অপছন্দের জায়গায় যান না, পছন্দের পদ পেতে তদবির
Published: 13th, April 2025 GMT
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরীকে গত ৪ মার্চ আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে বদলি করা হয়। তবে নতুন কর্মস্থলে তিনি যোগ দেননি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর ২৪ মার্চ তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। এর অবস্থান রাজধানীর পুরানা পল্টনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে। নাজনীন কাউসার চৌধুরী সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বসে দপ্তরটির প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে দপ্তরটি পছন্দের তালিকার তলানিতে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পছন্দের পদ না পাওয়ায় নাজনীন কাউসার নতুন কর্মস্থলে যাননি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু নাজনীন কাউসার নন, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই ৩ মাসে অন্তত ৮০ জন কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ পরে বাতিল করা হয়েছে। এ তালিকায় আছেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা। আর বাতিল হওয়া এসব বদলির আদেশ শুধু প্রশাসন ক্যাডারের। জনস্বার্থে বদলির কথা বলা হলেও কর্মকর্তারা তা মানছেন না। সরকারের নির্দেশ অমান্য করছেন।
সরকারি আচরণবিধিতে বলা আছে, কেউ তদবির করতে পারবে না। সরকার যখন কোনো বদলির আদেশ দেবে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি করতে না পারলে সেটি হবে জনপ্রশাসনের ব্যর্থতা।এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিবএ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাজনীন কাউসার ৮ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যে শাখায় (ডব্লিউটিও সেল) রয়েছি, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সেসব কাজ গুছিয়ে এনেছি। আরেকজন কর্মকর্তা এলে তা ধরতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষ আমাকে চেয়েছে। তাই বদলির আদেশ বাতিল করা হয়েছে।’
উল্টো চিত্রও রয়েছে। পছন্দের জায়গায় একবার যেতে পারলে সেখান থেকে আর নড়তে চান না অনেক কর্মকর্তা। তদবির করে সেখানেই থেকে যান। প্রায় ছয় বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন উপসচিব মিলিয়া শারমিন। গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এর দুই দিন পর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, ওপর মহলের তদবিরে মিলিয়া শারমিনের বদলির আদেশ বাতিল করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি তদবির করে অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় বদলি হচ্ছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব মো.
‘লোভনীয়’ পদ ছাড়েন না
কাজের ব্যাপকতা, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে কর্মকর্তাদের কাছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পছন্দের জায়গা। গত তিন মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগের অন্তত পাঁচ কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সব কটি আদেশ বাতিল করতে হয়। যেমন এ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হককে ঢাকা পরিবহন সমন্বয়ক কর্তৃপক্ষে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বদলি করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজমুল আহসান ২০২২ সাল থেকে এ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। দুটি বড় প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তিনি। গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে বিদ্যুৎ বিভাগে বদলি করা হয়। পরে ১৫ জানুয়ারি তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ শরিফুল হককে বিদ্যুৎ বিভাগে বদলি করা হয় গত ২০ মার্চ। পরে ২৪ মার্চ তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বদলির আদেশ যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করেছে, আবার বাতিলও তারা করেছে। কেন করেছে, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি কোনো তদবির করেননি বলে দাবি করেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম কিবরিয়াকে গত ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তবে তিনি যোগ দেননি। পরে আদেশ বাতিল করা হয়। শামীম কিবরিয়াকে পরিকল্পনা কমিশনে বদলি করা হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) আহসান হাবিবকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আওতায় কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজে সহকারী নিয়ন্ত্রক পদে বদলি করা হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি সেখানে যোগ দেননি। তদবির করে পরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) যোগ দেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কোনো কর্মকর্তার বিশেষায়িত জ্ঞানের কারণে তাঁকে দীর্ঘ সময় একটা জায়গায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে যেভাবে কর্মকর্তারা বদলির আদেশ বাতিল করছেন, তা প্রশাসনে বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
পছন্দের পদে যেতে তদবির
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছু কিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে যেতে কর্মকর্তারা ব্যাপক তদবির করেছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি তদবির থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রাজউক, বিপিসি, পেট্রোবাংলা, পিডিবি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সিটি করপোরেশনে যাওয়ার।
বদলির আদেশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যেসব কর্মকর্তা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত, তাঁদের বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু তদবির করে তাঁরা বদলির আদেশ বাতিল করিয়েছেন। কেউ কেউ আবার পছন্দের পদ থেকে সরতে চান না। সে কারণে বদলির আদেশ ঠেকিয়েছেন। কাউকে এমন জায়গায় বদলি করা হয়েছে, যেখানে যেতে তাঁরা আগ্রহী নন। প্রশাসনের একটি বড় অংশ তদবির করে নিজেদের পছন্দের জায়গায় বদলি হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় কর্মকর্তাদের অসদাচরণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো কর্মকর্তা আইনসংগত কারণ ছাড়া সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র ও নির্দেশ অবজ্ঞা করেন, সেটি অসদাচরণের মধ্যে পড়বে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে কিছু কর্মকর্তা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বদলির জন্য উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব ও অন্যান্য পর্যায় হতে আধা সরকারিপত্র/মৌখিকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করছেন। যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২০-এর পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।’ ভবিষ্যতে কেউ পছন্দ অনুযায়ী বদলির জন্য তদবির করলে তাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ওই নির্দেশনায়।
তবে এরপরও কর্মকর্তাদের পছন্দ অনুযায়ী বদলির তদবির ঠেকানো যাচ্ছে না। তদবির করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না।
‘বদলির আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে’
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার ৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন কর্মকর্তাকে বদলি করার পর সে আদেশ বাতিল করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ও অদক্ষতা। এত বেশি বদলির আদেশ বাতিল হওয়া প্রশাসনের ওপর অনাস্থা তৈরি হয়। খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। যে কর্মকর্তাকে আপনি বদলি করে সরাতে পারবেন না, তাহলে তাঁকে বদলি করেন কেন?’
প্রশাসনে চাকরি বদলির উল্লেখ করে আবদুল আউয়াল বলেন, সরকার যেখানে বদলি করবে, সেখানে যেতে হবে। সরকারি আচরণবিধিতে বলা আছে, কেউ তদবির করতে পারবেন না। সরকার যখন কোনো বদলির আদেশ দেবে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি করতে না পারলে সেটি হবে জনপ্রশাসনের ব্যর্থতা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র কর মকর ত ক ন কর মকর ত কর মকর ত র প রথম আল ক দ র পছন দ কর ত র করছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অপছন্দের জায়গায় যান না, পছন্দের পদ পেতে তদবির
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরীকে গত ৪ মার্চ আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে বদলি করা হয়। তবে নতুন কর্মস্থলে তিনি যোগ দেননি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর ২৪ মার্চ তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। এর অবস্থান রাজধানীর পুরানা পল্টনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে। নাজনীন কাউসার চৌধুরী সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বসে দপ্তরটির প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে দপ্তরটি পছন্দের তালিকার তলানিতে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পছন্দের পদ না পাওয়ায় নাজনীন কাউসার নতুন কর্মস্থলে যাননি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু নাজনীন কাউসার নন, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই ৩ মাসে অন্তত ৮০ জন কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ পরে বাতিল করা হয়েছে। এ তালিকায় আছেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা। আর বাতিল হওয়া এসব বদলির আদেশ শুধু প্রশাসন ক্যাডারের। জনস্বার্থে বদলির কথা বলা হলেও কর্মকর্তারা তা মানছেন না। সরকারের নির্দেশ অমান্য করছেন।
সরকারি আচরণবিধিতে বলা আছে, কেউ তদবির করতে পারবে না। সরকার যখন কোনো বদলির আদেশ দেবে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি করতে না পারলে সেটি হবে জনপ্রশাসনের ব্যর্থতা।এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিবএ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাজনীন কাউসার ৮ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যে শাখায় (ডব্লিউটিও সেল) রয়েছি, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সেসব কাজ গুছিয়ে এনেছি। আরেকজন কর্মকর্তা এলে তা ধরতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষ আমাকে চেয়েছে। তাই বদলির আদেশ বাতিল করা হয়েছে।’
উল্টো চিত্রও রয়েছে। পছন্দের জায়গায় একবার যেতে পারলে সেখান থেকে আর নড়তে চান না অনেক কর্মকর্তা। তদবির করে সেখানেই থেকে যান। প্রায় ছয় বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন উপসচিব মিলিয়া শারমিন। গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এর দুই দিন পর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, ওপর মহলের তদবিরে মিলিয়া শারমিনের বদলির আদেশ বাতিল করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি তদবির করে অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় বদলি হচ্ছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক ৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তাদের পছন্দের দপ্তর থাকাটা স্বাভাবিক। সেটি তাঁরা চাইতে পারেন। তবে সব সময় তাঁদের কথা শোনা হয় না। তিনি আরও বলেন, দেখা যায়, কোনো একটি মন্ত্রণালয় থেকে কাউকে বদলি করা হলে সেখানকার ঊর্ধ্বতন কেউ তাঁকে রেখে দিতে অনুরোধ করেন। তখন বদলির আদেশ বাতিল করতে হয়। বাস্তবতা মেনেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হয়।
