বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রা নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। যেখান-সেখান দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া যাবে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এসব কথা বলেছেন।

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানীর রমনা বটমূলে ডিএমপির নিরাপত্তা–পরিকল্পনা ও মহড়া আজ রোববার দুপুরে পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সাজ্জাত আলী।

ডিএমপির কমিশনার বলেন, বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি, টিএসসি হয়ে পুনরায় চারুকলায় গিয়ে শেষ হবে। শোভাযাত্রার পুরো রুট নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। পাশ থেকে, বিকল্প পথে শোভাযাত্রায় প্রবেশ করা যাবে না। শোভাযাত্রার সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পাশে চারুকলার বিপরীতে যে গেট আছে, সেটি বন্ধ থাকবে। সে সময় কেউ এই গেট দিয়ে রাস্তায়ও যেতে পারবে না।

শোভাযাত্রায় যাঁরা অংশ নিতে চান, তাঁদের সুবিধার্থে একটি ‘ম্যাপ’ তৈরি করা হয়েছে বলে জানান সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, শোভাযাত্রার মাথা থাকবে চারুকলার সামনে। আর শোভাযাত্রার লেজ থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) বাসভবনের সামনে। এর বাইরে মাঝখান দিয়ে কোনোভাবেই কারও শোভাযাত্রায় প্রবেশের সুযোগ নেই। শোভাযাত্রায় যাঁরা যোগদান করবেন, তাঁদের শাহবাগ মোড় থেকে অথবা ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে যাঁরা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান, তাঁরা শাহবাগ হয়ে কাঁটাবন মোড় দিয়ে নীলক্ষেত মোড় হয়ে ঢাবি উপাচার্যের বাংলোর সামনে থেকে অংশ নেবেন।

এই উৎসবমুখর অনুষ্ঠান যাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই নির্বিঘ্নে উদ্‌যাপন করতে পারেন, সে জন্য ডিএমপি ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে জানান সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপিত হবে। উৎসবের টানে নগরবাসী সমবেত হবেন রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন, রবীন্দ্রসরোবর ও হাতিরঝিল এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থলে। এককথায় পুরো ঢাকা নববর্ষ উদ্‌যাপনে প্রস্তুত। উল্লিখিত এলাকা ছাড়াও ঢাকার অধিকাংশ স্থানে নববর্ষের উৎসব উদ্‌যাপিত হবে।

ডিএমপির কমিশনার বলেন, নববর্ষ উদ্‌যাপনে নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই। ১৮ হাজার পুলিশ সদস্য পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া র‍্যাব, সেনাবাহিনী ও অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট থাকবে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সহযোগিতা করবে। এখন পর্যন্ত কোথা থেকে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই।

বাংলা বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরকে ২১টি সেক্টরে ভাগ করে ইউনিফর্ম ও সাদাপোশাকধারী পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে বলে উল্লেখ করেন সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাস্থলে ডগ স্কোয়াড দ্বারা সুইপিং করা হবে। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ মোট ২১টি স্থানে ব্যারিকেড থাকবে। প্রতিটি অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশমুখে আর্চওয়ে ও হ্যান্ড মেটাল দিয়ে তল্লাশি করা হবে। অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়া ও শোভাযাত্রার রুটগুলো সিসি ক্যামেরা, স্থির ও ভিডিও ক্যামেরা ও ড্রোনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। অনুষ্ঠানের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুট প্যাট্রোল থাকবে। সিটিটিসি, সোয়াত ছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে পোশাকে ও সাদাপোশাকে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন।

ইভ টিজিং ও ছিনতাই প্রতিরোধ সাদাপোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের দল মোতায়েন থাকবে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেন্টার’ থাকবে। সেখানে মাইকিং ব্যবস্থা থাকবে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও সাইবার প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে নববর্ষকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার রোধে নজরদারি করা হচ্ছে।

নববর্ষে অংশ নিতে আসা নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে সাজ্জাত আলী বলেন, সবার নিরাপত্তার স্বার্থে তল্লাশিকাজে তিনি সহযোগিতা কামনা করছেন। অনুষ্ঠানস্থলে কোনো ধরনের ব্যাগ, ধারালো বস্তু ও দাহ্য পদার্থ নিয়ে না আসার জন্য তিনি অনুরোধ করছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে, অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে হবে। কোনো ধরনের আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো যাবে না। শব্দদূষণ হয়—এ ধরনের কোনো বাঁশি ব্যবহার করা যাবে না। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য বাজারজাত করা যাবে না। বিশেষ করে শোভাযাত্রায় ও অন্যান্য অনুষ্ঠানস্থলে।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শুরু হবে সকালে। এই অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময় শেষ হবে। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তিনটি গেট দিয়ে ঢুকতে হবে রমনা বটমূলে। তবে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের হওয়া যাবে দুটি গেট ব্যবহার করে।

ছায়ানটের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আগ্রহী নগরবাসীর উদ্দেশে সাজ্জাত আলী বলেন, যাঁরা নারী ও শিশু সঙ্গে নিয়ে আসবেন, তাঁরা যেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভিড় এড়িয়ে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেন। তাঁরা যেন প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য নির্ধারিত গেট ব্যবহার করেন। বিকেল ৫টা পর্যন্ত উদ্যানে প্রবেশ করা যাবে।

আগুন দেওয়ায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে

ডিএমপির কমিশনার সাজ্জাত আলী বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রার মোটিফ আগুনে পোড়ানোর ঘটনার তদন্ত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আগামীকাল সকালে শোভাযাত্রা শুরুর আগেই এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী।

এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির কমিশনার এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো মামলা তদন্তের আগে কোনো কথা বলি না। মামলা তদন্ত ও জড়িত ব্যক্তিকে শনাক্তে আমরা খুব নিকটে পৌঁছে গেছি। আশা করছি, আগামীকাল শোভাযাত্রার শুরুর আগেই আমরা সন্তোষজনকভাবে মামলাটা ডিটেকশন (খুঁজে বের করা) করতে পারব।’

চারুকলা নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল কি না, সেখানে পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির কমিশনার বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন, এ নিয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন স জ জ ত আল র অন ষ ঠ ন ছ য় নট র নববর ষ প রব শ চ র কল তদন ত ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

নববর্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

বাংলা নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি তার দীর্ঘ যাত্রাপথে বহু বাঁকবদলের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই অর্জনের মাত্রা কখনো অর্থনীতি, কখনো ধর্ম, কখনো রাজনীতিকে আশ্রয় করেছে। ঔপনিবেশিক শোষণের অংশ হয়েছে কখনো, কখনো আবার পরিণত হয়েছে উপনিবেশবিরোধিতারও মুখ্য হাতিয়ারে। ফলে বাংলা নববর্ষ বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক রূপে নিজের অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখতে পারেনি, এটা সত্য। আর এটা তার শক্তিরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর আরেকটি তাত্পর্যপূর্ণ দিক হলো, একটি বৃহৎ মানবমণ্ডলীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের সূত্র যোজনা করা। মানবের মিলনসাধন যেকোনো সংস্কৃতিরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তবু বাংলা নববর্ষ এ ক্ষেত্রে বিশেষত্বমণ্ডিত হয়েছে বৃহত্তর জনপরিসরকে তার বিচিত্র প্রভাবগত শক্তিবলয়ে নিজের আওতাভুক্ত করার সক্ষমতায়, আর আনন্দ-উত্সবের সর্বজনীনতায়।

এই ইতিহাস আমাদের জানা যে বঙ্গাব্দের সূচনা ঘটেছিল ষোলো শতকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে। সৌর ও চান্দ্রবৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সনের প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে মূলত এটি ছিল সৌরসন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পৃথিবীর বহু সন গণনার মতো এর মাস গণনার সঙ্গে প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্য ও কৃষিকর্মের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগ। মাসের নাম নির্ধারণে নক্ষত্রনামের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রেও প্রকৃতির সংযোগ ছিল অনিবার্য। নববর্ষের সূচনাদিনটিকে খাজনা আদায়ের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও বিবেচ্য ছিল কৃষিকাজ ও ফসল উত্পাদনের নিবিড় যোগসূত্র। মধ্যযুগীয় এই ব্যবস্থাটি পারম্পর্য রক্ষা করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল অবধি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা সৃষ্টি করেছিল, সেখানেও নববর্ষের সূচনায় ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের নামে প্রজাদের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়ের একপ্রকার উত্সব আয়োজনের প্রচলন লক্ষণীয়। এ ছাড়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের পটভূমিতে ব্যবসায়ী দোকানদারদের সঙ্গে ক্রেতাদের বাকিতে পণ্য গ্রহণের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এভাবে বাংলা নববর্ষের সূচনাদিনটি বাঙালির অর্থনৈতিক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। ধনবানদের আনন্দ উত্সবের প্রাচুর্য ধনহীনদের কতটুকু স্পর্শ করতে পারত, তা নিঃসন্দেহে অনুমান ও গবেষণার বিষয়। তবে কৃষকের মনে নতুন বছর যে কৃষিকাজের উদ্দীপনাসহ নতুন ফসলের স্বপ্ন নিয়ে আসত, তাতে সন্দেহ নেই।

সন গণনার ক্ষেত্রে এটা লক্ষণীয় যে জাগতিক কর্মকাণ্ড সূর্যের আবর্তন তথা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় ক্রিয়াদি চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধিনির্ভর। ফলে বাংলা নববর্ষের এই অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক তাত্পর্যের বাইরে বাঙালি হিন্দু সমাজে একটি ধর্মীয় প্রেরণাও ছিল। তাঁরা পূজা-পার্বণের মাধ্যমে দিনটি উদ্যাপন করেন। এভাবে বাংলা নববর্ষ ধর্মীয় সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে আছে। তবে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-বাঙালি-আদিবাসীনির্বিশেষে সচ্ছলতা সাপেক্ষে নতুন পোশাক পরা কিংবা উন্নত মানের খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে নববর্ষকে উত্সব হিসেবে পালনের বিষয়টিই মুখ্য। এর সঙ্গে রয়েছে লোকসংস্কৃতির প্রসারার্থে বৈশাখী মেলার আয়োজন।

এবার আসি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্নে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্বে বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যখন ঐতিহ্য-অনুসন্ধানী, তখন বাংলা নববর্ষ পালন তার অংশ হয়ে ওঠে। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে এর পরিসর ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যখন পূর্ব বাংলা হিসেবে এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আরেক আধা ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে, তখন প্রথমেই আঘাত আসে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। তখন ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের বাঙালির ঐতিহ্যচেতনা প্রবল হয়ে ওঠে। বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে এই ঐতিহ্যচেতনার গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে তারা বাংলা নববর্ষ পালনকে ব্যাপকভাবে উত্সবমুখর করার অভিপ্রায়ে ওই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। যুক্তফ্রন্ট সরকার পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের শিকার হলে এবং পরে দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি হলে এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিদের নবজাগ্রত জাতীয় চেতনা প্রতিবাদী মনোভাবে উজ্জীবিতই থাকে।

সংস্কৃতির ওপর ঔপনিবেশিক আঘাতের একটি রূপ প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনকে কেন্দ্র করে। তাতে বাঙালি সত্তার প্রতিবাদের যে দেশাত্মবোধক বলয় তৈরি হয়, তারই গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ‘ছায়ানট’ নামের প্রতিষ্ঠানটির (১৯৬১)। বাঙালিত্বের চেতনা তীব্র হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

এর মধ্যে দেশে স্বাধিকার আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার পটভূমিতে বাংলা নববর্ষ পালনে ছায়ানট একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। ১৯৬৭ সালে বাংলা নববর্ষের প্রভাতে রমনার অশ্বত্থমূলে তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে যে ধারার সূচনা করে, তা বাংলাদেশের বাঙালিদের নববর্ষ উদ্যাপনকে নতুন তাত্পর্য দিয়েছে। প্রতিবছর তারা যেমন নিয়মিতভাবে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তেমনি সারা দেশে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের একটি জাতি-ধর্ম-বর্ণনিরপেক্ষ ধারাও প্রবলতর হয়েছে।

বাংলাদেশে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ সম্প্রতি বেশ সমালোচনার শিকার। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৪০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনা যে রূপটিতে আবির্ভূত হয়েছিল, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ফলে তা রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৬০-এর দশকে ধর্মীয় নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে তা সর্বজনীনতা পায়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী এক পরাশক্তির বিশ্বপরিবেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থার উত্থানের পটভূমিতে এবং একই সময়ে বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচারমুক্ত দ্বিদলীয় শাসনের পরিবেশে একুশ শতকে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আরেকটি পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এসব সত্য স্বীকার করেও ছায়ানট-প্রতিষ্ঠিত বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ছায়ানট পূর্ণতররূপে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বজায় রেখেও উপনিবেশবিরোধী সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য নির্মাণ করে প্রকারান্তরে রাজনৈতিক ভূমিকাই পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে একুশের সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, সেটিও সর্বাংশে উপনিবেশবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন; অর্থাৎ বাংলাদেশের সব মানুষকে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করার ক্ষেত্রে—ভাষা আন্দোলন ও বাংলা নববর্ষ—এই দুটি দিবস অসাধারণ দুটি দৃষ্টান্ত।

লক্ষ করার বিষয়, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক যে পূর্ববঙ্গীয় রেনেসাঁ সংঘটিত হয়, তা বাংলাদেশের বাঙালিদের জাতীয় চেতনাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। বাঙালিত্বের প্রশ্নে কলকাতাকেন্দ্রিক সংকীর্ণ ভাবধারা থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালিত্বের ধারণা হয়ে ওঠে অনেক উদার। এই ভাবধারা হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—সবাইকে একীভূত করে। এই উদারতা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গীয় নববর্ষের পূজা-পার্বণসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাধান্য থেকে বাংলাদেশের নববর্ষ মুক্ত—একান্তভাবেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের আরেকটি অগ্রগতি হয়েছে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের ক্ষেত্রেও। ১৯৬০-এর দশকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে যে সংস্কার কমিটি গঠিত হয়, তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কোন মাস কত দিন হবে, এ বিষয়ে যেমন একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি সংস্কারের ধারাও অব্যাহত থাকে। ষোলো শতকে ইউরোপে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা খ্রিষ্টাব্দকে একটি বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেয়। আমাদের দেশের পঞ্জিকা সংস্কারের লক্ষ্যও ছিল তেমনই এক সমন্বয় সাধন। শহীদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি-গঠিত সংস্কার কমিটি ১৯৯৫ সালে ফাল্গুন মাসকে অধিবর্ষ ধরে বঙ্গাব্দের তারিখ ও খ্রিষ্টাব্দের তারিখের মধ্যে একটি স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করে। ফলে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী প্রতিবছর একই খ্রিষ্টীয় তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গাব্দ ও খ্রিষ্টাব্দের তারিখে গরমিলও হচ্ছে না। ভারতেও এমন একটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সনাতন পঞ্জিকাপ্রণেতা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতার মুখে সেই সংস্কার কার্যকর হতে পারেনি।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারায় বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ দিয়ে। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও এর আবেদন শুধু জাতীয় গণ্ডি ছাপিয়ে গেছে। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর জনসংশ্লিষ্টতা, জনমুখিতা, সাংগঠনিক পরম্পরা, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনিরপেক্ষতা, অংশগ্রহণের সর্বজনীনতা প্রভৃতি বিবেচনায় ইউনেসকো এই স্বীকৃতি দেয়। দেশের চারুশিল্পীরা এর আয়োজনে থাকায় চিন্তার মৌলিকত্বে, বিচিত্র মোটিফের প্রতীকী তাত্পর্যে, বর্ণাঢ্যতায়, লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা দ্রুত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুরো দেশে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, জার্মানিতেও এই শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

১৯৫০-এর দশকের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬০-এর দশকে সূচিত বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান প্রভৃতির উদার ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে যে আমরা কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতির ধর্মীয় আবহ থেকে অগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিতে পেরেছি, সেটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সংস্কৃতির শক্তিমত্তার দিক। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সমাজের কোনো কোনো অংশ থেকে যে কিছু সমালোচনা আসেনি, তা নয়। এ বছরও বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। কিন্তু সত্য এই যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের নববর্ষ উদ্যাপনের গৌরবকে আরও প্রভাববিস্তারী করে তুলেছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে কয়েক বছর ধরে কলকাতার সংস্কৃতকর্মীরা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে ঢাকা এভাবে কলকাতাকে নববর্ষের এই সাংস্কৃতিক উৎসবের পথ দেখিয়েছে।

নিজ নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা করেও বৃহত্তর পরিসরে যদি সবাই যুক্ত হতে না পারি, তাহলে আমাদের জাতীয় ঐক্য ব্যাহত হবে। দেশ বা জাতির অগ্রগতির স্বার্থে সব শ্রেণি–ধর্মের মানবের মিলনের সাংস্কৃতিক সূত্র বজায় রাখা জরুরি। বাংলা নববর্ষ সেই মিলনের পথই আমাদের সামনে এনে দেয়। বাংলাদেশের বাঙালিরাই শুধু নন, এর সঙ্গে যুক্ত হন আদিবাসীরাও। এমন মিলনসূত্র আর কোনো উত্সবে নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নববর্ষকে রাঙাতে হাডুডু খেললেন মানিকগঞ্জের প্রবীণরা
  • সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে ছাত্রদলের বৈশাখী উপহার
  • ড্রোন প্রদর্শনীতে ফুটে উঠল শোষণের খাঁচা ভেঙে জুলাই অভ্যুত্থান
  • বউচি খেলায় ঐতিহ্যের স্মৃতি ফিরল চবিতে
  • নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক: এ বি পার্টি
  • কুমিল্লায় নববর্ষের অনুষ্ঠানে শহীদ মুগ্ধের স্মরণে ১০ হাজার বোতল পানি বিতরণ
  • বৈশাখে চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাস 
  • নববর্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
  • ডিএসসিসির বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ, বৈষম্যহীনতার বার্তা