রাউজানে সহিংসতার পরম্পরা কি চলতেই থাকবে
Published: 12th, April 2025 GMT
গত ছয় মাসে চট্টগ্রামের রাউজানে রাজনৈতিক বিরোধে খুন হয়েছেন ছয়জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন প্রতিপক্ষের হামলায়, আর বাকি চারজনের মৃত্যু হয়েছে বিএনপির উপদলীয় কোন্দলে। অন্তর্দলীয় সংঘাতে আহত মানুষের সংখ্যা দুই শতাধিক, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত এক শ জন।
বাহুবলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বোঝা গেল, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কুশীলব পাল্টে গেলেও অতীতের সেই ধারা পাল্টায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ ১৬ বছর এ অঞ্চলে একক ‘মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। যদিও সেই ২০০১ সাল থেকে এখানকার সংসদ সদস্য, কিন্তু সে সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি ছিল বলে কিছুটা হীনবল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ফজলে করিম চৌধুরী যে কায়দায় এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার সঙ্গে কেবল ইদানীংকালের তামিল-তেলেগু অ্যাকশন মুভিরই তুলনা চলে।
এলাকার উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন ফজলে করিম। তবে এসব কর্মকাণ্ডে সরকারি নিয়মনীতি বা পরিকল্পনার চেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্যই ছিল বেশি। থানা-পুলিশ বা প্রশাসনের ভূমিকা ছিল সামান্যই। অনেকটা আগেকার দিনের রাজা-বাদশাহদের মতো ‘প্রজাদের কল্যাণ’–এর (?) যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। নিজের খেয়ালখুশি কীভাবে চরিতার্থ করতেন, একটি ছোট উদাহরণ দিলে তা স্পষ্ট হবে। হঠাৎ খেয়াল চাপল রাউজানকে ‘পিংক সিটি’র আদলে গড়ে তুলবেন। ব্যস, তাঁর নির্দেশে গাছের গোড়ালি থেকে টিনের চালা, বাঁশবেড়া, দোকানের সাইনবোর্ড থেকে বহুতল ভবনের দেয়াল—সর্বত্র গোলাপি রঙের ছড়াছড়ি। এমনকি এখানকার মানুষের নিজের বাড়ির দেয়ালের রং পছন্দ করার স্বাধীনতাও ছিল না।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন ফজলে করিম। অনেকেরই ধারণা ছিল, এবার হয়তো রাউজানবাসী সন্ত্রাস-সহিংসতা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু যুগের পর যুগ চলে আসা সহিংসতার পরম্পরা থেকে মুক্তি মিলল না রাউজানের মানুষেররাউজানে নিজের এই ‘হুকুমত’ প্রতিষ্ঠার জন্য ফজলে করিমকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ সহিংস পথ। একসময়ের প্রবল প্রতাপান্বিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর একসময়ের ডানহাত ও আপন চাচাতো ভাই ফজলে করিম বিরোধে জড়িয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে।
সালাউদ্দিন কাদের ও তাঁর ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের এনডিপি থেকে জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, আর আওয়ামী লীগে ভিড়েছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী। অথচ সালাউদ্দিন তো বটেই, ফজলে করিমের বিরুদ্ধেও ছিল বাবর-মুজিবসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মী হত্যার অভিযোগ।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রাউজানে বিএনপির প্রার্থী গিয়াসউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার পর ফজলে করিম তাঁর এককালের গুরু সাকা চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শুরু করেন। ওই সময় এই দুই চাচাতো ভাইয়ের পরস্পরের দিকে আঙুল তুলে মুখোমুখি বচসার একটি ছবি দেশের প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিনই অনেকে অনুমান করেছিলেন, রাউজানে সালাউদ্দিন কাদেরের একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’–এর দিন শেষ হয়ে এল। সেবার (১৯৯৬) সালাউদ্দিন-গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারলেও ২০০১ সালে সারা দেশে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির মধ্যেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ফজলে করিম। এলাকায় তখন থেকেই নিজের দাপট দেখাতে শুরু করেন তিনি। ২০০৯ সালে তাঁর দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই দাপটের চূড়ান্ত রূপ দেখতে থাকে এলাকাবাসী।
