পুকুর লুট করে চলে গেলেন অন্যরা, তিনি রয়ে গেলেন একাই, সন্ধ্যায় মিলল তাঁর লাশ
Published: 12th, April 2025 GMT
প্রতীকী ছবি
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অন্নপূর্ণায় বাংলাদেশ
বাবর আলী। ৭ এপ্রিল নেপালের স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ১০টায় ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ পর্বতের চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে উড়ান লাল-সবুজের পতাকা। প্রতি মুহূর্তে তুষারধস আর ওপর থেকে পাথর পড়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অভিযানে পা বাড়ানো এই অভিযাত্রী পথেই দু’জন শেরপার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন। তবু ছুটে চলেছেন স্বপ্নের পথে। ছুয়েছেন অন্নপূর্ণা ১-এর চূড়া। গাইড ফুর্বা অংগেল শেরপাকে নিয়ে স্বপ্ন জয় করা এবং অনিশ্চয়তায় ভরা এই অভিযাত্রার কথা লিখেছেন সারোয়ার সুমন
বাবর আলীর বয়স ৩৪। পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় পর্বতপ্রেমী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন এমবিবিএস। চিকিৎসায় পেশা শুরু করলেও মন বসেনি সেখানে। তাই চাকরি ছেড়ে আজন্ম লালিত স্বপ্নজয়ের পথ বেছে নেন। একে একে ছুটে চলছেন স্বপ্নজয়ের চূড়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় এভারেস্টের পর ৭ এপ্রিল ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ শৃঙ্গ জয় করে সাফল্যের মুকুটে যুক্ত করেছেন গৌরবের নতুন পালক। ভয়ংকর বিপজ্জনক এ পর্বতের চূড়ায় ওঠা প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই কীর্তি গড়েছেন বাবর। মাত্র এক বছর আগে ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে বাবর আলী জয় করেছিলেন এভারেস্ট। একই অভিযানে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছিলেন আরেক পর্বত লোৎসেও।
মিশন অন্নপূর্ণা-১
অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, ‘উচ্চতার দিক থেকে অন্নপূর্ণা-১ বিশ্বের দশম পর্বত। মৃত্যুর হার বিবেচনায় এটি বিশ্বের অন্যতম ‘বিপজ্জনক পর্বত’ হিসেবে পরিচিত। এই দুর্গম অন্নপূর্ণা-১ পর্বতকে জয় করতে গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশ থেকে নেপালের পথে পা বাড়ান বাবর আলী। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে কাঠমান্ডু থেকে পোখারা হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান অন্নপূর্ণা বেইজ ক্যাম্পে। সেখানে একদিন বিশ্রাম নেন। এরপর উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে ক্যাম্প-১ এ (৫২০০ মিটার) দুই রাত এবং ক্যাম্প ২-এ (৫৭০০ মিটার) এক রাত কাটিয়ে আবার ২ এপ্রিল নেমে আসেন বেইজ ক্যাম্পে। গত ৭ এপ্রিল সকালে তিনি পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছান। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টায় নিরাপদে ফেরেন বেইজ ক্যাম্পে। সেখানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন গাইড ফুর্বা অংগেল শেরপা।’
লাল-সবুজের পতাকা হাতে
হলুদ রঙের জ্যাকেটে মোড়া বাবর আলীর পেছনে ধবধবে সাদা বরফ। সামনে কালো রঙের একটি ব্যাগ। তার পাশে লাল-সবুজের পতাকা হাতে বসে আছেন তিনি। চোখে রোদচশমা। মুখে লেগে আছে চির চেনা সেই হাসি। ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার পর্বত অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় ওঠা বাবর আলীর এমন একটি ছবি অনলাইনে প্রকাশ করে ভার্টিকাল ড্রিমারস। বাবরের স্বপ্নের সারথি এই প্রতিষ্ঠান। বিপজ্জনক অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়া বাবর জয় করেছেন সোমবারে। মঙ্গলবার নিরাপদে ফিরেছেন তিনি বেইজ ক্যাম্পেও। সেই তথ্য তুলে ধরে ভার্টিকাল ড্রিমারস লিখেছে– ‘সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ছবি, সেই গর্বের লাল-সবুজ হাতের ছবি; যার জন্য এত অপেক্ষা।’
