Prothomalo:
2025-04-15@18:53:29 GMT

নববর্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

Published: 14th, April 2025 GMT

বাংলা নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি তার দীর্ঘ যাত্রাপথে বহু বাঁকবদলের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই অর্জনের মাত্রা কখনো অর্থনীতি, কখনো ধর্ম, কখনো রাজনীতিকে আশ্রয় করেছে। ঔপনিবেশিক শোষণের অংশ হয়েছে কখনো, কখনো আবার পরিণত হয়েছে উপনিবেশবিরোধিতারও মুখ্য হাতিয়ারে। ফলে বাংলা নববর্ষ বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক রূপে নিজের অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখতে পারেনি, এটা সত্য। আর এটা তার শক্তিরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর আরেকটি তাত্পর্যপূর্ণ দিক হলো, একটি বৃহৎ মানবমণ্ডলীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের সূত্র যোজনা করা। মানবের মিলনসাধন যেকোনো সংস্কৃতিরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তবু বাংলা নববর্ষ এ ক্ষেত্রে বিশেষত্বমণ্ডিত হয়েছে বৃহত্তর জনপরিসরকে তার বিচিত্র প্রভাবগত শক্তিবলয়ে নিজের আওতাভুক্ত করার সক্ষমতায়, আর আনন্দ-উত্সবের সর্বজনীনতায়।

এই ইতিহাস আমাদের জানা যে বঙ্গাব্দের সূচনা ঘটেছিল ষোলো শতকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে। সৌর ও চান্দ্রবৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সনের প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে মূলত এটি ছিল সৌরসন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পৃথিবীর বহু সন গণনার মতো এর মাস গণনার সঙ্গে প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্য ও কৃষিকর্মের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগ। মাসের নাম নির্ধারণে নক্ষত্রনামের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রেও প্রকৃতির সংযোগ ছিল অনিবার্য। নববর্ষের সূচনাদিনটিকে খাজনা আদায়ের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও বিবেচ্য ছিল কৃষিকাজ ও ফসল উত্পাদনের নিবিড় যোগসূত্র। মধ্যযুগীয় এই ব্যবস্থাটি পারম্পর্য রক্ষা করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল অবধি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা সৃষ্টি করেছিল, সেখানেও নববর্ষের সূচনায় ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের নামে প্রজাদের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়ের একপ্রকার উত্সব আয়োজনের প্রচলন লক্ষণীয়। এ ছাড়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের পটভূমিতে ব্যবসায়ী দোকানদারদের সঙ্গে ক্রেতাদের বাকিতে পণ্য গ্রহণের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এভাবে বাংলা নববর্ষের সূচনাদিনটি বাঙালির অর্থনৈতিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। ধনবানদের আনন্দ উত্সবের প্রাচুর্য ধনহীনদের কতটুকু স্পর্শ করতে পারত, তা নিঃসন্দেহে অনুমান ও গবেষণার বিষয়। তবে কৃষকের মনে নতুন বছর যে কৃষিকাজের উদ্দীপনাসহ নতুন ফসলের স্বপ্ন নিয়ে আসত, তাতে সন্দেহ নেই।

সন গণনার ক্ষেত্রে এটা লক্ষণীয় যে জাগতিক কর্মকাণ্ড সূর্যের আবর্তন তথা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় ক্রিয়াদি চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধিনির্ভর। ফলে বাংলা নববর্ষের এই অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক তাত্পর্যের বাইরে বাঙালি হিন্দু সমাজে একটি ধর্মীয় প্রেরণাও ছিল। তাঁরা পূজা-পার্বণের মাধ্যমে দিনটি উদ্যাপন করেন। এভাবে বাংলা নববর্ষ ধর্মীয় সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে আছে। তবে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-বাঙালি-আদিবাসীনির্বিশেষে সচ্ছলতা সাপেক্ষে নতুন পোশাক পরা কিংবা উন্নত মানের খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে নববর্ষকে উত্সব হিসেবে পালনের বিষয়টিই মুখ্য। এর সঙ্গে রয়েছে লোকসংস্কৃতির প্রসারার্থে বৈশাখী মেলার আয়োজন।

