বগুড়ায় দই খেলেন ইরানের রাষ্ট্রদূত, ঘুরে দেখলেন খেড়ুয়া মসজিদ
Published: 14th, April 2025 GMT
বাংলা বর্ষবরণের দিনে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলে বসে বগুড়ার প্রসিদ্ধ ও সুস্বাদু দই খেলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি। এ সময় তিনি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বগুড়ার দইয়ের অনন্য স্বাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ইরানে বগুড়ার দই তৈরি এবং সেমাই বাজারজাতকরণেও আগ্রহ প্রকাশ করে আকবরিয়া হোটেল ইরানে দইয়ের ব্যবসা করতে চাইলে সহযোগিতার আশ্বাস দেন রাষ্ট্রদূত।
আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আকবরিয়া হোটেলে অবস্থান করেন ইরানি রাষ্ট্রদূত। হোটেলটিতে মধ্যরাতে মুসাফির ও দরিদ্রদের জন্য খাবার পরিবেশন এবং দরিদ্র শিশুদের নিয়ে ৭৫টি মক্তব পরিচালনাসহ প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হাসান আলী তাঁদের ১১৩ বছরের ব্যবসার অগ্রযাত্রা ও নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন।
ইরানি রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি বলেন, বগুড়ার মানুষের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় তিনি মুগ্ধ ও বিমোহিত। বগুড়ার সুস্বাদু দই তাঁর খুব পছন্দের খাবার। বগুড়ায় এসে প্রসিদ্ধ দইয়ের স্বাদ নিতে পেরে তিনি খুব খুশি। দইয়ের স্বাদ তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
ঐতিহাসিক খেড়ুয়া মসজিদ পরিদর্শনবিকেল সাড়ে চারটার দিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঐতিহাসিক খেড়ুয়া মসজিদ পরিদর্শন করেন মানসুর চাভোশি ও তাঁর স্ত্রী জাহেরা চাভোশি। ঐতিহ্যবাহী এ ধর্মীয় স্থাপনাটির স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হন তাঁরা।
শেরপুর উপজেলার ঐতিহাসিক খেড়ুয়া মসজিদ পরিদর্শন করেন মানসুর চাভোশি ও তাঁর স্ত্রী জাহেরা চাভোশি। আজ সোমবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সময় এখন সত্য অনুধাবনের
বাংলা নববর্ষ বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব। দেশের সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে একই ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলা নববর্ষ। এই উৎসব নিয়ে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, বাংলা নববর্ষ একটা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি। অনুরূপভাবে পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলা হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকরা বলেছিল– বাংলা যথেষ্ট মুসলমানি ভাষা নয়। ফলে বাংলা ভাষাকে মুসলিম বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কবি নজরুল ইসলামের রণসংগীতের ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহা শ্মশান’ অংশের শ্মশানকে গোরস্তান পড়তে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জনতা এমন ধোঁকাবাজি কথায় কান দেয়নি। পূর্ববঙ্গের মানুষ প্রশ্ন করেছে– ভাষার কি কোনো ধর্ম হয়? কিংবা কোনো একটা ভাষায় পূজা অর্চনা করলে সে ভাষা কি অপবিত্র হয়? আরবের পৌত্তলিকদের ভাষা ছিল আরবি। তাতে যদি আরবি মুসলমানদের ভাষা হতে পারে, বাংলা কেন বাঙালি মুসলমানের ভাষা হবে না?
ইরানে নববর্ষের প্রথম দিন হলো নওরোজ। ইরান, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, আফগানিস্তানসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় নওরোজ পালিত হয়। বিগত ৩০০০ বছর ধরে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বরাক সি উপত্যকা ও বলকানে নওরোজ পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর ২১ মার্চ বা তার একদিন আগে-পরে নওরোজ পালিত হয়। প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপিয়ানরা তাদের দিনপঞ্জির প্রথম দিনটিতে ভোজ অনুষ্ঠান উদযাপন করত কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ইতিহাস বলছে, শরৎ ও বসন্তকাল উভয়কালে প্রাচীন ইরানিরা শস্য কাটা এবং বীজ বপনের সূত্রে নওরোজ পালন করত। এভাবেই গড়ে উঠেছিল নববর্ষ পালনের রীতি। ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে মুসলিম বিজয়ের পরও নওরোজ উদযাপন বন্ধ হয়নি। প্রাচীন আব্বাসীয় যুগেও নওরোজকে প্রধান রাজকীয় পার্বণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামকে উৎসর্গিত নওরোজনামা বা নববর্ষ গ্রন্থ বইটিতে নওরোজ পালনের জ্বলজ্বলে ছবি আঁকা হয়েছে।
বাংলা দিনপঞ্জিকে হিন্দুয়ানি মনে করার অন্যতম কারণ বাংলা মাসের নামসমূহ। আমরা জানি, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ১২ বা ১৪ এপ্রিল গৌড়ের নৃপতি শশাঙ্ক প্রথম ‘বঙ্গাব্দ’ শুরু করেন। সংস্কৃত জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’র ওপর ভিত্তি করে এই সাল গণনা শুরু হয়। অনেকে এই মতের সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ্ (১৪৯৪-১৫১৯) বাংলা ও আসাম অঞ্চলে প্রচলিত সৌর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ইসলামী চান্দ্রেয় ক্যালেন্ডার যুক্ত করে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এই দুই মত নিয়ে মতপার্থক্য আছে। মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) খাজনা আদায় সহজতর করার লক্ষ্যে বর্তমান বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। তখন এই ক্যালেন্ডারকে বলা হতো ‘তারিখ-ই-ইলাহি’। ইসলামী চন্দ্র ক্যালেন্ডারের সাথে এখানকার সৌর ক্যালেন্ডারের বড় রকমের পার্থক্য ছিল। যার ফলে স্থানীয় কৃষকদের সাথে খাজনা ও ফসল কাটা নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হত। এই সংকট নিরসনকল্পে আকবরের নির্দেশে তার অর্থমন্ত্রী টোডর মল ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। পরে আকবরের রাজসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লা