‘বাতাস ওঠে, বৃষ্টি নামে/ আকাশ-জোড়া মেঘলা খামে...’। দিনটা চৈত্রের হলেও সকালটা এ রকমই ছিল বৃষ্টিভেজা, মেঘলা মেঘলা। ঝিরিঝিরি, দমকা হাওয়া বইছে। মেঘলা খামের মতো মেঘ ভাসছে আকাশে। হঠাৎ করে হালকা ফোঁটায়, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসছে। অনেক দিনের তৃষ্ণার্ত মাটি, বুক পেতে টেনে নিয়েছে বৃষ্টির জল। গাছের পাতায় পাতায় তখন বৃষ্টির গান। পাতারা অবিরল বৃষ্টিতে ধুলাবালু মুছে দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত স্নান সেরে সবুজ হয়ে উঠছে, লাবণ্য ফুটছে গাছে গাছে।

শীতের দীর্ঘ সময় গেছে। তারপর এসেছে ফাল্গুন–চৈত্র মাস। বসন্তজুড়ে পাতা ঝরে পড়েছে। গাছে গাছে পাতারা খয়েরি রং ধরেছে, ধূসর হয়েছে। তত দিনে চৈত্রের গরম ছড়িয়ে গেছে প্রকৃতিতে, বাতাসে। ধীরে ধীরে মানুষ, প্রকৃতি সবাই বৃষ্টিকাতর হয়ে পড়েছে। টানা খরা ফসলের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। মৌসুমি বিভিন্ন জাতের ফসলের ফুল, কুঁড়ি ঝরে পড়ছে। শুকিয়ে মরছে চায়ের গাছ। মানুষের মধ্যে গরমে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। একটু বৃষ্টি, একটু শীতল জলের আশা সবাইকে অস্থির করে তুলছে, চাতক পাখি করে তুলছে।

এ রকম সময়ে কদিন থেকে আকাশে মেঘ উঠছে, ভেসে বেড়ায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে। বৃষ্টির দেশ থেকে আসা এই মেঘ। তবু তেমন করে বৃষ্টি ঝরে না। সমুদ্রে পালের নৌকার মতো এই মেঘ একটা সময় অনন্তে হারিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই বৃষ্টি এসেছিল শুক্রবার শেষ রাতে, ঝরেছে পরদিন শনিবার পর্যন্ত।

অনেকটা সময় ধরে গাছপালা অবাধ জলের ধারায় শরীর মেলে স্নান সেরে নিয়েছে। শরীরভরা দীর্ঘদিনের জমে থাকা এত ধুলাবালু, জলের টানে ধুয়েমুছে গেছে। পাতারা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় নেচে নেচে উঠেছে। চৈত্রে অমন বৃষ্টির স্পর্শ প্রাণ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে গাছে গাছে। শান্ত, নিরিবিলি সকালটাতে তখন আর কিছু ছিল না, ছিল শুধু বৃষ্টির গান।

সকালের ওই সময়ে অন্য অনেক স্থানের মতো মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গণ জলের আনন্দে হয়ে উঠেছিল একটুকরা ভেজা উঠান। ওই উঠানের কাছে পুকুরের পাড়জুড়ে নারকেল, রুদ্রপলাশ, কদমসহ নানা জাতের গাছ তপ্ত শরীর জুড়াতে দাঁড়িয়ে ভিজেছে। জীবনানন্দ দাশের ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ/ কেমন সবুজ পাতা.

..’, এ রকমই অনেকটা সময় ধরে শুধু বৃষ্টি, সঙ্গে হাওয়া, আর কিছু ছিল না। তারপর যখন বৃষ্টি থেমেছে, তখন বোঝা যায়, বাংলার অপরূপ রূপ কতভাবে আছে, বৃষ্টিকে পেয়ে আরও খুলে গেছে গাছে গাছে। গাছের পাতারা তখন আর ধুলায় ম্লান নেই। চকচক করা লাবণ্য পাতার সংসারে, গাছে গাছে অসংখ্য পাতার কোলাহল। মৃদু হাওয়ায় সেই লাবণ্য কুমারীরা আনন্দে নাচছে তখন।

এই বৃষ্টি ছিল অনেক চাওয়ার, অনেক প্রত্যাশার। মৌলভীবাজারের তিলকপুর চা-বাগানের বাসিন্দা মিন্টু দেশওয়ারার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এই বৃষ্টি চা-বাগানের জন্য অনেক উপকারী, খুব দরকার ছিল। অনেক চা-বাগানেই জলাধার নেই, সেচের ব্যবস্থা নেই। জলাধার থাকলে বাতাসের সঙ্গেও কিছু জল গিয়ে চা-গাছে মেশে। পর্যাপ্ত ছায়াবৃক্ষ নেই। যে ছায়াবৃক্ষ শুধু চা-গাছকে ছায়াই দেয় না, অনেক পানি ধারণ করে। খরায় চা-গাছের পাতারা মরতে শুরু করেছে। মাকড়সহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। চা-পাতার উৎপাদন ব্যাহত হলে শুধু যে বাগানমালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা নয়; চা-শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। পাতা কম হলে শ্রমিকদের আয়রোজগার কমে যায়। এই বৃষ্টিতে এখন চা-গাছে নতুন দুটি পাতা একটি কুঁড়ি বেরিয়ে আসবে।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর তখনো আকাশে মেঘবালিকাদের ভেসে বেড়ানোর ক্লান্তি নেই। ভাঙা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রোদ নেমেছে। খানিক আগের বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া বটের পাতা, জারুল-হিজলের গাছ তখনো ভিজে আছে। যেদিকেই চোখ যায় সবুজ লাবণ্য চকচক করছে, উপচে পড়ছে। এখানে প্রকৃতি এ রকমই, ক্রমে অদল-বদলে তারা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কাছাকাছি থাকে। ফুলে, ফসলে, সৌন্দর্যে মানুষেরই জীবনের অংশ হয়ে থাকে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মৌলভীবাজারে বৃষ্টিতে লাবণ্য ফুটছে গাছে গাছে

‘বাতাস ওঠে, বৃষ্টি নামে/ আকাশ-জোড়া মেঘলা খামে...’। দিনটা চৈত্রের হলেও সকালটা এ রকমই ছিল বৃষ্টিভেজা, মেঘলা মেঘলা। ঝিরিঝিরি, দমকা হাওয়া বইছে। মেঘলা খামের মতো মেঘ ভাসছে আকাশে। হঠাৎ করে হালকা ফোঁটায়, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসছে। অনেক দিনের তৃষ্ণার্ত মাটি, বুক পেতে টেনে নিয়েছে বৃষ্টির জল। গাছের পাতায় পাতায় তখন বৃষ্টির গান। পাতারা অবিরল বৃষ্টিতে ধুলাবালু মুছে দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত স্নান সেরে সবুজ হয়ে উঠছে, লাবণ্য ফুটছে গাছে গাছে।

শীতের দীর্ঘ সময় গেছে। তারপর এসেছে ফাল্গুন–চৈত্র মাস। বসন্তজুড়ে পাতা ঝরে পড়েছে। গাছে গাছে পাতারা খয়েরি রং ধরেছে, ধূসর হয়েছে। তত দিনে চৈত্রের গরম ছড়িয়ে গেছে প্রকৃতিতে, বাতাসে। ধীরে ধীরে মানুষ, প্রকৃতি সবাই বৃষ্টিকাতর হয়ে পড়েছে। টানা খরা ফসলের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। মৌসুমি বিভিন্ন জাতের ফসলের ফুল, কুঁড়ি ঝরে পড়ছে। শুকিয়ে মরছে চায়ের গাছ। মানুষের মধ্যে গরমে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। একটু বৃষ্টি, একটু শীতল জলের আশা সবাইকে অস্থির করে তুলছে, চাতক পাখি করে তুলছে।