এবার আসি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্নে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্বে বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যখন ঐতিহ্য-অনুসন্ধানী, তখন বাংলা নববর্ষ পালন তার অংশ হয়ে ওঠে। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে এর পরিসর ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যখন পূর্ব বাংলা হিসেবে এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আরেক আধা ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে, তখন প্রথমেই আঘাত আসে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। তখন ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের বাঙালির ঐতিহ্যচেতনা প্রবল হয়ে ওঠে। বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে এই ঐতিহ্যচেতনার গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে তারা বাংলা নববর্ষ পালনকে ব্যাপকভাবে উত্সবমুখর করার অভিপ্রায়ে ওই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। যুক্তফ্রন্ট সরকার পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের শিকার হলে এবং পরে দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি হলে এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিদের নবজাগ্রত জাতীয় চেতনা প্রতিবাদী মনোভাবে উজ্জীবিতই থাকে।

সংস্কৃতির ওপর ঔপনিবেশিক আঘাতের একটি রূপ প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনকে কেন্দ্র করে। তাতে বাঙালি সত্তার প্রতিবাদের যে দেশাত্মবোধক বলয় তৈরি হয়, তারই গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ‘ছায়ানট’ নামের প্রতিষ্ঠানটির (১৯৬১)। বাঙালিত্বের চেতনা তীব্র হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

এর মধ্যে দেশে স্বাধিকার আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার পটভূমিতে বাংলা নববর্ষ পালনে ছায়ানট একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। ১৯৬৭ সালে বাংলা নববর্ষের প্রভাতে রমনার অশ্বত্থমূলে তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে যে ধারার সূচনা করে, তা বাংলাদেশের বাঙালিদের নববর্ষ উদ্যাপনকে নতুন তাত্পর্য দিয়েছে। প্রতিবছর তারা যেমন নিয়মিতভাবে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তেমনি সারা দেশে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের একটি জাতি-ধর্ম-বর্ণনিরপেক্ষ ধারাও প্রবলতর হয়েছে।

বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ সম্প্রতি বেশ সমালোচনার শিকার। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৪০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনা যে রূপটিতে আবির্ভূত হয়েছিল, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ফলে তা রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৬০-এর দশকে ধর্মীয় নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে তা সর্বজনীনতা পায়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী এক পরাশক্তির বিশ্বপরিবেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থার উত্থানের পটভূমিতে এবং একই সময়ে বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচারমুক্ত দ্বিদলীয় শাসনের পরিবেশে একুশ শতকে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আরেকটি পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এসব সত্য স্বীকার করেও ছায়ানট-প্রতিষ্ঠিত বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ছায়ানট পূর্ণতররূপে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বজায় রেখেও উপনিবেশবিরোধী সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য নির্মাণ করে প্রকারান্তরে রাজনৈতিক ভূমিকাই পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে একুশের সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, সেটিও সর্বাংশে উপনিবেশবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন; অর্থাৎ বাংলাদেশের সব মানুষকে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করার ক্ষেত্রে—ভাষা আন্দোলন ও বাংলা নববর্ষ—এই দুটি দিবস অসাধারণ দুটি দৃষ্টান্ত।

লক্ষ করার বিষয়, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক যে পূর্ববঙ্গীয় রেনেসাঁ সংঘটিত হয়, তা বাংলাদেশের বাঙালিদের জাতীয় চেতনাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। বাঙালিত্বের প্রশ্নে কলকাতাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ ভাবধারা থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালিত্বের ধারণা হয়ে ওঠে অনেক উদার। এই ভাবধারা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—সবাইকে একীভূত করে। এই উদারতা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গীয় নববর্ষের পূজা-পার্বণসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাধান্য থেকে বাংলাদেশের নববর্ষ মুক্ত—একান্তভাবেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের আরেকটি অগ্রগতি হয়েছে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের ক্ষেত্রেও। ১৯৬০-এর দশকে ড.

মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে যে সংস্কার কমিটি গঠিত হয়, তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কোন মাস কত দিন হবে, এ বিষয়ে যেমন একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি সংস্কারের ধারাও অব্যাহত থাকে। ষোলো শতকে ইউরোপে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা খ্রিষ্টাব্দকে একটি বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেয়। আমাদের দেশের পঞ্জিকা সংস্কারের লক্ষ্যও ছিল তেমনই এক সমন্বয় সাধন। শহীদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি-গঠিত সংস্কার কমিটি ১৯৯৫ সালে ফাল্গুন মাসকে অধিবর্ষ ধরে বঙ্গাব্দের তারিখ ও খ্রিষ্টাব্দের তারিখের মধ্যে একটি স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করে। ফলে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী প্রতিবছর একই খ্রিষ্টীয় তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গাব্দ ও খ্রিষ্টাব্দের তারিখে গরমিলও হচ্ছে না। ভারতেও এমন একটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সনাতন পঞ্জিকাপ্রণেতা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতার মুখে সেই সংস্কার কার্যকর হতে পারেনি।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারায় বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ দিয়ে। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও এর আবেদন শুধু জাতীয় গণ্ডি ছাপিয়ে গেছে। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর জনসংশ্লিষ্টতা, জনমুখিতা, সাংগঠনিক পরম্পরা, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনিরপেক্ষতা, অংশগ্রহণের সর্বজনীনতা প্রভৃতি বিবেচনায় ইউনেসকো এই স্বীকৃতি দেয়। দেশের চারুশিল্পীরা এর আয়োজনে থাকায় চিন্তার মৌলিকত্বে, বিচিত্র মোটিফের প্রতীকী তাত্পর্যে, বর্ণাঢ্যতায়, লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা দ্রুত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুরো দেশে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, জার্মানিতেও এই শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

১৯৫০-এর দশকের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬০-এর দশকে সূচিত বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান প্রভৃতির উদার ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে যে আমরা কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতির ধর্মীয় আবহ থেকে অগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিতে পেরেছি, সেটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সংস্কৃতির শক্তিমত্তার দিক। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সমাজের কোনো কোনো অংশ থেকে যে কিছু সমালোচনা আসেনি, তা নয়। এ বছরও বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। কিন্তু সত্য এই যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের নববর্ষ উদ্যাপনের গৌরবকে আরও প্রভাববিস্তারী করে তুলেছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে কয়েক বছর ধরে কলকাতার সংস্কৃতকর্মীরা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে ঢাকা এভাবে কলকাতাকে নববর্ষের এই সাংস্কৃতিক উৎসবের পথ দেখিয়েছে।

নিজ নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা করেও বৃহত্তর পরিসরে যদি সবাই যুক্ত হতে না পারি, তাহলে আমাদের জাতীয় ঐক্য ব্যাহত হবে। দেশ বা জাতির অগ্রগতির স্বার্থে সব শ্রেণি–ধর্মের মানবের মিলনের সাংস্কৃতিক সূত্র বজায় রাখা জরুরি। বাংলা নববর্ষ সেই মিলনের পথই আমাদের সামনে এনে দেয়। বাংলাদেশের বাঙালিরাই শুধু নন, এর সঙ্গে যুক্ত হন আদিবাসীরাও। এমন মিলনসূত্র আর কোনো উত্সবে নেই।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নববর ষ র অন ষ ঠ ন র জন ত ক ত ত পর য উপন ব শ ছ য় নট ত র এক হয় ছ ল অ শ হয় আম দ র ত হয় ছ সরক র কলক ত ব যবস র একট

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন বছরে ঘর আলো করে এলো প্রভা

প্রথম কন্যা অরফি আফরিন আভার বয়স সাড়ে ৪ বছর। এর মাঝেই আবার গর্ভবতী হন গৃহিনী মোসা. জুঁই। ৩৭ সপ্তাহের গর্ভবতী ছিলেন। পহেলা বৈশাখের পরে তাঁর সিজার হওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন বছরের শুরুর দিনই ঘর আলো করে দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তার নাম রাখা হয়েছে প্রভা। নবজাতক ও তার মা সুস্থ আছেন।

