দু’পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত বিএনপির ২ নেতার পদ স্থগিত
Published: 13th, April 2025 GMT
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় খাস খতিয়ানের ১৯০ বিঘা জমির দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন। এ সময় শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
নিহত মো. মদিন মোল্লা (৫৫) উপজেলার রূপবাটি ইউনিয়নের বড় ধুনাইল গ্রামের মৃত ছকির মোল্লার ছেলে। তাঁর লাশ উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জে মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইউনিয়ন বিএনপির দুই নেতার পদ স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি যুবদল ও ছাত্রদলের দুই নেতার পদ স্থগিতের নির্দেশনা দিয়েছে জেলা বিএনপি।
তারা হলেন রুপবাটি ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন ও সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল হালিম সেখ। ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সেখ ও ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি ইনজামাম সেখের পদ স্থগিতের জন্য দুই সংগঠনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দলটি।
সরেজমিন জানা গেছে, বড় ধুনাইল গ্রামের ১৯০ বিঘা খাস খতিয়ানের জমি নিয়ে এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় হালিম ও জাফরের পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছে। এরই জেরে গত শনিবার দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শাহজাদপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান।
রোববার সকালে উভয় পক্ষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফের সংঘর্ষে জড়ায়। এতে মদিন মোল্লা নিহত হন। আহত হয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), ইনজামুল হক (২৬), আলতাব (৫৭), বাবলু মোল্লাসহ (৪৫) অন্তত ১০ জন।
জাফরের পক্ষের মদিন মোল্লার মৃত্যুর খবরে হালিম পক্ষের লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এ সুযোগে জাফর পক্ষের লোকজন বিভিন্ন বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার বিষয়ে জানার চেষ্টা করেও দু’পক্ষের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
খতিয়ানের জমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হালিম ও জাফর পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন শাহজাদপুর থানার ওসি মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন হত মদ ন ম ল ল র স ঘর ষ ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
ঐতিহ্যের উজ্জ্বল কান্ডারি
সাইদুর রহমান বয়াতি
বাংলাদেশের এ সময়ের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির কান্ডারিদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক বহুমাত্রিক সাধক হিসেবে সাইদুর রহমান বয়াতির নাম উচ্চারণ করা যায়। কেননা তিনি একাধারে সাধক কবি, পালাকার, পরিবেশনশিল্পী ও পরিবেশনশিল্পের পরিচালক; অন্যদিকে তিনি একজন উজ্জ্বলতম সুফি সাধক; এমনকি ঐতিহ্যগত তন্ত্রমন্ত্রের সাধক ও লোকায়ত চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর রয়েছে বিশেষ পরিচিতি।
সাইদুর রহমান বয়াতি মানিকগঞ্জ জেলার পুটাইল ইউনিয়নের পশ্চিম হাসলী গ্রামে ২৫ মে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি মানিকগঞ্জের ভাষাশহীদ রফিক স্মরণে গান রচনা করেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করতে সক্ষম হননি। কিন্তু বাল্যকাল থেকে সংস্কৃতিচারী এই সাধক কবি ঐতিহ্যগত ধারায় প্রায় ৬০ প্রকারের সংগীত-বাণী রচনা, সুরকরণ ও পরিবেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জারি, সারি, মর্সিয়া, কীর্তন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, ধুয়া, মালসি, তর্জা প্রভৃতি ঐতিহ্যগত সংগীতরীতিতে সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিবিধ সংকটে মানুষকে সাহস জোগাতে, উদ্বুদ্ধকরণে সংগীতের সমান্তরালে পুঁথিকাব্য রচনা ও পরিবেশন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, করোনা মহামারির কাল নিয়ে তাঁর রচিত গান ও পুঁথিকাব্য মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।
