আব্বাই আমার জীবনের গুরু, আমার ওস্তাদ, আমার স্বপ্নদ্রষ্টা ও পথপ্রদর্শক। আমার জীবনের কথা বলতে গেলে আসলে তাঁর কথাই বলতে হবে। আমার আব্বা-মা যেমন আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন, তেমনি কীভাবে এখানে জীবন যাপন করব, তাঁরাই সেসব বিষয় শিখিয়ে দিয়েছেন এবং তৈরি করেছেন আমাকে। একটা সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবন হতে পারত আমার। কিন্তু না, আব্বা তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মীর্না মা আর সবার চেয়ে আলাদা হবে। তার নিজস্ব পরিচয় হবে। সে স্বাবলম্বী হবে। বাংলা সংগীতকে সে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে। ভালো মানুষ হবে সে। আরও কত স্বপ্ন ছিল তাঁর। আব্বা আমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি কিংবা পারিনি, সেটা আমার শ্রোতা-পাঠকেরাই বলতে পারবেন। পাঠক, আমি আমার আব্বাকে স্মরণ করেই আমার জীবনের অতি সাধারণ ও ছোটখাটো কিছু ঘটনা বা দৃশ্যের কথা যা আমার মনে আছে, তা আপনাদের কাছে বলার চেষ্টা করছি।

শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ কোন মাপের শিল্পী ছিলেন, কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, কত হাজার গান রেকর্ড করেছেন, মানুষের হৃদয়কে তাঁর কণ্ঠ আর গান দিয়ে ছুঁতে পেরেছিলেন কিংবা তিনি কি সফল হয়েছিলেন, নাকি নিছকই একজন গায়ক ছিলেন নাকি তাঁর অসংখ্য গান দিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন? তিনি সত্যিকার অর্থে বাঙালিদের, বিশেষ করে নজরুলের সঙ্গে মুসলমান বাঙালিদের সংগীত দিয়ে জাগাতে পেরেছিলেন কি না, এসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের মূল্যায়ন করবেন আব্বাসউদ্দীনের শ্রোতারা, দেশের আপামর জনসাধারণ। যাঁরা এখনো তাঁর গান শুনলে মুগ্ধ হন, তাঁরা।

আমি বলছি আমার আব্বা আব্বাসউদ্দীনের কথা। তাঁর সন্তান হিসেবে তাঁকে আমি অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। সব সন্তানের কাছেই তাদের মা–বাবা শ্রেষ্ঠ। কিছুদিন আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম, ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে ছোট্ট দুটো হাত আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলছে, ‘মাই ফাদার ইজ গ্রেটেস্ট কিংবা মাই ফাদার স্ট্রংগেস্ট।’ আর দশটা সন্তানের মতো আমারও ইচ্ছা করে চিত্কার করে বলি, মাই ফাদার ইজ দ্য বেস্ট। কিন্তু সত্যিই কি তা–ই? কেন? কেন তিনি বেস্ট? এ জন্যই কি তিনি মস্ত বড় শিল্পী ছিলেন? সবাই তাঁকে চেনেন এবং দেশপ্রেমিক বলে জানেন। না, ওসব তো কখনো ছোটবেলায় উপলব্ধি করিনি। শুধু তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর অশেষ স্নেহ-মমতা পেয়েছি। প্রতিটি কাজে তাঁর সাহচর্য ও সাহায্য পেয়েছি।

সন্তানের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হলো ‘বন্ধুত্ব’। সেটা দিয়েছেন আব্বা; অন্তত যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। হ্যাঁ, আরও বন্ধুবান্ধব যে ছিল না আমার, তা নয়। কিন্তু আব্বার সঙ্গে সব-সব-সব কথা অকপট বলতে পারতাম। আর আমার আব্বা? সবচেয়ে ভালো বন্ধুর মতো মন দিয়ে শুনতেন এবং মজার মজার মন্তব্য করতেন। মন খারাপ থাকলে মন ভালো করে দিতেন।