পারিবারিকভাবে ২০২০ সালে জুঁইয়ের বিয়ে হয় কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। স্বামী আকাশ হোসেন অভি কুষ্টিয়া আদালতে একজন আইনজীবীর সহকারী।

জুঁইয়ের সাথে অভির বিয়ে হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে জন্ম হয় প্রথম কন্যা সন্তানের। সেই মেয়েকে নিয়ে তাদের সুখে দিন কাটছিল। এর মাঝে নববর্ষের দিন নতুন যোগ হয়েছে আরও এক কন্যা সন্তান। এতে ভীষণ খুশি তারা।

কুষ্টিয়া লালন শাহ প্রাইভেট হাসপাতালে গর্ভবেদনা নিয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় ভর্তি হন জুঁই। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম দেন তিনি দ্বিতীয় কন্যা সন্তান। হাসপাতালের চিকিৎসক মোহসিনা হায়দার তাঁর অস্ত্রোপচার করেন। এখন মা ও শিশু হাসপাতালের বরীন্দ্রনাথ কেবিনে আছেন।

জুঁইয়ের স্বামী অভি বলেন, ‘আমাদের বাসা পৌর এলাকার মধ্যে। শ্বশুর বাড়ি কয়েক কিলোমিটার দূরে। সকালে ব্যথা ওঠার পর বাসা থেকে দেড় কিলোমিটারের দূরে লালন শাহ হাসপাতালে এনে ভর্তি করাই। এরপর চিকিৎসক সাড়ে ৮টার দিকে অস্ত্রোপচার করেন। কোন সমস্যা হয়নি।’

প্রায় ৩ কেজি ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া সন্তানকে প্রথম কোলে নেন নানি। এ সময় নানির নিজ হাতে তৈরি করা কাঁথা ও পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয় শিশুটির শরীর। হাসপাতালের পরিচালক হারুন অর রশিদ হিরো নববর্ষের দিনে জন্ম নেওয়া এ শিশুর অভিভাবকদের অভিনন্দন জানান।

জুঁইয়ের স্বামী অভি জানান, তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর তিনি নিয়মিত স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতেন। খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করছেন কি-না সে বিষয়ে খেয়াল রাখতেন। চিকিৎসক মোহসিনা হায়দারকে দেখিয়েছেন বেশ কয়েকবার। স্বাস্থ্যগত কোন সমস্যা ছিল না। জুঁইয়ের বাবার বাড়ি শহরতলির কবরবাড়িয়া এলাকায়। হাসপাতালে জুঁইয়ের আম্মা তার সাথে আছেন দেখাশোনা করার জন্য। বড় মেয়ে আভা আছে তাদের সাথে। নতুন বোন পেয়ে সেও খুব খুশি।

জুঁই বলেন, তাঁর স্বামী আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া মাঝে মধ্যে বালুর ব্যবসা করেন। এ আয় দিয়ে তাদের সংসার চলে। খুব বেশি আয় না হলেও তাদের সংসারে সুখ আছে। কিছুটা আর্থিক সংকট থাকলেও দ্বিতীয় সন্তান পেটে আসার পর কোন সমস্য হয়নি। তাঁর স্বামী নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন। যতটা পেরেছেন ভালো খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়ের পর আবার মেয়ে হওয়াতে খুশি আমরা। এখন ছেলে-মেয়েতে কোন তফাত নেই। সবই সৃষ্টিকর্তার দান। আমরা দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে ভালো মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

এসএসসি পাশ জুঁই মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান। সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও মেয়েদের প্রতি তিনি যত্নশীল। তাদের সব আবদার পূরণ করার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।