‘লোভনীয়’ পদ ছাড়েন না
কাজের ব্যাপকতা, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে কর্মকর্তাদের কাছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পছন্দের জায়গা। গত তিন মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগের অন্তত পাঁচ কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সব কটি আদেশ বাতিল করতে হয়। যেমন এ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হককে ঢাকা পরিবহন সমন্বয়ক কর্তৃপক্ষে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বদলি করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজমুল আহসান ২০২২ সাল থেকে এ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। দুটি বড় প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তিনি। গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে বিদ্যুৎ বিভাগে বদলি করা হয়। পরে ১৫ জানুয়ারি তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ শরিফুল হককে বিদ্যুৎ বিভাগে বদলি করা হয় গত ২০ মার্চ। পরে ২৪ মার্চ তাঁর বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বদলির আদেশ যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করেছে, আবার বাতিলও তারা করেছে। কেন করেছে, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি কোনো তদবির করেননি বলে দাবি করেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম কিবরিয়াকে গত ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তবে তিনি যোগ দেননি। পরে আদেশ বাতিল করা হয়। শামীম কিবরিয়াকে পরিকল্পনা কমিশনে বদলি করা হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) আহসান হাবিবকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আওতায় কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজে সহকারী নিয়ন্ত্রক পদে বদলি করা হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি সেখানে যোগ দেননি। তদবির করে পরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) যোগ দেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কোনো কর্মকর্তার বিশেষায়িত জ্ঞানের কারণে তাঁকে দীর্ঘ সময় একটা জায়গায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে যেভাবে কর্মকর্তারা বদলির আদেশ বাতিল করছেন, তা প্রশাসনে বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
পছন্দের পদে যেতে তদবির
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছু কিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে যেতে কর্মকর্তারা ব্যাপক তদবির করেছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি তদবির থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রাজউক, বিপিসি, পেট্রোবাংলা, পিডিবি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সিটি করপোরেশনে যাওয়ার।
বদলির আদেশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যেসব কর্মকর্তা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত, তাঁদের বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু তদবির করে তাঁরা বদলির আদেশ বাতিল করিয়েছেন। কেউ কেউ আবার পছন্দের পদ থেকে সরতে চান না। সে কারণে বদলির আদেশ ঠেকিয়েছেন। কাউকে এমন জায়গায় বদলি করা হয়েছে, যেখানে যেতে তাঁরা আগ্রহী নন। প্রশাসনের একটি বড় অংশ তদবির করে নিজেদের পছন্দের জায়গায় বদলি হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় কর্মকর্তাদের অসদাচরণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো কর্মকর্তা আইনসংগত কারণ ছাড়া সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র ও নির্দেশ অবজ্ঞা করেন, সেটি অসদাচরণের মধ্যে পড়বে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে কিছু কর্মকর্তা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বদলির জন্য উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব ও অন্যান্য পর্যায় হতে আধা সরকারিপত্র/মৌখিকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করছেন। যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২০-এর পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।’ ভবিষ্যতে কেউ পছন্দ অনুযায়ী বদলির জন্য তদবির করলে তাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ওই নির্দেশনায়।
তবে এরপরও কর্মকর্তাদের পছন্দ অনুযায়ী বদলির তদবির ঠেকানো যাচ্ছে না। তদবির করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না।
‘বদলির আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে’
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার ৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন কর্মকর্তাকে বদলি করার পর সে আদেশ বাতিল করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ও অদক্ষতা। এত বেশি বদলির আদেশ বাতিল হওয়া প্রশাসনের ওপর অনাস্থা তৈরি হয়। খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। যে কর্মকর্তাকে আপনি বদলি করে সরাতে পারবেন না, তাহলে তাঁকে বদলি করেন কেন?’
প্রশাসনে চাকরি বদলির উল্লেখ করে আবদুল আউয়াল বলেন, সরকার যেখানে বদলি করবে, সেখানে যেতে হবে। সরকারি আচরণবিধিতে বলা আছে, কেউ তদবির করতে পারবেন না। সরকার যখন কোনো বদলির আদেশ দেবে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি করতে না পারলে সেটি হবে জনপ্রশাসনের ব্যর্থতা।