আজকাল কজন মা–বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানকে অনেক সময় দিতে পারেন? আপনারা বলবেন, এই ব্যস্ততার মধ্যে সন্তানদের বেশি সময় দিতে পারি না। কিন্তু আমার আব্বাও তো প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। চাকরি, গান, অসংখ্য অনুষ্ঠানে ছুটে যাওয়া ইত্যাদি সবই ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনে। কিন্তু এসবের মধ্যেও আমাদের জন্য তাঁর সময়ের কমতি ছিল না। স্কুল থেকে ফিরে তাঁকে বলতে হতো, কী হলো স্কুলে, মজার কিছু ঘটল কি না। সেসব তিনি শুনতেন। দেখতাম, তিনি রীতিমতো সবকিছু উপভোগ করছেন। কলেজ থেকে ফিরলেও একই ব্যাপার। তারপর গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব সময় তাঁর কাছ থেকে একই রকম উত্সাহ ও সময় পেয়েছি।

আব্বা সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের হয়তো বলে গেছেন, ‘মাগো, তোমরা পড়াশোনা করো, আমরা একটা সিনেমা দেখে আসি।’ পরদিন হয়তো আমাকে আর তাতাকে পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সেই সিনেমা দেখতে।

যে সময় বয়ঃসন্ধিকাল, সেই সময়ই সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব পেয়েছি আব্বার কাছে। সব কথাই আব্বার কাছে না বলা পর্যন্ত শান্তি পেতাম না। আব্বাও খুব ধৈর্য ধরে শুনে বুঝতেন আমার মনের সব-সব কষ্ট-বেদনা। মিষ্টি করে বুঝিয়ে তা দূর করে দিতেন।

আব্বা সত্যিই তাঁর সন্তানদের ভীষণ ভালোবাসতেন। সন্তানদের প্রতিটি ব্যাপারেই তাঁর প্রখর নজর ছিল। আমাদের খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো, মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে গিয়ে বেড়িয়ে আসা—সব দিকেই তাঁর খেয়াল ছিল। বিদেশি কোনো শিল্পী এলে তাঁদের চট্টগ্রাম, সিলেট, দার্জিলিং—এসব জায়গায় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া-আসা সবই করতেন। মনে পড়ে, আব্বার সঙ্গে ম্যাজিশিয়ান পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখতে যাওয়ার কথা; মনে পড়ে, একজন নামকরা রাশিয়ান জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখাতে যাওয়ার কথা; বাড়িতে উপমহাদেশের নামকরা সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে আনার কথা; কলকাতায় উপমহাদেশের বিরাট ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর সঙ্গে আলাপ করতে নিয়ে যাওয়ার কথা; মনে পড়ে, কলকাতায় নামকরা কমলা সার্কাসে সার্কাস দেখতে যাওয়ার কথা।

ফুল কার না ভালো লাগে? কে না ফুল ভালোবাসে? কিন্তু কজন ভালোবাসে ফুল ফোটাতে? নিজের হাতে বাগান করতে? সকাল-বিকেল গাছে পানি দিতে? আমার আব্বাকে এটাই করতে দেখেছি। সকালবেলা উঠেই দেখতেন কোন ফুলের কোন কলিটি ফুটল। কোন গাছটার গোড়া পরিষ্কার করতে হবে। শুধু কি ফুলের গাছ? আমাদের পুরানা পল্টনের বাড়ির ভেতর দিকে অনেকখানি জায়গা ছিল। সেখানে আব্বা সবজি, তরকারির বাগান করতেন। টমেটো ধরলে সবাইকে সেটা কেটে খাওয়াতেন।

একটা মজার গল্প বলি। একদিন বিকেলে আব্বা বাগানে লুঙ্গি পরে কাজ করছিলেন। এমন সময় এক বিদেশি ভদ্রলোক এসে আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলে আব্বা মেহমানকে সসম্মান ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরই তিনি ধোপদুরস্ত হয়ে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, যা আব্বার খুব প্রিয় পোশাক ছিল, তা পরে সাহেবের সামনে আসতেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন যে একটু আগে বাগানে যিনি মালির কাজ করছিলেন, তিনিই স্বনামধন্য আব্বাসউদ্দীন। ভদ্রলোক সত্যিই অবাক হয়েছিলেন সেদিন।

