পয়লা বৈশাখ: আনন্দের ছায়ায় ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের লড়াই
Published: 14th, April 2025 GMT
যখন বৈশাখের সকালটা কুয়াশা সরিয়ে রঙের খেলা শুরু করে, তখনই যেন এ অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষের প্রাণ জেগে ওঠে। ঢোলের শব্দে, পান্তা-ইলিশের গন্ধে, লাল-সাদা শাড়ির ছটায় বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে এক উজ্জ্বল, আনন্দঘন, বর্ণিল দিন।
কিন্তু এই উল্লাস-আনন্দ কি কেবল অভিজাত সৌরভে মোড়ানো? নাকি এর পেছনে আছে দীর্ঘ এক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা—রাজনীতি, প্রতিরোধ আর আত্মপরিচয়ের সন্ধান?
বাংলা নববর্ষের সূচনা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, মোগল সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি ও সৌর বর্ষের মিলনে ‘ফসলি সন’ চালু করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর তৎকালীন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে উপদেষ্টা ফতেউল্লা সিরাজীকে নতুন পঞ্জিকা তৈরি করার দায়িত্ব দেন। ফতেউল্লা সিরাজী ছিলেন সম্রাট আকবরের দরবারের একজন বিদ্বান আলিম ও প্রশাসনিক উপদেষ্টা। বাংলা সনের সংস্কারের দায়িত্ব পেয়ে তিনি স্থানীয় সৌর সন ও আরবি হিজরি সন মিলিয়ে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রবর্তিত এই বর্ষপঞ্জি থেকেই বর্তমান বাংলা সনের সূচনা, যা শুরু হয় ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে।
কেউ কেউ আবার মনে করেন, এর শিকড় আরও প্রাচীন বিক্রমি সনে, যার প্রবর্তক ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য। এই সন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ সালে শুরু হয়েছিল এবং উত্তর ভারতে এখনো ব্যবহৃত হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক রাজা শশাঙ্ক নিজ প্রশাসনিক প্রয়োজনে একটি বর্ষপঞ্জি চালু করেন। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় আনুমানিক ৬১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই সনটি চালু করেন।
যদিও বিক্রম সন এবং রাজা শশাঙ্কের বাংলা সন চালুর বিষয়ে মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে এবং এ দুজনের পক্ষে নির্দিষ্ট প্রমাণও সীমিত, আকবরের পক্ষেই জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। তবুও বিক্রম সন ও শশাঙ্ক বাংলা পঞ্জিকার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তবে একটি ব্যাপার স্পষ্ট—পয়লা বৈশাখ এই দিনটি যুগে যুগে রূপ বদলেছে, অর্থও বদলেছে।
পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের শুরুতে কৃষকদের সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এদিন জমিদারেরা তাঁদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ করালেও উৎসবটি ছিল মূলত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির; সাধারণ মানুষের জন্য এটি কোনো উৎসব ছিল না। জমিদারদের হালখাতার অনুষ্ঠানে মিষ্টিমুখ মানে ছিল কিছুটা রেহাই, কিন্তু সে রেহাই সম্মানজনক ছিল না—ছিল একপেশে দয়ার দান। শ্রমজীবী মানুষ কখনোই ইলিশ-পান্তা দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করত না। তারা করত রোদে-ঘামে, ধানের ভাতে জীবনের উৎসব।১৯৮৯ সালের কথা। তখনকার স্বৈরাচার এরশাদ শাসনের ছায়া পেরিয়ে একঝাঁক সাহসী ছাত্র-শিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নেতৃত্বে রাজপথে বেরিয়ে এল এক প্রতীকী আনন্দের বহর—আনন্দ শোভাযাত্রা। বাঘ-সিংহ, মুখোশ, পাখি আর হাতি—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস। প্রতিটি রং, প্রতিটি রূপ ছিল প্রতিবাদের ভাষা। তারা বলল, ‘আমরা কে?’ আর উত্তরে তুলে ধরল, ‘আমরা প্রতিবাদী, আমরা সংস্কৃতির আলোয় পথ খুঁজি।’ তাদের প্রতিবাদের সেই রঙিন বহর ছিল নিছক শোভাযাত্রা নয়, ছিল এক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিরোধ।
সেই মুহূর্ত থেকেই পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে সংস্কৃতির শক্তিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দিন। এবং আজ, অনেক বছর পর, ২০২৫ সালের নববর্ষ হতে যাচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন—প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন হবে এক ফ্যাসিস্ট সরকার, শেখ হাসিনার দমন-পীড়নমুক্ত পরিবেশে। দুনিয়া কাঁপানো জুলাই বিপ্লব এনে দিয়েছে আমাদের সেই পরিবেশ।
এরশাদ পতনের সময়কার মতো যেভাবে নববর্ষ হয়েছিল মুক্তির প্রতীক, এবারও নববর্ষ ফিরে আসছে মানুষের দখলে—সংস্কৃতির স্বাধীন প্রকাশ আর রাজনৈতিক মুক্তচিন্তার মঞ্চ হয়ে। ভবিষ্যৎ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ উৎসব হিসেবে।
এই আনন্দ শোভাযাত্রাই পরে হয়ে ওঠে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে ‘মঙ্গল’ শব্দটি যুক্ত হয়। নামের এই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা এড়িয়ে গিয়ে বলা যায়—এই পদযাত্রা এখন এক কল্যাণবোধের প্রতীক। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়। বিশ্ব বলল, এটি শুধুই উৎসব নয়, এটি এক ‘কল্যাণচিন্তার পদযাত্রা’।
আজকাল পয়লা বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ। অথচ ইতিহাস বলে, কৃষক-প্রজাদের কাছে এই দিনটি ছিল খাজনা দেওয়ার আতঙ্কের দিন। পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের শুরুতে কৃষকদের সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এদিন জমিদারেরা তাঁদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ করালেও উৎসবটি ছিল মূলত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির; সাধারণ মানুষের জন্য এটি কোনো উৎসব ছিল না। জমিদারদের হালখাতার অনুষ্ঠানে মিষ্টিমুখ মানে ছিল কিছুটা রেহাই, কিন্তু সে রেহাই সম্মানজনক ছিল না—ছিল একপেশে দয়ার দান। শ্রমজীবী মানুষ কখনোই ইলিশ-পান্তা দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করত না। তারা করত রোদে-ঘামে, ধানের ভাতে জীবনের উৎসব।
ফরাসি দার্শনিক জঁ বদ্রিয়ার বলেছিলেন, ‘আধুনিক সমাজে অনেক কিছুই বাস্তব নয়—তাকে বাস্তবের চেয়ে উজ্জ্বলতর এক “হাইপার রিয়েলিটি”তে রূপান্তরিত করা হয়।’ পয়লা বৈশাখও কি এমনই এক রূপান্তর? যেখানে প্রতীক থাকে, ইতিহাস হারিয়ে যায়?
