখনও অচেতন। চিকিৎসক অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষারত বাবা মো. মিজানের হাতে তুলে দিলেন সন্তানকে। তারপর যা হলো, সেটি সত্যি পৃথিবীর সেরা দৃশ্যগুলোর একটি হতে পারে। কাঁদতে কাঁদতে বাবা মিজান চুমু খেলেন সদ্যোজাত সন্তানের তুলতুলে হাতে। ওদিকে আজান দিলেন মিজানের ছোট বোনের স্বামী মো. মাসুদ।
শেরপুর সদর উপজেলার বলাইয়েরচর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রত্যন্ত গ্রাম পাইকারতলার বাসিন্দা মিজান ও জামেনা। জেলার সবজিভান্ডার হিসেবে খ্যাত এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। এর বাইরে রাজমিস্ত্রি ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন অনেক যুবক। শিক্ষায় অনগ্রসর এ গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভালো না। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা না থাকায় যেতে হয় শহরে। ফলে অনেকেই গ্রামের ধাত্রী বা দাই দিয়ে প্রসব করান। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার এ গ্রামে বেশি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান মেম্বার। তবে পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী মিজান সংসারে শত অভাবের মধ্যেও স্ত্রী জামেনার ব্যাপারে ছিলেন সচেতন।
মিজান জানান, রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে দৈনিক ৬০০ টাকা বেতন পান। তাঁর বাবা জালাল উদ্দিনও একই কাজ করেন। বাবা-মাকে নিয়ে তাদের যৌথ পরিবার। সংসারে অভাব অনটন লেগে আছে। তাদের প্রথম সন্তান জোবায়েদের বয়স ৫ বছর। স্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন, তখন নানা অভাব অনটন সত্ত্বেও তাঁকে সর্বোচ্চ যত্নে রেখেছিলেন। প্রত্যন্ত গ্রামে অন্তঃসত্ত্বাদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ খুব কম। তাই স্ত্রীকে শেরপুর নিয়ে নিয়মিত চেকআপ করিয়েছেন। গর্ভধারণের পর টিকাসহ চিকিৎসকের পরামর্শে সব ধরনের চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সীমিত আয় থেকে একটু একটু সঞ্চয় করে সিজারের জন্য টাকা জমিয়েছেন। এসব করতে গিয়ে কষ্ট হয়েছে। এখন সেসব ভুলে গেছেন সন্তানের মুখ দেখে।
মিজান আরও জানান, রোববার রাত ২টার দিকে জামেনা খাতুনের প্রসব বেদনা ওঠে। প্রতিবেশী এক আত্মীয়ের ইজিবাইক ভাড়া করে ফজরের নামাজের সময় স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হন শেরপুরের উদ্দেশে। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন, তাঁর স্বামী ও জ্যাঠাতো ভাইয়ের বউ। প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি যান নারায়ণপুরের একতা হাসপাতালে। ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক সকাল ৯টায় সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করায়।
দুই ছেলেকেই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা পোষণ করে মিজান বলেন, তাঁর স্বপ্ন ওরা দু’জনই ভবিষ্যতে নামকরা আলেম হবে। শিশুর কি নাম রেখেছেন জানতে চাইলে মিজান জানান, তাঁর ছোট ভাই মাদ্রাসার হুজুরের সঙ্গে কথা বলে নাম ঠিক করবেন। বাড়ি যাওয়ার পর নাম রাখা হবে।
মিজানের মা রোকেয়া বেগম সোমবার বিকেলে এসেছিলেন নাতি দেখতে। ফুটফুটে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিলেন, ‘ছেলের চেহারা আমার শ্বশুরের মতো হয়েছে। তিনি খুব ভালো মানুষ আছিলেন। নাতি আমার খুব ভাগ্যবান হবো। বছরের প্রথম দিন জন্ম নিছে। এইডা আল্লাহর রহমত। আল্লাহ ওরে সুস্থ রাখুক এই দোয়া করি।’
সোমবার রাতে কথা হয় জামেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, সোমবার যে বৈশাখের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষ ছিল জানতেন না। জ্ঞান ফেরার পর যখন নার্সের কাছে শুনলেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে তিনি ওই হাসপাতালে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তখন কুব ভালো লেগেছে। মাশাআল্লাহ বলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন।
জামেনা আরও বলেন, অভাবের সংসারে তাঁকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি অনেক যত্নে রেখেছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর কোনো বাড়তি কাজের চাপ দেননি। সময় মতো ডাক্তার দিয়ে চেকআপ করেছেন। সবজির পাশাপাশি কষ্ট হলেও ডিম, দুধ, কলা খেয়েছেন নিয়মিত।
হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবা কবীর স্বপ্না বলেন, মা ও শিশু দু’জনই ভালো আছে। শিশুটির ওজন হয়েছে ৩ কেজি ৭০০ গ্রাম। মায়ের জ্ঞান ফেরার পর শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানো হয়েছে। চারদিন পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।