আপনাদের যদি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের স্ত্রীকে কতখানি ভালোবাসেন? হয়তো অবাক হবেন যে এ আবার কেমন প্রশ্ন? হয়তো অনেকেই বলবেন, ‘বউকে তো ভালোবাসিই। এ আবার জাহির করতে হবে নাকি?’ কেন বলছি এ কথা? দেখেছি, মায়ের প্রতি আব্বার যে ভালোবাসা, তার কোনো তুলনাই হয় না। আমার মায়ের নাম লুত্ফুন্নেসা খাতুন। আব্বা আদর করে ডাকতেন ‘আলেয়া’ বলে। স্ত্রীকে যে কতখানি সম্মান করা যায়, করতে হয়, আব্বাকে তা করতে দেখেছি এবং দেখে অবাক হয়েছি। এমন কোনো কাজ নেই, যা মাকে না বলে করেছেন। সব কথা মাকে জিজ্ঞেস করতেন। ‘আলেয়া, তুমি কী বলো?’

মায়ের প্রতি আব্বার যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, তা বুঝতে পেরেছি মায়ের কাছে লেখা আব্বার কতগুলো চিঠিতে। আব্বা তখন কলকাতায়। মা দাদার বাসায় বলরামপুরে থাকতেন। ‘প্রাণের আলেয়া’কে তাঁর লেখা চিঠিগুলো পড়ার মতো। যদি কখনো সুযোগ হয়, ওগুলো ছাপিয়ে দেব। তখন আপনারাও বুঝতে পারবেন স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার গভীরতা। তবে হ্যাঁ, দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য যে কখনো হয়নি, তা বলব না। কিন্তু সন্তানদের সামনে কখনো তাঁদের ঝগড়া করতে দেখিনি। দরজা বন্ধ করে যা বোঝাপড়া করার তা করে নিয়ে দেখতাম, আব্বা মাকে রিকশায় নিয়ে চলে গেলেন বেড়াতে। কিংবা সিনেমা দেখতে।

আব্বা সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের হয়তো বলে গেছেন, ‘মাগো, তোমরা পড়াশোনা করো, আমরা একটা সিনেমা দেখে আসি।’ পরদিন হয়তো আমাকে আর তাতাকে পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সেই সিনেমা দেখতে। ছবিতে গান ভালো হলে সেই ছবি আব্বা তিনবার-চারবার দেখতেন। আমাকেও সঙ্গে নিতেন। আমাদের ছোটবেলায় সুচিত্রা-উত্তম ছিলেন নামকরা নায়ক-নায়িকা। আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন আব্বার ভীষণ প্রিয় শিল্পী। তাঁর রেকর্ড বাজারে এলেই কিনে নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে গান শিখে ফেলতে বলতেন। পরে আবার তাঁকে সেই গান গেয়ে শোনাতে হতো। হুবহু না তুললে আবার দেখে নিতে বলতেন।

হ্যাঁ, আমার গানের কথায় চলে এসেছি, তা–ই না? এ ব্যাপারে অবশ্য লেখালেখি করেছি। আব্বা তাঁর মেয়েকে শিল্পী বানাবেন, সেটা তাঁরই স্বপ্ন ছিল। একটিমাত্র মেয়ে; তাকে কী করলে যে সম্পূর্ণ একটা মানুষ এবং একজন গুণী কণ্ঠশিল্পী হবে, তা ছিল তাঁরই সাধনা। সেই সাধনা, সেই স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি কি না, জানি না বা কতটুকু পেরেছি, সেটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। শুধু আমাকে নয়, আমাদের তিন ভাইবোনকেই তিনি মনের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছেন। সে জন্যই হয়তো আমাদের সব ভালো-মন্দের দিকে খেয়াল রেখেছেন।

কজন মা–বাবা এখন তা করেন? টিউশন বা কোচিংয়ে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করি আমরা। কিন্তু আব্বা? নিজের হাতে বড় বড় খাতা বানিয়ে তাতে প্রতিটি ইংরেজি শব্দের মানে মুখস্থ করতে বলতেন আমাকে, যাতে আমার ইংরেজিটা ভালো হয়। ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্ট স্কুলে আমাকে ভর্তি করালেন, যেটা ওই সময় ঢাকার সবচেয়ে ভালো স্কুল ছিল এবং সত্যিই আমি তিন মাসের মধ্যে উঁচু ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম। এ–ই ছিলেন আমার আব্বা। আমি প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো করলে দেখতাম তাঁর আনন্দ। সব কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীকে বলতেন তাঁর মেয়ের সাফল্যের কথা।