বাংলার ইতিহাস এই নববর্ষে লুকিয়ে আছে। রাজা শশাঙ্ক ও সেন আমলে বৌদ্ধ নিপীড়ন, চর্যাপদের ম্লান বিদায়, খিলজির বিজয়ের পর বাংলা ভাষার বিকাশ—সবই যেন এক সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের সূচনা করে। এই সহাবস্থানে গড়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার ভিত্তি।
পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার ভাষাভাষী, হিন্দু ও মুসলমান—সবাই ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হলেও এই দিনে তারা এক সাংস্কৃতিক সংলাপে মিলিত হয়।
বাঙালির নববর্ষ কেবল ‘ঐতিহ্য’ নয়। এটি ইতিহাসের টানাপোড়েন, শ্রেণি বিভাজনের প্রতিবাদ এবং আত্মপরিচয়ের এক রঙিন আলেখ্য।
আজকের দিনে পয়লা বৈশাখ অনেকের কাছে শুধুই সেলফি-সেশন, গান-নাচের সময়। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো জানাটাই আসল উদ্যাপন।
ঐতিহ্যকে বুঝে তার সম্মান করা—এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
সুতরাং প্রশ্ন উঠেই যায়—আপনি কোনটি উদ্যাপন করছেন? ঐতিহ্য, না হাইপার রিয়েলিটি?
জয়নাল আবেদীন শিশির যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আকবর র নববর ষ আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
ইউনিয়ন ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
ইউনিয়ন ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার আজ রোববার ঢাকার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি করেছেন।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন আজ সাংবাদিকদের বলেন, ত্রাণ বিতরণ ও অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জনকে দুটি মামলাতেই আসামি করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, একটি মামলায় ২০২২ ও ২০২৩ সালে দরিদ্রদের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে কম্বল বিতরণের কথা বলে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে প্রায় ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, ৭ লাখ ৮৫ হাজার কম্বলের অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। মামলায় মোকাম্মেল হক চৌধুরী ছাড়াও ব্যাংকটির সাবেক দুই চেয়ারম্যান আহসানুল আলম ও মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, সাবেক পরিচালক মারজিনা শারমিন, মো. রাশেদুল আলম, শওকত হোসেন, মোহাম্মদ ফজলে মোরশেদ, হালিমা বেগম, ওসমান গণি, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ, সাবেক পরিচালক (স্বতন্ত্র) মো. আবদুল কুদ্দুস ও মো. আবদুস সালামকে আসামি করা হয়েছে।
একই মামলায় ব্যাংকটির হেড অব এফএডি ও সিএফও রুহুল আমিন, হেড অব পিআরডি এ কে এম জহির উদ্দীন ইকবাল চৌধুরী, সিনিয়র ক্যাশ অফিসার মো. বোরহান উদ্দীন চৌধুরী, ক্যাশ ইনচার্জ আবদুল হালিম, অপারেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ রাশিদ শহীদকে আসামি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সানি এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর জনি মিয়াকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় মামলায় বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে সিএসআর ফান্ড থেকে ১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বলা হয়, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণের নামে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সেটি আসল দেখিয়ে অতিরিক্ত বিল তুলে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ মামলায় মোকাম্মেল হক চৌধুরী ছাড়াও ব্যাংকটির সাবেক দুই চেয়ারম্যান আহসানুল আলম ও মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মোল্লা ফজলে আকবর, মারজিনা শারমিন, মো. রাশেদুল আলম, শওকত হোসেন, মোহাম্মদ ফজলে মোরশেদ, হালিমা বেগম, ওসমান গণি, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ, মো. আবদুল কুদ্দুস, মো. আবদুস সালাম, রুহুল আমিন, এ কে এম জহির উদ্দীন ইকবাল চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে।