বউচি খেলায় ঐতিহ্যের স্মৃতি ফিরল চবিতে
Published: 14th, April 2025 GMT
দিনব্যাপী বাহারি আয়োজনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) উদযাপিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ-১৪৩২।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) বৈশাখী শোভাযাত্রা, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা, জাতীয় কাবাডি খেলা, বউচি খেলা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দিনব্যাপী মুখর ছিল চবি ক্যাম্পাস।
এ সব লোকজ খেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্থানীয় জনগণ এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত মানুষদের উৎসুক ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। ভীড় লক্ষ্য করা গেছে দোকানীদের বাহারি পণ্যের মেলায়ও।
আরো পড়ুন:
চবিতে বৈশাখী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে চবিতে বিক্ষোভ
সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণ চত্বরে বৈশাখী শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষ উদযাপন। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের জারুলতলায় এসে শেষ হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষের আলোচনা অনুষ্ঠান।
বলী খেলায় মেতেছেন চবি শিক্ষার্থীরা
নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড.
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু প্রাঙ্গণে দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠিত হয় আকর্ষণীয় বউচি খেলা। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এ খেলায় জমে উঠেছিল দর্শকরা।
দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। বিলুপ্তির পথে বসা ঐতিহ্যবাহী এ খেলা দেখে ব্যাপক উল্লসিত ছিলেন দর্শকরা। নির্দিষ্ট স্থানে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে নিকটবর্তী গাছে উঠেও খেলা উপভোগ করেছিলেন। সকলের চোখমুখ যেন বলছিল- শৈশবের প্রাণের এ খেলা জারি থাকুক সর্বদা।
হাডুডু খেলায় মেতেছেন চবি শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে দুপুর আড়াইটায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা। এতে দুইভাগে ছোট ও বড় বলীরা অংশগ্রহণ করেন।
আজকের আয়োজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এ খেলা উপভোগ করতে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই উপস্থিত হন দর্শকরা। ঘণ্টাব্যাপী চলমান এ খেলায় দর্শকদের হৈ-হুল্লোড় ছিল চোখে পড়ার মত। তবে কিছু দর্শকদের অভিযোগ, খেলায় পেশাদার অন্তত দুজন বলীকে আনতে পারত চবি কর্তৃপক্ষ।
বিকাল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায় শুরু হয় নববর্ষের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন ইভেন্টে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি এতে প্রধান আকর্ষণ ছিল আমন্ত্রিত ব্যান্ড দল ‘সরলা’র পরিবেশনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান রাফি বলেন, “চব্বিশের নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদমুক্ত এবারের বর্ষবরণ সত্যিই ব্যতিক্রম ছিল। এর আগে এত আয়োজন আর এত মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। দিনব্যাপী নানা আয়োজনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বলী খেলা। ঝিমিয়ে পড়া বাংলা নববর্ষকে দারুণভাবে প্রাণবন্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।”
নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, “বলীখেলা বাংলার চিরায়িত লোক ঐতিহ্য। বর্ষবরণে নানা আয়োজনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বলীখেলা বাড়তি আমেজ তৈরি করেছে। বলীখেলা ছাড়াও আমরা শোভাযাত্রা, বউচি খেলা, কাবাডি খেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।”
তিনি বলেন, “চব্বিশের বিপ্লবোত্তর এবারের নববর্ষ সকলের অংশগ্রহণে অনন্য হয়ে উঠেছে। নিজস্ব সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হওয়াই হোক বাংলা নববর্ষের অঙ্গিকার।”
ঢাকা/মিজান/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অন ষ ঠ ন উপ চ র য নববর ষ বর ষ র বল খ ল উদয প
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী উৎসব–ভাবনা কেমন হবে