খেতে কে না ভালোবাসে! আমরা সবাই খেতে ভালোবাসি। আব্বা ভালোবাসতেন সবাইকে খাওয়াতে। ভালোবাসতেন বাজার করতে। প্রচুর বাজার করতেন। সবচেয়ে নতুন সবজিটা, সবচেয়ে বড় মাছটা আনতেন বাড়িতে। সে সময় ফ্রিজ ছিল না। তাই মা হিমশিম খেতেন এসব মাছ-সবজি টাটকা রাখতে। বাজার করে হয়তো ফোন করে দিলেন কবি গোলাম মোস্তফা চাচার পরিবারকে কিংবা জসীমউদ্​দীন চাচা আর তাঁর পরিবারকে। সবাইকে নিয়ে হইচই করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন আব্বা।

আব্বা ট্যুরে যেতেন প্রায়ই ঢাকার বাইরে। যেখানে যেটা ভালো, সেই খাবার নিয়ে আসতেন। সিলেট থেকে কমলা, দিনাজপুর থেকে আম–লিচু, চট্টগ্রাম থেকে আব্বার প্রিয় শুঁটকি মাছ। এখানকার চমচম, ওখানকার দই, সেখানকার মিষ্টি, সন্দেশ ইত্যাদি। আব্বা ট্যুর থেকে এলে তাই আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। আর হাঁড়ি ভরে যেসব খাবার আসত, তা দিয়ে-থুয়ে খাওয়া হতো। 

আব্বা প্রতিনিয়ত আমাদের নানান ছলে নানাভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মনে আছে, প্রায় ৬৫ বছর আগে, তখন আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে একটা বাড়িতে থাকতাম। আমি তখন পাশেই কনভেন্ট স্কুলে আর ভাই সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে পড়ে। আমরা দুই ভাই–বোনই তখন রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ গান করি নিয়মিত এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আমরা ১০ টাকা পাই। সেই টাকা আব্বা আমাদের নামে ব্যাংকে রাখতেন।

হঠাৎ একদিন আব্বা আমাদের দুই ভাই–বোনকে ডেকে দুজনকে ১০ টাকা করে দিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমাদের যা ভালো লাগে, কিনে নাও।’ তখনকার ১০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। সে সময় সদরঘাট, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর ও নবাবপুর ছিল বাজার এলাকা। আমরা দুই ভাই–বোন খুব খুশিমনে রওনা দিলাম বাজার করতে। চষে বেড়ালাম সব চেনা-অচেনা দোকান এবং ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলাম। এসে দেখি, আব্বা অধীর আগ্রহে বসে আছেন আমরা কী কেনাকাটা করলাম, তা দেখার জন্য। দুজনকেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী কিনলাম আমরা। আব্বাকে অবাক করে দিয়ে আমরা দুজনই তাঁকে টাকা ফেরত দিলাম। আব্বা তো অবাক এ–ই ভেবে যে কেন আমরা কিছুই কিনলাম না। আমাদের একটাই উত্তর ছিল যে আমাদের তো সবকিছুই আছে, তাই কিছুই কেনার ছিল না। আব্বা হয়তো এটা ভেবেই আনন্দিত হলেন যে তাঁর সন্তানেরা কত অল্পতেই সন্তুষ্ট। তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। আমি এখন ভাবি, এখন যদি কোনো ছোট শিশুর হাতে হাজার টাকাও দেওয়া হয়, তাহলে তারা সেই টাকা খরচ করে ফেলবে। কারণ, তাদের অনেক থাকলেও তাদের আরও অনেক চাই।