জুঁই বলেন, বড় মেয়ের নাম আভা। বাবার নাম অভি, অভি থেকে আভা রাখা হয়েছে। এ কারণে মিল রেখে ছোট মেয়ের নাম রাখা হলো প্রভা। দুই মেয়ের নামই তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে রেখেছেন। বাড়িতে গিয়ে আকিকা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। যাতে মহান আল্লাহ মুছিবত দূর করে দেন। বাড়ির সবাই খুশি। হাসপাতালে কয়েকদিন থাকতে হবে। এখানে সবাই সহযোগিতা করছে। কোন সমস্যা হচ্ছে না।

মেয়েদের নিয়ে কি স্বপ্ন আছে জানতে চাইলে বলেন, ‘সবারই স্বপ্ন থাকে। আমরা নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। লেখাপড়া শেষ করতে পারিনি। মেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর ইচ্ছা আছে। বড় মেয়েকে সবেমাত্র একটি কিন্ডার গার্ডেনে প্লেতে ভর্তি করিয়েছি। সে স্কুলে যায়। আর ছোট মেয়ের যত্ন নেওয়া আমার প্রধান কাজ। বুকের দুধ পান করছে ছোট মেয়ে। মেয়ে যাতে সুস্থ থাকে এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’

জুঁই বলেন, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানকে আরবি শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা আছে। সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বেড়েছে। তাই ছেলে-মেয়েদের সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা বেশি প্রয়োজন।

ডা. মোহসিনা হায়দার বলেন, ‘জুঁই আমার রোগী ছিল। সন্তান পেটে আসার পর বেশ কয়েকবার সে চেকআপের জন্য আসে। পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা ও খাওয়া-দাওয়া করেছে। কোন সমস্যা ছিল না।’

নববর্ষের দিন সিজার করানোর কারণ জানতে চাইলে জুঁইয়ের পরিবার জানায়, পহেলা বৈশাখের দিন সকালে হঠাৎ করেই ব্যথা শুরু হয়। এ জন্য তারা তড়িঘড়ি করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন। চিকিৎসক তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেন। সেখানে অস্ত্রপচার করেন তিনি। এ কারণে নতুন বছরেই তারা নতুন অতিথি পেয়েছেন। এ জন্য সবাই খুশি।

হাসপাতালের নার্স রেবেকা খাতুন বলেন, তিনজন সেবিকা তাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন। নতুন বছরে যারা জন্ম নিয়েছেন নার্সরা তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। শিশুদের কোলে নিয়ে আদর করেছেন। নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছেন তারা।

হাসপাতালে যখন শিশুটির জন্ম হয় তখন তার বাবা কালেক্টটরেট চত্বরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ছিলেন। সকালে শিশুকে একবার দেখে চলে যান অনুষ্ঠানে। পরে আবার আসেন। হাসপাতালের পরিচালক হারুন অর রশিদ হিরো বলেন, পহেলা বৈশাখে তাঁর প্রতিষ্ঠান রোগীদের জন্য বিশেষ সেবা দিয়ে থাকে। এদিন যাদের ঘরে নতুন অতিথি আসে সেই সব পরিবারকে তারা যথাসাধ্য ছাড় দেওয়াসহ অন্যান্য সুবিধা দেন। এছাড়া হাসপাতালের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রথম সন্তানকে চিকিৎসক বানাতে চান মা
  • বৈশাখী মেলায় রঙিন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নববর্ষের আয়োজন
  • ‘এই কন্যা আমার বেহেশতের টিকিট’  
  • জাপানে বিশ্ব প্রদর্শনীর অনন্য সমাবেশে উদ্‌যাপিত হলো বাংলা নববর্ষ
  • আওয়ামী লীগ ৭১ দখলের মতো বাংলা নববর্ষও দখল করে রেখেছিল: শামা ওবায়েদ
  • তোলারাম কলেজে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের বাংলা বর্ষপঞ্জি বিতরণ 
  • সন্তানকে পেয়ে আনন্দাশ্রু বাধ মানছে না তুষার-শান্তা দম্পতির
  • আনন্দের বন্যা বইছে জুলেখার পরিবারে
  • কারও মতামত আমাকে নাড়াতে পারে না, আমি জানি, কে আমি: বাঁধন
  • নতুন বছরে ঘর আলো করে এলো প্রভা