এ রকম সময়ে কদিন থেকে আকাশে মেঘ উঠছে, ভেসে বেড়ায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে। বৃষ্টির দেশ থেকে আসা এই মেঘ। তবু তেমন করে বৃষ্টি ঝরে না। সমুদ্রে পালের নৌকার মতো এই মেঘ একটা সময় অনন্তে হারিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই বৃষ্টি এসেছিল শুক্রবার শেষ রাতে, ঝরেছে পরদিন শনিবার পর্যন্ত।

অনেকটা সময় ধরে গাছপালা অবাধ জলের ধারায় শরীর মেলে স্নান সেরে নিয়েছে। শরীরভরা দীর্ঘদিনের জমে থাকা এত ধুলাবালু, জলের টানে ধুয়েমুছে গেছে। পাতারা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় নেচে নেচে উঠেছে। চৈত্রে অমন বৃষ্টির স্পর্শ প্রাণ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে গাছে গাছে। শান্ত, নিরিবিলি সকালটাতে তখন আর কিছু ছিল না, ছিল শুধু বৃষ্টির গান।

সকালের ওই সময়ে অন্য অনেক স্থানের মতো মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গণ জলের আনন্দে হয়ে উঠেছিল একটুকরা ভেজা উঠান। ওই উঠানের কাছে পুকুরের পাড়জুড়ে নারকেল, রুদ্রপলাশ, কদমসহ নানা জাতের গাছ তপ্ত শরীর জুড়াতে দাঁড়িয়ে ভিজেছে। জীবনানন্দ দাশের ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ/ কেমন সবুজ পাতা...’, এ রকমই অনেকটা সময় ধরে শুধু বৃষ্টি, সঙ্গে হাওয়া, আর কিছু ছিল না। তারপর যখন বৃষ্টি থেমেছে, তখন বোঝা যায়, বাংলার অপরূপ রূপ কতভাবে আছে, বৃষ্টিকে পেয়ে আরও খুলে গেছে গাছে গাছে। গাছের পাতারা তখন আর ধুলায় ম্লান নেই। চকচক করা লাবণ্য পাতার সংসারে, গাছে গাছে অসংখ্য পাতার কোলাহল। মৃদু হাওয়ায় সেই লাবণ্য কুমারীরা আনন্দে নাচছে তখন।

এই বৃষ্টি ছিল অনেক চাওয়ার, অনেক প্রত্যাশার। মৌলভীবাজারের তিলকপুর চা-বাগানের বাসিন্দা মিন্টু দেশওয়ারার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এই বৃষ্টি চা-বাগানের জন্য অনেক উপকারী, খুব দরকার ছিল। অনেক চা-বাগানেই জলাধার নেই, সেচের ব্যবস্থা নেই। জলাধার থাকলে বাতাসের সঙ্গেও কিছু জল গিয়ে চা-গাছে মেশে। পর্যাপ্ত ছায়াবৃক্ষ নেই। যে ছায়াবৃক্ষ শুধু চা-গাছকে ছায়াই দেয় না, অনেক পানি ধারণ করে। খরায় চা-গাছের পাতারা মরতে শুরু করেছে। মাকড়সহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। চা-পাতার উৎপাদন ব্যাহত হলে শুধু যে বাগানমালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা নয়; চা-শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। পাতা কম হলে শ্রমিকদের আয়রোজগার কমে যায়। এই বৃষ্টিতে এখন চা-গাছে নতুন দুটি পাতা একটি কুঁড়ি বেরিয়ে আসবে।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর তখনো আকাশে মেঘবালিকাদের ভেসে বেড়ানোর ক্লান্তি নেই। ভাঙা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রোদ নেমেছে। খানিক আগের বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া বটের পাতা, জারুল-হিজলের গাছ তখনো ভিজে আছে। যেদিকেই চোখ যায় সবুজ লাবণ্য চকচক করছে, উপচে পড়ছে। এখানে প্রকৃতি এ রকমই, ক্রমে অদল-বদলে তারা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কাছাকাছি থাকে। ফুলে, ফসলে, সৌন্দর্যে মানুষেরই জীবনের অংশ হয়ে থাকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