শিল্পীরা যে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হন, এটা আমরা সবাই জানি। তাঁরা নিজের সাফল্য ছাড়া আর কারও কথা ভাবেন না। কে কাকে টেক্কা দেবেন, এটাই সবার ভাবনা। আব্বাকে দেখতাম উল্টোটা। নিজে তো বিরাট শিল্পী। প্রথমে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, তারপর নজরুলের বিভিন্ন ধরনের গান; বিশেষ করে ইসলামি গান, যা পুরো দেশের ঘুমন্ত মুসলমানকে জাগিয়ে তুলেছে। তারপর পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকা, জারি, সারি, মুর্শিদিসহ সব ধরনের গান তিনি গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এনে শহরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন এবং শ্রোতারা তা ভীষণভাবে গ্রহণ করল। কিন্তু তিনি একা গেয়েই ক্ষান্ত হননি। গ্রাম থেকে আরও প্রতিভাবান শিল্পীকে কলকাতায় এনে তাঁদের কণ্ঠে সেসব গান রেকর্ড করালেন। কারও মধ্যে সামান্যতম প্রতিভা দেখলেই তাঁকে উত্সাহে ভরিয়ে দিতেন আব্বা। এ প্রসঙ্গে সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দীন, আবদুল আলীম, আবদুল লতিফসহ বহু শিল্পীর নাম করা যেতে পারে। যাঁরা আব্বার কাছে উত্সাহ পেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ রকম আরও বহু গুণের কথা আব্বার সম্পর্কে বলতে পারি। সেসব সম্পর্কে আগেও লিখেছি এবং বলেছি।

বাংলার বুলবুল, পল্লিসম্রাট, জনদরদি শিল্পী, সমাজসচেতন শিল্পী ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত আব্বাসউদ্দীনের কথা লিখলাম না। লিখলাম শুধু আমার আব্বার কথা যা এই মুহূর্তে মনে হলো যে আগে বলা হয়নি। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন নয়, মানুষ আব্বাসউদ্দীন আমার প্রাণপ্রিয় আব্বা।

আমার এই লেখা পড়লে দেখবেন বারবার আমার আব্বার কথা আসবে। তিনি আমার জীবনের সঙ্গে এত বেশি গভীরভাবে জড়িয়ে আছেন যে এখনো আমার চিন্তাভাবনা ও
দৈনন্দিন জীবনে তাঁকে যেন আমি অনুসরণ করি। তিনি যেন আমার সঙ্গে কথা বলেন। পরামর্শ দেন। হাসেন। মজা করেন। সাহস ও শক্তি দেন। অনুপ্রেরণাও দেন তিনি। সত্যি বলতে কি, আব্বা আমার জীবনকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন, সে বিষয়ে আমার কোনো ভাবনা ছিল না। যখন আমি আমার জীবনকে খেয়াল করলাম, দেখলাম, আব্বাই আমার জীবন গড়ে দিয়েছেন। আমি তেমন কিছুই করিনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স কর ব জ র কর অন ষ ঠ ন কলক ত য় কর ছ ন ন আম র আম দ র বলত ন ন করত ন মকর র করত করত ন সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

টানা তিন জয়ে বিশ্বকাপের আরও কাছে বাংলাদেশ

১০১, ৫১ রানের পর অপরাজিত ৮৩। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা অধিনায়ক নিগার সুলতানা ব্যাটিং–ঝলক দেখিয়েই চলেছেন। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে আজ নিগারের আগে ফিফটি করেছিলেন ফারজানা হক ও শারমিন আক্তার। তাতে বাংলাদেশ নারী দল ৬ উইকেট হারিয়ে তুলেছিল ২৭৬ রান, যা তাদের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ

বাংলাদেশের বোলিং শক্তিমত্তা বিবেচনায় এই রান তাড়া করে জিততে হলে স্কটল্যান্ড নারী দলকে অভাবনীয় কিছু করতে হতো। কিন্তু বল হাতে নাহিদা আক্তার, রাবেয়া খান, জান্নাতুল ফেরদৌসরা নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করায় লক্ষ্যের ধারেকাছেও যেতে পারল না স্কটিশ মেয়েরা; ৯ উইকেট হারিয়ে থামতে হলো ২৪২ রানে। ৩৪ রানের অনায়াস জয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার আরও কাছে পৌঁছে গেল বাংলাদেশ দল।

মেয়েদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে এটি বাংলাদেশের টানা তৃতীয় জয়। গত বৃহস্পতিবার প্রথম ম্যাচে থাইল্যান্ডকে ১৭৮ রানে হারিয়েছে নিগারের দল, যা নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে রানের হিসেবে সবচেয়ে বড় জয়। নিগারের সেঞ্চুরিতে সেই ম্যাচেই নিজেদের দলীয় সর্বোচ্চ ২৭১ রান করেছিল বাংলাদেশ।

