দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামছে বামপন্থিরা
Published: 13th, April 2025 GMT
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাম রাজনৈতিক দলগুলো। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করতে চায় তারা। প্রাথমিক কর্মসূচি হিসেবে জনমত তৈরিতে সারাদেশ সফর, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ এবং ঢাকায় বৃহত্তর সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার চিন্তাও করছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা।
রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে, বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছর জুনে নির্বাচন হবে– সরকারের এমন বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছে না বাম দলগুলো। এ বক্তব্যের মাধ্যমে সরকার কালক্ষেপণ করছে বলে মনে করছে তারা।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের কয়েকজন নেতা জানান, দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রাখতে বড় ধরনের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সোচ্চার হতে চান তারা। যুগপৎ ধারার আন্দোলন শুরুর বিষয়ে তারা অনেক দিন ধরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে তারা জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন।
এই জোটে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) ছয়টি দল রয়েছে। সূত্র জানায়, ঈদের কয়েকদিন আগে গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড.
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির সঙ্গেও কথা বলেছেন বাম জোটের নেতারা। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের এই নেতারা এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে দাবি করেন বাম জোটের নেতারা।
অন্যদিকে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ধারায় বিএনপিকেও যুক্ত করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বাম নেতাদের মধ্যে। কয়েকজন নেতা বলছেন, দেশের বিদ্যমান সংকট নিরসনে দ্রুত নির্বাচনের দাবিসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতির সঙ্গে বাম দলগুলোর বক্তব্যের অনেকটাই মিল রয়েছে। তাই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে বাম নেতাদের।
বামপন্থি নেতারা আরও বলছেন, তারা বারবারই দাবি করে আসছেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু করেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হোক। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়। সরকার ঠিক কতটুকু সংস্কার করতে চায়, সেটাও স্পষ্ট করছে না। ‘কম সংস্কার’ ও ‘বেশি সংস্কার’– এমন বক্তব্য সামনে নিয়ে এসে এর দায়দায়িত্ব অনেকটাই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে।
সূত্র জানায়, আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে প্রাথমিকভাবে সারাদেশে জেলা-উপজেলা সফর করে সভা-সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা চলছে। এরপর বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ শেষে ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করার আলোচনা রয়েছে বাম দলগুলোর মধ্যে। এরপরও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে আরও বড় কর্মসূচিতে যাবে তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া সমকালকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের সঙ্গে আগের আলোচনায় বলেছিলেন, ন্যূনতম সংস্কারের ভিত্তিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। কিন্তু সর্বশেষ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি ভিন্ন কথা বলেছেন। তবে আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। আমরা মনে করি, ন্যূনতম সংস্কার করে সরকারের দ্রুত নির্বাচনে চলে যাওয়া উচিত। সেই দাবি আদায়ে আমাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য রয়েছে।’ চলতি মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানান শরীফ নুরুল আম্বিয়া।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতার সুযোগে অন্ধকারের শক্তি যে কোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই আর দেরি না করে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করাই সরকারের এখনকার জরুরি কর্তব্য। সরকার এতে অহেতুক বিলম্ব করলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, সংস্কার ও সুনির্দিষ্ট তারিখসহ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে সরকারের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। সরকার ‘ভেক’ কথাবার্তা বলে সংশয় ও ধোঁয়াশা তৈরি করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার দরকার সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র অবস থ ন সরক র র দলগ ল র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
গাজা জেনোসাইড মামলায় বাংলাদেশের ‘ইন্টারভেনশন’
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সাম্প্রতিক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের গত ৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক নিন্দা জ্ঞাপনের ঘটনায় বিগত সরকারের সময় করা একটি প্রতিশ্রুতির কথা সামনে এসেছে। ২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জেনোসাইড কনভেনশনের কিছু প্রবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মামলা করে। এ মামলা করার ১৬ দিন পর অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রেস স্টেটমেন্ট দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ এ মামলায় ‘ইন্টারভেনশন’ করতে আগ্রহী। এর আগে ১৩টি রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করতে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে বিগত দেড় বছর নীরব থেকেছে। গাজায় সহিংসতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকার এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাধ্যবাধকতাকে উল্লেখ করে আসছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ অনুসারে বাংলাদেশ ‘সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ এর আগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত চারটি অ্যাডভাইজরি অপিনিয়নের কার্যপ্রণালিতে অংশগ্রহণ করেছে। তা ছাড়া ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া ও জিবুতির সঙ্গে যৌথভাবে প্যালেস্টাইন ইস্যুকে আইসিসির কাছে তদন্তের আহ্বান করে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন এতদিন ধরে তার ইন্টারভেনশনের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে নীরব– তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
আইসিজেতে সাম্প্রতিক বেশ কিছু জেনোসাইড কনভেনশন সম্পর্কিত মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলা ও ইউক্রেনীয় জেনোসাইড অভিযোগ মামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্র ইন্টারভেনশনের আগ্রহ দেখিয়েছে। গাজা জেনোসাইড মামলাতেও বেশ কিছু রাষ্ট্র ইন্টারভেনশন করবে বলে অনুমান করা হচ্ছিল। তাই ১৩টি রাষ্ট্রের ইন্টারভেনশনের ইচ্ছা প্রকাশ মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়।
এর আগে আইসিজের কোনো মামলায় ইন্টারভেনশন করেনি। রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ হাতছাড়া করে। তাই গাজা জেনোসাইড মামলায় বাংলাদেশের প্রকৃতি ও বিস্তার কী হবে, সে সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। তবে আইসিজের আইনি কাঠামো ও ইন্টারভেনশন-সংক্রান্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের নজির এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইন্টারভেনশন বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রিজার্ভেশন প্রদান করায় বাংলাদেশের ইন্টারভেনশনের বিষয় একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যতীত সব অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইন্টারভেনশন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আইসিজে এ মামলার প্রভিশনাল মেজারস আদেশে প্রাথমিকভাবে আদালতের এখতিয়ার নির্ধারণ করেছেন। অন্যদিকে এ মামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলার সাদৃশ্য থাকায় এবং উক্ত মামলায় মিয়ানমারের দাখিলকৃত প্রিলিমিনারি অবজেকশনস খারিজ হওয়ায় আইসিজে ইসরায়েলের প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে ইতিবাচকভাবে রায় দেবেন বলে ধারণা করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে ইসরায়েল যদি প্রিলিমিনারি অবজেকশনস দায়ের করে, বাংলাদেশ এই ইন্টারভেনশন দায়ের করার জন্য দুই বছর অতিরিক্ত সময় পাবে। কিন্তু গাজা জেনোসাইড মামলার রাজনৈতিক ও আইনি গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ সরকারকে অতি সত্বর ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত।
একই সঙ্গে বাংলাদেশকে তার ইন্টারভেনশনের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়াদি নির্ধারণ করতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগগুলো জেনোসাইড কনভেনশনের প্রথম চারটি অনুচ্ছেদ-সংক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আইসিজেতে ইন্টারভেনশন করার অনুমতি পেতে সমর্থ হলে আইসিজে বাংলাদেশকে এ মামলা-সংক্রান্ত সব গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য নথি প্রদান করতে দায়বদ্ধ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ইন্টারভেনশনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যেহেতু বেশ কিছু রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করবে; বাংলাদেশকে এমনভাবে ইন্টারভেনশন করা উচিত যাতে এই মামলায় উক্ত ইন্টারভেনশন প্রভাব ফেলতে পারে।
গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে এক পাশে রেখে বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত। যদিও আইসিজে ৬৩ নম্বর অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত ইন্টারভেনশনের আবেদনের বৈধতা নিরীক্ষা করে; তবে এ পর্যন্ত অধিকাংশ আবেদন গৃহীত হয়েছে। যেহেতু ইতোমধ্যে ১৩টি রাষ্ট্র গাজা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার আবেদন করেছে; বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা সমুচিত হবে না। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতাকে পুনর্ব্যক্ত করে আইসিজের কাছে ইন্টারভেনশনের আবেদন জমাদানের সময়সীমা ঘোষণা করা উচিত।
কাজী ওমর ফয়সাল: আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) আইনের প্রভাষক
foysal.quazi@gmail.com