বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ নয়; প্রায় সারা বছর চলমান স্বাস্থ্যঝুঁকি। চলতি বছরের শুরুতেই বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে চার শ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১২ জনই বরগুনা জেলার বাসিন্দা। মারা গেছেন দুজন—তাঁরাও বরগুনার। পরিসংখ্যান বলছে, বরগুনাই এখন বিভাগের ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগে ৪৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে ২০২৪ সালে ৮ হাজার ৪৫৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে এসেছিলেন। মারা গিয়েছিলেন ৫৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন সবচেয়ে বেশি—৩৮ হাজার ৬৪ জন। মৃত্যু হয়েছিল ২০৯ জনের। ২০২২ সালে ৩ হাজার ৪০৫ রোগীর বিপরীতে ১১ জনের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বরিশালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এর আগে বিভাগে ডেঙ্গুর ইতিহাস নেই। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১০ হাজারে বেশি মানুষ। এরপর ২০২২ সালে পুনরায় প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। এর পর থেকে সারা বছর কমবেশি রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসেন।

বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বরগুনা। গত দুই বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৬৪ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১২ জন বরগুনার বাসিন্দা। এর আগের বছর ৮ হাজার ৪৫৭ জন হাসপাতালে এসেছিলেন। এর মধ্যে বরগুনারই ছিলেন ২ হাজার ৩৬৭ জন।

বরগুনা শহরের ডিকেপি সড়কের বাসিন্দা শারমিন জাহানের আট বছর বয়সী মেয়ে সানজিদা ৫ এপ্রিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। মেয়েকে ভর্তি করেন বরগুনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে। দুই দিনের ব্যবধানে মেয়ের প্লাটিলেট নেমে যায় ২৬ হাজারে। চিকিৎসকেরা শিশুটিকে বড় হাসপাতালে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনকি হাসপাতালের রেজিস্টার থেকে শিশুটির নাম কেটে দেওয়া হয়। শারমিন বাধ্য হয়ে গভীর রাতে মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বরিশালে আনেন।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে রাত দুইটায় মেয়েকে ভর্তি করেন শারমিন। কিন্তু শয্যা খালি ছিল না। মেঝেতেও জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে যান একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু তারা ভর্তি নেয়নি। উপায় না পেয়ে গভীর রাতে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন। পরদিন একজন শিশুবিশেষজ্ঞের ব্যক্তিগত চেম্বারে মেয়েকে নিয়ে যান। বেশ কয়েকটি টেস্টের পর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে মেয়ের চিকিৎসা করাতে হয়। শারমিন বলেন, মেয়ের চিকিৎসা করাতে তাঁকে ভোগান্তির পাশাপাশি অন্তত ৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। সাধারণ ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীর সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ডেঙ্গুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে রোগীকে দেওয়ার সুযোগ বরিশালে শুধু এই হাসপাতালেই আছে। বিভাগের অন্য কোথাও প্লাটিলেট সেল সেপারেটর যন্ত্র নেই। ফলে রোগী ও স্বজনদের বড় ঝুঁকিতে পড়তে হয়।

হাসপাতালের উপপরিচালক (প্রশাসন) এইচ এম মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এক হাজার শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। বাড়তি রোগীর চাপে তাঁদের সারা বছর হিমশিম খেতে হয়।

মশা আছে, প্রতিরোধ নেই

একসময় ধারণা ছিল, বিভাগের ডেঙ্গু রোগীরা ঢাকাসহ অন্য এলাকায় গিয়ে সংক্রমিত হন। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে রোগীদের শতভাগই স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত। বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের মনি আক্তার চলতি বছর দুবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে তিনি অন্যত্র ভ্রমণ করেননি। স্থানীয়ভাবেই তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। ২০২৩ ও ২৪ সালে পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি দল।

চিকিৎসাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণ আবহাওয়ায় ডিম থেকে পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে উঠতে কম সময় লাগে। এ কারণে মশা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু এখন বর্ষা মৌসুমে নয়; সারা বছরই প্রকোপ অব্যাহত থাকছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ছোট শহরে বেশি জনসংখ্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাত্র তৈরি হয়, যাতে পানি জমে মশার বংশবিস্তারের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক। তাঁরা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে সব হাসপাতালকে আলাদা নির্দেশনা দিয়েছেন। গ্রামে সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নেই। স্থানীয় কমিউনিটিকে সংযুক্ত করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বর শ ল ব ভ গ বরগ ন র হয় ছ ল ত হয় ছ

এছাড়াও পড়ুন:

গাজা সিটির একমাত্র সচল হাসপাতালে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চল গাজা সিটির প্রধান আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে শনিবার রাতে (১২ এপ্রিল) দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। এতে হাসপাতালটির আইসিইউ এবং অস্ত্রোপচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। খবর বিবিসির।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজাজুড়ে নির্বিচার বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। রেহাই পায়নি হাসপাতালও। আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালটি গাজা সিটিতে সচল থাকা একমাত্র হাসপাতাল ছিল।

অনলাইনে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, হাসপাতালের দোতলা ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর সেখান থেকে আগুনের বিশাল কুণ্ডলি ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে থাকা কিছু রোগীকে দ্রুত অন্য স্থানে সরিয়ে নিতেও দেখা যায় ভিডিওতে।

আরো পড়ুন:

‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে অসুস্থ হওয়া ১৪ জন ঢাকা মেডিকেলে

চোখের জলে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি কামনায় ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি সমাপ্ত

ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা হাসপাতালটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, কারণ এতে হামাসের একটি কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিল। গাজার বেসামরিক জরুরি পরিষেবা অনুসারে, কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

তবে, হাসপাতালের সঙ্গে সম্পর্কিত জেরুজালেমের এপিস্কোপাল ডায়োসিসের এক বিবৃতি অনুসারে, রোগীদের তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে নেওয়ার ফলে চিকিৎসাধীন থাকা গুরুতর অসুস্থ এক শিশু মারা গেছে।” 

গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হাসপাতালের আইসিইউ এবং অস্ত্রোপচার ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যার ফলে রোগী এবং হাসপাতাল কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে।

আইডিএফ জানিয়েছে, তারা বেসামরিক নাগরিক বা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ক্ষতি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে সন্ত্রাসী অবকাঠামোর এলাকায় অগ্রিম সতর্কতা জারি, সুনির্দিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার এবং ড্রোন নজরদারি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেছেন, ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) হাসপাতালের এক চিকিৎসককে ফোন করে তাৎক্ষণিকভাবে ভবন খালি করার সতর্কবার্তা দিয়েছিল। চলে যাওয়ার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল।

 

স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া ফুটেজে হাসপাতালের কর্মী ও রোগীদেরকে বাইরে অন্ধকারের মধ্যেই অন্য জায়গায় সরে যেতে দেখা গেছে। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়ে থাকা নারী ও শিশুদেরকেও পালাতে দেখা যায় ফুটেজে।

দখলদার ইসরায়েল গত বছর গাজা সিটির সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফাকে পুরোপুরি ধ্বংস দিয়েছিল। এরপর আল-আহলি হাসপাতালটি সেখানকার প্রধান হাসপাতালে পরিণত হয়। শনিবার দিবাগত রাতে এই হাসপাতালটিতেও হামলা চালিয়েছে তারা। এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে একই হাসপাতালে হামলা চালিয়ে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করেছিল দখলদার ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ ১৫ মাস ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরায়েল। তবে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় ফের তীব্র হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং এটি প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী এখন পর্যন্ত গাজার ৩৫টি হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়েছে। এতে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার রোগী, আহত ব্যক্তি ও আশ্রয়প্রার্থী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ট্রাম্প কি সত্য বলছেন, তাঁর চিন্তা কি পশ্চাৎপদ
  • ইকুয়েডরে আবার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন রক্ষণশীল দলের নোবোয়া
  • গাজা সিটির একমাত্র সচল হাসপাতালে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
  • গাজায় এ পর্যন্ত ৩৫টি হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
  • ইন্টারনেটের ব্যবহার কম উৎপাদনশীল খাতে