সিরাজি ফের ইসলামী চান্দ্রেয় মাসের বদলে সৌর ও চান্দ্র বর্ষের মিলন মুহূর্তে নতুন ক্যালেন্ডারে বর্ষ গণনা শুরু হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘ফসলি সন’। ৯৬৩ হিজরিতে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) মোহররম বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখের সাথে এক হয়েছিল। তারপর থেকে বৈশাখ বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। ‘তারিখ-ই ইলাহি’ পঞ্জিকায় প্রতিটি মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল। যা আজকের নাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আকবরের পুত্র শাহজাহান সাত দিনে এক সপ্তাহ চালু করেন। রোববার ছিল সপ্তাহের শুরুর দিন। চৈত্রের শেষ দিন নাগাদ মালিকের সব হিসাবনিকাশ পরিশোধ করতে হতো। সেই দিনে আকবর ‘চৈত্রসংক্রান্তির’ প্রচলন করেন। তার পরের দিন পহেলা বৈশাখ চালু করেন। সে বিষয়ে আজ কোনো দ্বিমত নেই। অন্যদিকে ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ পঞ্জিকা থেকে নক্ষত্রগুলোর নাম নেওয়া হয়। এবং বাংলা বারো মাসের নাম ঠিক করা হয়। সেখানে বিশাখা নক্ষত্রের নামে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ, উত্তরাষঢ়ার নামে আষাঢ়, শ্রাবণার নামে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপদের নামে ভাদ্র, আশ্বিনীর নামে আশ্বিন ইত্যাদি। ফলে বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানি আখ্যা দেওয়া অজ্ঞতা ভিন্ন কিছু নয়।
১৯৫৮ সালে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন ‘বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু আমরা সবাই বাঙালি’ এই চেতনায় ঐক্য গড়ে উঠল। সরকারের অবৈধ ঘোষণাকে প্রতিরোধের জীবন্ত হাতিয়ার হয়ে উঠলেন– বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্যে-দ্রোহে-প্রেমে রবীন্দ্রনাথ মাথার তাজ হয়ে ধরা দিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রথম সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৩ সালে। পরের বছর ঢাকা শহরের রমনার বটমূলে ‘ছায়ানট’ ভোর ৬টায় নববর্ষের অনুষ্ঠানের সূচনা করে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিপুল জনসমাগম সাংবাদিকদের বিস্মিত করে। প্রাদেশিক সরকার নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
বাঙালির অফুরন্ত আবেগ পাকিস্তান সরকারকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। এবং সমস্ত ক্ষোভ রবীন্দ্রনাথের ওপর গিয়ে পড়ে। রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করার চক্রান্ত শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বাজেট অধিবেশন বসে। সেখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের শক্তিশালী উপস্থিতিকে টেনে আনা হয়। সরকারি ও বিরোধী দলের প্রচণ্ড রকম বাগ্বিতণ্ডা বাধে। পাকিস্তানিরা বলেন, পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের নামে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পাকিস্তানে ইসলামী জীবনাদর্শের পরিপন্থি কার্যকলাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। সরকারি দলের এমন বক্তব্য বাংলাদেশের নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের সবুর খান উত্তেজিত হয়ে হাউলিং ইডিয়ট বা বোকার হদ্দ বলে গালি দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর তথ্যমন্ত্রী সাহাব উদ্দিন রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। প্রতিবাদে পূর্ব বাংলা আবার উত্তাল হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাঙালির অন্তরে পাকিস্তানের ধর্মীয় বিদ্বেষের পোড়া মাটিতে যে সবুজ ঘাসের জন্ম হলো তা মুক্তিকামী মানুষকে আরও বেশি প্রতিবাদমুখর করল। তথ্যমন্ত্রীর ঘোষণার বিরুদ্ধে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকরা কলম ধরলেন। মওলানা ভাসানী হুংকার ছাড়লেন– ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য, সাহিত্য, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস ও সংগীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অবদান সর্বজনীন। ইসলাম সত্য সুন্দরের জন্ম ঘোষণা করেছে। এই সত্য ও সুন্দরের পতাকা তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই যারা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে, তারা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন। তাই আমি দেশের মানুষের প্রতি সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’ গণ-আন্দোলনের চাপে সেদিন পাকিস্তান সরকার তাদের ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেয়।
প্রচলিত আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা আছে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈশিষ্ট্য হলো বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের লোকসংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্যের নিদর্শন উপস্থাপিত করা। ইউনেস্কো ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘অমূল্য ভাব সম্পদ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উত্তরাধিকার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই বৈচিত্র্যই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শোভামণ্ডিত করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো ধর্মের জন্য নয় বরং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ফুটে ওঠে এক শোভাযাত্রায়।
বাংলা সংস্কৃতি নষ্ট করে দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিশেষ মহল পরিকল্পিতভাবে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে। যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে কিছু অসাধু রাজনৈতিক দল ও মতের ব্যক্তিবর্গ। এখন সময় সত্য অনুধাবনের।
রিয়াজ মাহমুদ: কবি ও প্রাবন্ধিক