রুশো, হেগেল ও উৎসব
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সবকিছুকেই আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। উৎসব-ভাবনাকেও নতুনভাবে ভাববার দরকার আছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, যেন আগামিতে প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত লিখতে পারি।
উৎসব সম্পর্কে আমাদের প্রথম পাঠ এই যে ‘জাতীয় উৎসব’ নামের ধারণা বাদ দিতে হবে। এর কারণ আমরা জাতিবাদের যুগ পার হয়ে এসেছি। সেক্যুলার কিংবা ধর্মীয় সব প্রকার জাতিবাদ আমাদের যেভাবে বিভক্ত করে রাখে, বিরোধ তৈরি করে, তাতে বিশ্বব্যবস্থায় শক্তিশালী অবস্থান আদায় করে নেওয়া আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না।
আমরা বাস করছি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে। যারা মার্ক্সের দুই-এক পাতা উল্টিয়ে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক প্রচণ্ড গতিশীল। মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে বাজারের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন প্রবলভাবে উৎসাহিত করে, তেমনি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির প্রণোদনাকেও প্রবলভাবে উৎসাহিত করে।
স্বাধীন ব্যক্তির এই উত্থান ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অ্যাবসার্ড, মার্ক্সের ভাষায় প্রতিক্রিয়াশীল। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশ একটি সমাজে ঘটা শুরু হলে তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিক্রিয়াশীল ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারণাও প্রবল হয়। যাঁরা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, তাঁরা ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এর শেষে যুক্ত ‘প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র’ অধ্যায় পড়ে আসতে পারেন। আমাদের জেনারেশনের বিপ্লবী তরুণদের বিশাল একটি অংশ অকাতরে যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ স্বপ্নের জন্য শহীদ হয়েছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের করুণ ইতিহাস শুনলে মার্ক্স ও এঙ্গেলস আফসোস করতেন।
এটা সেই সময়, যখন পাশাপাশি আমরা প্রবল জাতিবাদীও হয়ে উঠেছিলাম। আমরা মেনে নিতে চাইনি যে ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন আমার অস্তিত্বের অংশ, তেমনি আমাদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ, গ্রহ–নক্ষত্রের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধের ধরনও একান্তই আমাদের। কিন্তু আমরা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধর্মের বিপরীতে স্থাপন করেছি, আবার উল্টো দিকে ধর্মকে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছি। দুই প্রকার জাতিবাদের জন্ম দিয়েছি আমরা। একদিকে সেক্যুলার জাতিবাদ, আর তার বিপরীতে ধর্মীয় জাতিবাদ। এর জন্য আমাদের অতীতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এখনই সাবধান না হলে সামনে আরও মূল্য দিতে হবে।
পুঁজির আত্মস্ফীতি ও বিচলনের জগতে ‘জাতিবাদ’ নয়, আমাদের দরকার নতুন ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে ও ভাবতে শেখা। কেন? যেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় আমরা আমাদের জন্য শক্ত একটা আসন আদায় করে নিতে পারি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের বৈশ্বিকভাবে ভাবার তৌফিক দিয়েছে।
নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাববার অর্থনৈতিক মর্ম হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দ্রুত শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। কিন্তু সেটা রাজনৈতিকভাবে নতুন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক মর্ম হচ্ছে গণসার্বভৌমত্বের (Peoples’s Sovereignty) ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এই আলোকে আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে উৎসব নিয়ে দুয়েকটি কথা পেশ করছি।
উৎসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক তৎপরতাসরকার এবার চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ একসঙ্গে পালন করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করেছে। সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ যখন ঘটে, তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব ব্যক্তিকে তার সামষ্টিক বোধ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে গণ-উৎসব বা যেকোনো সামাজিক মিলনমেলা ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে সামাজিক বা সামষ্টিক বোধ উপলব্ধির শর্ত তৈরি করে। একে অনেকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বলছেন।
কিন্তু জুলাই গণ–অভ্যুত্থান মূলত ছিল ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপের লড়াই। ফলে অন্তর্ভুক্তির নামে যেকোনো প্রকার ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা নীতি হতে পারে না। সেই জন্যই ‘জাতিবাদ’ বা যেকোনো পরিচয়সর্বস্বতা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন, বিচিত্র ও অনেককে নিয়েই আমরা ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হয়ে উঠি। কারণ, বিশ্বসভায় আমরা আমাদের স্থান নিশ্চিত করতে চাই। সেটা রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়।
এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির মূল্য বুঝতে জালাল উদ্দীন খাঁর বিখ্যাত গান মনে পড়ছে—‘এ বিশ্ববাগানে সাঁই নিরঞ্জনে মানুষ দিয়া ফুটাইল ফুল’। আমাদের গণ-উৎসব হবে মানুষের উদ্যাপন। আগামী দুনিয়ায় ‘বিশ্ববাগান’-এর রূপ কেমন হতে পারে, বাংলাদেশে তার রূপ আমাদের হাজির করে জগৎকে নতুন দুনিয়ার আগমনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
শহুরে অভিজাতেরা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ নামে যা গড়ে তুলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে গণবিরোধী। এর নজির পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা শুধু এলিট ও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য প্রদর্শনের জায়গা নয়, শ্রেণি–ধর্ম–লিঙ্গনির্বিশেষে জনগণকে একত্র না করে বরং বিভেদ, পার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে।জাঁ-জাক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ তত্ত্বে ‘চুক্তি’ বা ‘বন্দোবস্ত’–সংক্রান্ত ধারণা আসলে গণ–অভিপ্রায়ের (General will) ধারণার সঙ্গে যুক্ত। গণ–অভিপ্রায় জনগণের ইচ্ছাকে বর্তমান রাখতে পারার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াই গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের ভিত্তি। রুশো শুধু রাজনৈতিক তত্ত্বই দেননি, উৎসব নিয়ে তাঁর তত্ত্বও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উৎসবকে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। সেই তর্ক করতে গিয়ে তিনি এলিট বা অভিজাতদের নাটক-থিয়েটারকে অনুমোদন করেননি। কারণ, তা শ্রেণির বিভেদ বা বিভাজন তৈরি করে। তাই এলিট সংস্কৃতি নয়, দরকার গ্রামীণ মেলা।
সাধারণ মানুষের গণ-উৎসব, জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, যেখানে সব শ্রেণি-ধর্মের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এবং নেবে। এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি বুঝতে পারে, সে ‘সমষ্টির অংশ’, আর এই সামষ্টিক উপলব্ধির চর্চার মধ্য দিয়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা জনগণ অনুমান করতে পারে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও গণ–উৎসব পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
শহুরে অভিজাতেরা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ নামে যা গড়ে তুলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে গণবিরোধী। এর নজির পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা শুধু এলিট ও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য প্রদর্শনের জায়গা নয়, শ্রেণি–ধর্ম–লিঙ্গনির্বিশেষে জনগণকে একত্র না করে বরং বিভেদ, পার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে।
ঋতুকেন্দ্রিক চেতনার প্রত্যাবর্তন ও উপস্থিতি জারি রাখাবাংলার ঐতিহ্যবাহী চৈত্রসংক্রান্তি বা গ্রামীণ মেলা ও উৎসবের সময়কে কখনোই সরলরৈখিক কল্পনা করা হয়নি। সময় আমাদের সংস্কৃতিতে ইংরেজদের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নয়। বাংলায় সময় বা কাল মানে ঋতু, যা বৃত্তের মতো ফিরে ফিরে আসে। ঋতু চক্রাবর্ত, কিন্তু আমরা পশ্চিমা ‘লিনিয়ার’ বা সরলরৈখিক সময়ের ধারণা মুখস্থ করেছি, সেটাকেই অভ্যাস বানিয়েছি। আমরা এখন আর ঋতু বুঝি না, ক্যালেন্ডার বুঝি। এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তার মানে আমরা নববর্ষ করব না, তা নয়; কিন্তু তাকে চৈত্রসংক্রান্তি থেকে আলাদা ভাবব না। কারণ, যে মূহূর্তে চৈত্র শেষ হলো, সেই একই বিন্দুতে নতুন বছরেরও শুরু। তবে এই নতুন কিন্তু ‘নতুন’ নয়। পুরানা ঋতুই বৃত্তের বিন্দুতে ফিরে আসে আবার। আমাদের ভাব ও সংস্কৃতির এই গভীরতা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।
আমরা ভুলে গিয়েছি যে বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলাগুলো তার চরিত্র, আদর্শ ও স্বাভাবিকতার সূত্রেই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ। উৎসব মানে ধর্ম-নির্বিশেষে যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানে ধর্মের ভেদ নেই। কারণ, ধর্মভেদটা কলোনিয়াল ইংরেজের তৈরি এবং আধুনিক জাতিবাদ তাকে আরও প্রবল করেছে। আমরা তাই বিশ্বাস করতে শিখেছি, ধর্মভিত্তিক ‘জাতি’ হয়। তাই মুসলমান একটা জাতি, হিন্দু একটা জাতি ইত্যাদি। এই কলোনিয়াল ভেদবুদ্ধি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।
সংস্কৃতি সরলরৈখিক বা কালকেন্দ্রিক নয়, ঋতুকেন্দ্রিক—এর মানে কী? ঋতুর বৃত্তে শেষ বলে কিছু নেই। প্রতিটি বিন্দু একই সঙ্গে বৃত্তের শেষ এবং আবার একই বৃত্তের শুরুও বটে। ঔপনিবেশিক শাসনের আগে উৎসবের ঋতুকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রবল ও শক্তিশালী। ক্যালেন্ডার ধরে আমরা নববর্ষ পালন করিনি। চিত্রা নক্ষত্রের সৌরযাত্রা অনুসরণ করে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেছি, যা একই সঙ্গে নববর্ষেরও শুরু। তথাকথিত ‘পুরাতন’কে বৈশাখী ঝড়ে ‘আবর্জনা’ জ্ঞান করে উড়িয়ে ফেলে দেওয়া কাজের কথা নয়। ‘আধুনিকতা’র নামে আমরা পাশ্চাত্যকে নির্বিচারে গ্রহণ করতে পারি না।
কৃষি-সংস্কৃতি: প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকৃষি-সংস্কৃতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালনের বিষয়টি বছর শেষ ঘোষণার জন্য নয় কিংবা পরদিন নতুন বছর শুরু হচ্ছে বলে ‘নববর্ষের’ প্রস্তুতিও নয়। দিনটি গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে পালিত হয় মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ রচনার চর্চা হিসেবে। আমরা তো একালে গ্রহ–নক্ষত্রের কথা ভুলে গিয়েছি। সংক্রান্তি মানে কোনো না কোনো গ্রহের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থেকে প্রতি মাসে ঋতুর ক্ষণ উদ্যাপন। তার মানে অন্যান্য মাসেও সংক্রান্তি আছে।
তাহলে চৈত্রসংক্রান্তি হচ্ছে প্রকৃতি ও গ্রহ–নক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ঝালিয়ে নেওয়ার দিন। আমরা জীব হিসেবে বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই, এটা উপলব্ধি করা, জানা এবং সেই উপলব্ধিকে চরিতার্থ করার জন্য নানা আচার, উৎসব ও উদ্যাপন। খাদ্যব্যবস্থা তার অন্যতম দিক। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে বিশেষ বিশেষ খাবার পরিকল্পিতভাবে খাওয়া নিয়ম। এই দিন প্রাণিজ আমিষ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চা রয়েছে: আবাদি ফসল তো আমরা সারা বছরই খাই, চৈত্রসংক্রান্তিতে তাই অনাবাদি শাকসবজি খাওয়াই রীতি। অর্থাৎ চাষের শাকসবজি নয়, বরং কুড়িয়ে এনে চৌদ্দ রকমের শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করতে হয়।
গ্রামের কৃষকের স্মৃতি ও জ্ঞানচর্চার দিবস হিসেবে সবারই প্রায় অলক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে যায়। চৈত্রসংক্রান্তির মহিমা এখানেই। এখনো গ্রামের মানুষ তার জ্ঞান অনুযায়ী যেসব অনাবাদি লতাপাতা-শাকসবজি পাওয়ার কথা ছিল, তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন। আমাদের বাপ-দাদার সময়ে যা দেখেছি কিংবা মায়েরা যেসব শাকসবজি দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি করতেন, তা এখন নেই। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালানকোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদি শাকসবজি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব আছে কি নেই, সেটা জেনে আমাদের কেমন সতর্ক হতে হবে, সেটা নির্ধারণের জন্য হলেও চৈত্রসংক্রান্তি পালন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলার কৃষক নারী চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান-পালান মাঠের আনাচেকানাচে শাক কুড়াতে বের হন। নিয়ম আছে, তাঁকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদি নয় কিন্তু, অনাবাদি। অর্থাৎ রাস্তার ধারে, খেতের আলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। যে শাক–লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে—নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক, এই মৌসুমে যা টিকে থাকে। এই শাক তোলার অধিকার কৃষক নারীর থাকে। তাঁর দেখার বিষয় হচ্ছে, যে শাক তাঁরা খুঁজছেন, সেই শাক গ্রামে আছে কি না। সচ্ছল পরিবারের নারীরা নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশপাশের গরিব নারীদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে, বলা হয় শাক ‘তোলা’, শাক ‘কাটা’ নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে, তেমনই থাকবে।
কৃষক নারী খবর নিতে চান, প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদি, যে অংশ কৃষি-সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব—সেই অনাবাদি প্রকৃতি ঠিক আছে কি না। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদি জায়গায় কৃষক তাঁদের দমন করেছেন, উঠতে দেননি, থাকতে দেননি, কিষানি মেয়ে এই দিন খবর নেন, তাঁরা সব ঠিকঠাক আছে তো?
চৈত্রসংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সূক্ষ্ম জ্ঞানচর্চা। এই জ্ঞান নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীরা ভাগাভাগি করে শেখেন। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। বেশি পাওয়া গেলে আরও ভালো। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে।
চৈত্রসংক্রান্তিতে কৃষক নারীকে খবর নিতে হয়, ‘পুরুষ’ সারা বছর যে ‘চাষ’ করল, তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হালহকিকতের কী দাঁড়াল? ‘চাষ’ করার অর্থ আবাদি ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষিব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে।
এটা তাহলে পরিষ্কার যে সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য ছাড়াও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে চৈত্রসংক্রান্তি বৈষয়িক জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দেহ ও মনের বিচ্ছেদ নয়, ঐক্য উদ্যাপনই চৈত্রের শেষ দিনের উৎসব। সংস্কৃতি এখানে সরাসরি প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
চৈত্রসংক্রান্তি আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের দিকনির্দেশনা দেয়। আমাদের বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন আমরা প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার কর্তব্য কঠোরভাবে পালন করি। যদি অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার নীতিও আমাদের কঠোরভাবে পালন করতে হবে। জীব হিসেবে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে নিজের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে প্রাণ ও প্রকৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন চক্রের অন্তর্গত চালিকা শক্তি হিসেবে বিকশিত করার সক্ষমতা অর্জনের দ্বারাই আমরা বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। মানুষের বিকাশের সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশ ঘটে কিংবা প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশ একই সঙ্গে প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিকাশ হয়ে ওঠা।
একই বৃন্তে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে গেঁথে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে নতুন বিশ্বের স্বপ্ন দেখা এবং নিজেদের অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বের রূপ কেমন হতে পারে, বাংলাদেশে তা চর্চা করে দেখানো।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করুক। আমাদের শক্তি যেন আমরা নিজেরা উপলব্ধি করতে পারি।
ফরহাদ মজহার কবি, লেখক ও চিন্তক
শ্যামলী, ৩১ চৈত্র, ১৪৩১/ ১৩ এপ্রিল ২০২৫
(ছাপা পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম: ঋতুকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক)