আর্থ-সামাজিক আবেদন ছিল চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখে
Published: 13th, April 2025 GMT
বাংলা নববর্ষ বরণের আর নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হতো গ্রাম-বাংলায়। আর্থ-সামাজিক আবেদন আর প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা ছিল সেই সব দিন। চৈত্র সংক্রান্তির সেসব অনুষ্ঠান এখন অনেকটাই ম্লাণ। প্রাধান্য পেয়েছে পহেলা বৈশাখ। আমরা দেখেছি চৈত্র সংক্রান্তি সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ছিল আর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে প্রাধান্য পেত পহেলা বৈশাখ।
বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর জন্য গ্রাম বাংলায় নানা আয়োজন হতো। গ্রামে মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণ চড়ক ঘোরানো। জীবন্ত মানুষকে বর্ষিতে গাঁথা হতো। তারপর বাঁশের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘোরানো হতো। তাকে আবার আগের দিন না খাইয়ে রাখা হতো। সে আবার ওই ঘূর্ণায়মান অবস্থায় একটি কবুতর দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে, সেটাকে নিচে ফেলে দিত। তারপরে পাঠা বলি হতো, কোনো কোনো জায়গায় মহিষ বলি হতো। বিভিন্ন গ্রামীণ মেলা হতো। বিশেষ করে চড়ক উৎসব যেখানে হতো, সেখানে। চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ বিশেষ জায়গা পূজাও হতো আবার মেলাও হতো। ওইসব মেলায় গৃহস্থলির জিনিসপত্র পাওয়া যেত। এই চড়ক উৎসবের আয়োজন করতো হিন্দুরা কিন্তু দৃশ্য উপভোগ করতে সবাই। আবার মেলার আয়োজন করতো হিন্দুরা কিন্তু গৃহস্থলির জিনিসপত্র—হাঁড়ি, পাতিল, কুলা, ডালা, সের এসব কেনার জন্য মুসলিমদেরও সরব উপস্থিতি থাকতো মেলায়। এখন যেমন পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ খাওয়া; এই রীতি তখন ছিল না। তখন চৈত্র সংক্রান্তিকেই মূলত একটা পার্বণ হিসেবে সমাদৃত হতো। মেলাকেন্দ্রিক লাঠিখেলা ঘিরে অসংখ্য মানুষের জমায়েত হতো।
বিশেষ আকর্ষণ ছিল শিব-পার্বতী। একজন শিব সাজতো আরেকজন পার্বতী সাজতো। মেলাটার নাম ছিল শিব-গাজনের মেলা। শিব আর গাজনের ভক্ত নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব; এদেরও আবার প্রতিমূর্তি সাজতো অনেকে। তারপর শিব-পার্বতীর সঙ্গে নেচে চলতো। এরা নেচে নেচে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি যেত। এছাড়াও হতো নীল পূজা, গম্ভীরা পূজা, শিবের গাজন, শাকান্ন।
চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ বিশেষ স্থানে শিরনীর আয়োজন হতো। ল্যাটকা খিচুড়ি, আখের গুঁড়ের ক্ষীর রান্না হতো। কলাপাতায় পরিবেশন করা হতো। মাঠে, স্কুলে কিংবা ক্লাবে এই সব আয়োজন হতো। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে বৈশাখ বরণের একটা প্রস্তুতিও লক্ষ্য করা যেত। ঘর বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হতো। বাড়ির বউ-ঝিরা কাঁচা ঘর লেপে চকচকে করতো। আবার গ্রাম বা মফস্বলের ছোট বড় দোকানগুলো সাজানো হতো। কারণ পরের দিন হালখাতা। হালখাতা উপলক্ষ্যে বাড়ির পুরুষেরা পণ্য বেচা বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করতো। কারণ প্রত্যেকেরই একটা চেষ্টা থাকতো দোকানের বাকি শোধ করার। পুরো টাকা শোধ করতে না পারলেও যতোটা সম্ভব শোধ করতো তারা। হালখাতা উপলক্ষ্যে দোকানগুলোতে নতুন লাল টালিখাতায় দেনা-পাওনার হিসাব লেখা শুরু হতো। পহেলা বৈশাখে দোকানদাররা সাধারণত বাকি বিক্রি করতো না। তারা বলতো, বছরের প্রথম দিনে বাকি দেবেন না। হালখাতা উপলক্ষ্যে বাড়ির ছোট সদস্যরাও আনন্দিত হতো। তারা বড়দের হাত ধরে হালখাতা খেতে যেত। রসগোল্লা, পুরি, জিলাপি পেয়ে খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতো। বৈশাখে গ্রাম বাংলার অর্থনীতিতে যোগ হতো নতুন গতি। তবে সবশেষে হালখাতা একটি সামাজিক অনুষ্ঠানও। এই অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর দৃঢ় হতো। সত্যিকার অর্থেই প্রাণ-প্রাচুর্য ছিল সেই সামাজিক সৌহার্দে।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
বিদায় ১৪৩১, আজ চৈত্র সংক্রান্তি
আজ রোববার, ১৩ এপ্রিল, বাংলা ১৪৩১ সন বিদায় নিচ্ছে। এটি চৈত্র মাসের শেষ দিন, বাংলা বছরেরও শেষ দিন, আবার বসন্ত ঋতুরও শেষদিন। দিনটি পরিচিত চৈত্র সংক্রান্তি নামে।
আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। মনে করা হয়, চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন।
আগামীকাল সোমবার (১৪ এপ্রিল) শুরু হবে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩২। ‘জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানি’- এই প্রার্থণায় নতুন সূর্যকে বরণ করবে বাঙালি।
চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
জনশ্রুতি আছে- চৈত্র মাসে স্বামী, সংসার, কৃষি, ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। জিয়ল মাছ (পানিতে জিইয়ে রাখা যায় এমন মাছ) যেমন- কৈ শিং মাগুরের ঝোল করে খেতেন তারা। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতো খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা।
গ্রামের নারীরা এ সময় সাজগোছ করেন ঘরদোর। মাটির ঘর লেপন করে ঝকঝকে করেন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে রাখাল। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্না। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলে আপ্যায়ন। গ্রামের গৃহস্থরা এ দিন নতুন জামা কাপড় পরে একে অন্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। একসময় এমনই ছিলো চৈত্রসংক্রান্তির ধরণ।
এই দিনে ব্যবসায়ীরাও পালন করেন বছর বিদায়ের অনুষ্ঠান। শুচি ও পবিত্রভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করে সাজানো হয় নতুনভাবে। পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন খাতা খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, যাকে বলা হয় 'হালখাতা'। নতুন বছরের প্রথম দিনে এই হালখাতা খোলা হয়, আর ক্রেতাদের আপ্যায়ন করা হয় মিষ্টান্ন দিয়ে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির মেলার আয়োজন হয়। অনেক পরিবার এই উপলক্ষে মেয়ের জামাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নতুন পোশাক পরিধানের রীতিও এই উৎসবের একটি অনন্য অংশ, যা বহুদিন ধরেই প্রচলিত।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে আজ (রবিবার) সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয়েছে ‘ব্যান্ড শো’র। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদলগুলো।
ঢাকা/টিপু