পাঁচদিনের ব্যবধানে সেটিকে ছাড়িয়ে আজ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে লাল–সবুজের প্রতিনিধিরা করল ২৭৬ রান। মাঝে গত রোববার রিতু মনির ক্যারিয়ারসেরা ব্যাটিংয়ে আয়ারল্যান্ড মেয়েদের বিপক্ষে ২ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় পায় বাংলাদেশ।  

টানা তিন জয়ে বাছাইয়ের স্বাগতিক পাকিস্তানকে টপকে পয়েন্ট তালিকার চূড়ায় উঠল বাংলাদেশ। পাকিস্তানি মেয়েরাও এখন পর্যন্ত নিজেদের তিন ম্যাচেই জিতেছে। এই মুহূর্তে দুই দলের পয়েন্ট সমান ৬ করে হলেও নেট রানরেটে এগিয়ে থাকায় বাংলাদেশ শীর্ষে ও পাকিস্তান দুইয়ে।

বৃহস্পতিবার নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। এই ম্যাচ জিতলেই মিলবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মেয়েদের বিশ্বকাপের ত্রয়োদশ আসরের টিকিট।

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে না পারলেও অবশ্য ক্ষতি নেই। শনিবার নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতলেও বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেবে বাংলাদেশ। এমনকি শেষ দুই ম্যাচে হারলেও নেট রানরেটে এগিয়ে থাকার সুবাদে বিশ্বকাপের টিকিট পেয়ে যেতে পারে নিগারের দল।

স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আজ টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের শুরুটা ছিল মন্থর। ১৪ রান করা ওপেনার ইশমা তানজিম ৮.৩ ওভারে যখন আউট হন, বাংলাদেশের স্কোর ১ উইকেটে ৩৫।

এরপর দ্বিতীয় উইকেটে ইনিংসের ভিত গড়েন শারমিন ও ফারজানা। ১২৭ বলে ১০৩ রানের জুটি গড়েন দুজন, যেখানে ফারজানার অবদান ৪৮ বলে ৪০ ও শারমিনের ৭৯ বলে ৫৭। এটি তাঁদের চতুর্থ শতরানের জুটি।

৩০তম ওভারে শারমিন আউট হওয়ার পর আট ওভারের মধ্যে ফারজানা ও সোবহানা মোস্তারিকেও (৯) ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়। ৩৭.৫ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর তখন ৪ উইকেটে ১৭৬।

এখান থেকে পঞ্চম উইকেটে রিতু মনির সঙ্গে ৩৭ এবং ষষ্ঠ উইকেটে ফাহিমার সঙ্গে ৪৪ বলে ৬১ রানের জুটি গড়েন নিগার। ২২ বলে ২৬ রান করেন ফাহিমা। ৫৩ রানে ২ উইকেট নিয়ে স্কটল্যান্ডের সেরা বোলার অধিনায়ক ক্যাথরিন ব্রাইস।

লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নাহিদা আক্তার ও মারুফা আক্তারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৩১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে প্রথম পাওয়ারপ্লেতেই ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকে পড়ে স্কটল্যান্ড। চতুর্থ উইকেটে আলিসা লিস্টারের সঙ্গে ৪৭ রানের জুটি গড়ে বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ব্রাইস। কিন্তু দলীয় ৭৮ রানে মারুফা লিস্টারকে রানআউট করলে ভাঙে এই জুটি।

এরপর লেগ স্পিনার রাবেয়া খান ও অফ স্পিনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিলে আরও ৩ উইকেট নেন। ১১০ রানে ৭ উইকেট হারানো স্কটল্যান্ডকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু প্রিয়ানাজ চ্যাটার্জী ও র‍্যাচেল স্ল্যাটার যেন আজ ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। দুজনে মিলে যোগ করেন ১১৫ রান, যা স্কটিশ মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ জুটি। প্রিয়ানাজ ও র‍্যাচেল দুজনই করেন সমান ৬১ রান।

তাতেও বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। স্কটল্যান্ড শুধু হারের ব্যবধান কমাতে পেরেছে আর বাংলাদেশের জয়ের অপেক্ষা একটু বেড়েছে। এই আরকি!

সম্পর্কিত নিবন্ধ