সাইদুর রহমান বয়াতির সংগীত রচনা ও পরিবেশনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের কবি জসীমউদ্দীন, যুক্তরাষ্ট্রের ফোকলোরবিদ হেনরি গ্লাসি প্রমুখ। হেনরি গ্লাসি বিরচিত আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ এবং ট্র্যাডিশনাল আর্ট অব ঢাকা শীর্ষক দুটি গ্রন্থে সাইদুর রহমান বয়াতির ছবিসহ পরিচিতি লভ্য। সংগীত রচনা, সুরসাধনা ও তা আসরে পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, খঞ্জনি, মন্দিরা-করতাল, একতারা, ঢোল, বায়া, চটি বা প্রেমজুড়ি প্রভৃতি বাদন ও প্রশিক্ষণ প্রদানে দক্ষ।
ঐতিহ্যগত পরিবেশন শিল্পকলার সঙ্গেও সাইদুর রহমান বয়াতি বাল্যকাল থেকে সম্পৃক্ত। মাত্র ১০ বছর বয়সে পারিবারিক সদস্যদের হাত ধরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন আসমান সিং যাত্রাদলে। যাত্রাদলে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি ‘ছবি রানী’ নাম ধারণ করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, সাজ গ্রহণের সুবিধার জন্য দুই কানের লতিতে ছিদ্র করেছিলেন, যা এখনো দৃশ্যমান। যাত্রাদলে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনি নারীদের মতো হাতে রুপার চুড়ি, কানে ঝুমকা ও গলায় মালা পরে কাটিয়েছেন অনেক দিন। নারী চরিত্র হিসেবে তিনি সিরাজ-উদ-দৌলা যাত্রায় লুৎফা, হরিশচন্দ্র যাত্রায় শৈব্যা, হোসেন শহিদ যাত্রায় মায়মুনা, রঘু ডাকাত যাত্রায় মনিকা দেবী প্রভৃতি নারী চরিত্রে রূপদান করেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রায় ১০০টি যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।
এই সাধক সামাজিক জীবনে লোকচিকিৎসক হিসেবেও পরিচিত। এ ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করেছেন। কেননা সমাজের সাধারণ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের সুচিকিৎসার জন্য তিনি একদিকে প্রাকৃতিক জ্ঞান তথা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছগাছড়া, লতাপাতা, শিকড়বাকড়কে ব্যবহার করেছেন। জীবনের একটি পর্যায়ে সাইদুর রহমান বয়াতি খাগড়াছড়ি জেলার একজন সন্ন্যাসী রামানন্দ চাকমার কাছে তন্ত্রমন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখনো তিনি রামানন্দ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তিন শতাধিক মন্ত্র মানবকল্যাণের জন্য স্মৃতিতে ধারণ করে চলেছেন। সাপের কামড় থেকে রক্ষার মন্ত্র, গরু-বাছুরের চিকিৎসার মন্ত্র প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে তিনি নিজের এলাকার জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে উপকৃত করেছেন।
সুফি সাধনায় দীক্ষিত এই সাধকের ঐতিহ্যিক পরম্পরায় জীবনের নানা পর্যায়ে দেহকেন্দ্রিক সাধনা, বিচিত্র সংগীত উপাসনা, লৌকিক ও মারেফতি আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সামাজিক মানুষের আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একই সঙ্গে ইসলামি শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফতপন্থী ধর্মসাধনার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে অদ্যাবধি সংগীত, নৃত্য, কৃত্য, নাট্য ইত্যাদি চর্চা ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁর এই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সাধনার সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব, বাউল, তান্ত্রিক, যোগাচারীদের নিবিড় মৈত্রী প্রত্যক্ষ করা যায়। অনন্য এই সাধক বাংলাদেশের বিচিত্র ধরনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির যেমন কান্ডারি, তেমনি এই ভূখণ্ডে আগত, জন্ম নেওয়া এবং চর্চিত বিচিত্র ধরনের ধর্ম, মত, ভাব, দর্শন ও পথের স্বচ্ছ অধিকারী।
ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন।
কৃপাসিন্ধু রায় সরকার