এখানে সে রকম দু-একটি ঘটনার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ফজলে করিম ভিন্নমতাবলম্বী বা তাঁর অপছন্দের মানুষকে এলাকায় না আসার হুকুম জারি করতেন। এ আদেশ অমান্য করলে মৃত্যু অবধারিত। যেমন ২০১৩ সালে তাঁর আদেশ অমান্য করে এলাকায় আসার কারণে যুবদলের দুই কর্মীকে পিটিয়ে মেরেছিল ফজলে করিমের ক্যাডাররা। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এক নেতা নবজাতক সন্তানকে দেখার জন্য রাউজানে এলে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে সারা রাত নির্যাতন করে। ভোরে কর্ণফুলীর তীরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। ২০২৪ সালে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে এসেছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা এক প্রবাসী। জুমার নামাজের পর মসজিদ থেকে মারতে মারতে বের করে মসজিদ প্রাঙ্গণেই সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
মুনিরিয়া যুব-তবলিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে হাজারো ভক্ত-সমর্থককে এলাকাছাড়া করেন ফজলে করিম। তাঁর নির্দেশে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় সংগঠনটির ৪৬টি কার্যালয়।
শুধু যে বিরুদ্ধপক্ষের ওপর খড়্গহস্ত ছিলেন, তা নয়; দলের ভেতরেও তাঁর অপছন্দের লোকদের শায়েস্তা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন তাঁর কথার অবাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন দেবাশীষ পালিত। তিনি মেয়র নির্বাচিত হলেও কখনো রাউজানে যেতে পারেননি। এক দিনের জন্যও মেয়র কার্যালয়ে বসার সুযোগ হয়নি তাঁর।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন ফজলে করিম। অনেকেরই ধারণা ছিল, এবার হয়তো রাউজানবাসী সন্ত্রাস-সহিংসতা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু যুগের পর যুগ চলে আসা সহিংসতার পরম্পরা থেকে মুক্তি মিলল না রাউজানের মানুষের। আবার শুরু হয়েছে এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই।
৫ আগস্টের পর হত্যা-ভাঙচুর-লুটপাটকে মনে হয়েছিল ফজলে করিমের ওপর ক্ষোভের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, অন্তঃকোন্দলীয় সংঘর্ষে হতাহত মানুষের সংখ্যা ততই বেড়েছে। বিএনপির স্থানীয় দুই নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের ও গোলাম আকবর খোন্দকারের সমর্থকেরা জড়িয়ে পড়েছেন সশস্ত্র সংঘর্ষে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে গিয়াস কাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশের উত্তরও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু উন্মত্ত সমর্থকদের থামানোর সদিচ্ছা কি আদৌ আছে কোনো পক্ষের?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ য় সউদ দ ন কর ছ ল ন এল ক য় হয় ছ ন ব এনপ সরক র আওয় ম ন ফজল
এছাড়াও পড়ুন:
‘হাসিনার দোসররা ভোরে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে’
চারুকলায় শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট মোটিফ পুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, “হাসিনার দোসররা ভোরে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে, সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক; তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।”
শনিবার (১২ এপ্রিল) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন ফারুকী।
পোস্টে তিনি লিখেছেন, “এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদের আইনের আওতায় আনব তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়।”
আরো পড়ুন:
নববর্ষের দিন টিএসসি-শাহবাগ মেট্রো স্টেশন ‘সাময়িক বন্ধ থাকবে’
বর্ষবরণে থাকছে ‘অন্ধকার কাল থেকে উত্তীর্ণ হবার বার্তা’
“রাতের এই ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেলো, বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটা চায় না। আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইনড এবং আরও বেশি সংখ্যায় অংশ নেব,” যোগ করেন ফারুকী।
তিনি বলেন, “গত কিছু দিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সব রকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরো অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠল। জুলাই চলমান।”
ঢাকা/রাহাত/রাসেল