শীর্ষে পৌঁছাতে ১৭ ঘণ্টা
বেইজ ক্যাম্পে তোলা ছবি দিয়ে ১০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক ওয়ালে বাবর আলী লিখেন–‘অবাক করার এক অভিযান শেষে, পোখারায় পৌঁছেছি। গত ১৭ দিন ধরে, আমি একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলাম! অন্নপূর্ণা-১ আমার শক্তির প্রতিটি অংশ পরীক্ষা করেছে। আমি জানতাম এটি কঠিন হবে। কখনও ভাবিনি অন্নপূর্ণা-১ আমাকে এবং এর ঢাল হিসেবে সবাইকে এভাবে পরীক্ষা করবে! ক্যাম্প ২ এবং ৩ এর মধ্যে মহান কোলোয়ার সবার শ্বাস কেড়ে নিয়েছে। ক্যাম্প ৩-এর ওপরে খাড়া ঢালগুলো একের পর এক দুঃস্বপ্ন ছিল। একবারে প্রায় ১৭০০ মিটার আরোহণ করা কোনো রসিকতার বিষয় ছিল না। শীর্ষে পৌঁছতে ১৭ ঘণ্টা লেগেছে। মোট সামিটের বিড ছিল ২৬ ঘণ্টা! আমার জীবনের দীর্ঘতম সময়। ফেরার পথে পায়ে পাথরের আঘাত পেলাম। সহকর্মী পর্বতারোহী আমার চোখের সামনে তুষারপাত দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। এটি তার আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যাই হোক, ধন্যবাদ সবাইকে আমাকে আপনাদের প্রার্থনায় রাখার জন্য।
উচ্ছ্বসিত পরিবার
বাবর আলীর অন্নপূর্ণা-১ জয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত তাঁর বাবা লিয়াকত আলী ও মা লুৎফুন্নাহার বেগম। লিয়াকত আলী সাহসকে বলেন, ‘পর্বত জয় করতে ভালোবাসে আমার ছেলে। এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের পর এবার অন্নপূর্ণা-১ নামে আরেকটি পর্বত জয় করেছে সে। তার আগে নাকি এই পর্বতে যেতে পারেনি অন্য কোনো বাংলাদেশি। তাই আমরা আনন্দিত।’ বাবরের মা লুৎফুন্নাহার বলেন, ‘বাবর খুবই মেধাবী ছাত্র। চিকিৎসক হিসেবে পেশা শুরু করলেও তার নেশা ছিল ভ্রমণ। তাই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। গত কয়েকদিন অনেক চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় ছিলাম। এখন সেই চিন্তা কিছুটা কমেছে। তারপরও আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। কারণ, বাবর এখনও ফিরে আসেনি আমার বুকে।’
ইতিহাসের খোঁজে
বাবরের আগে ২০১১ ও ২০১২ সালে দু’বার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে মারা যান সজল খালেদ, যিনি পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে পর্বতজয় করেছিলেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর গত ১১ বছরে আর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্টের পথ মাড়াননি। ১১ বছর পর ২০২৪ সালে বাবরের হাত ধরে ফের লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে এভারেস্টের বুকে। তবে অন্নপূর্ণা-১ জয় করে এবারে প্রথম বাংলাদেশি হওয়ার গৌরবটা নিজের করে নিয়েছেন বাবর আলী। একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট ও চতুর্থ উচ্চতম পর্বত মাউন্ট লোৎসের চূড়ায় উঠতে পারেননি কোনো বাংলাদেশি। এভারেস্টের সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার লোৎসেও শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করেন বাবর আলী। যেখানে এখনও পর্যন্ত পদচিহ্ন পড়েনি কোনো বাংলাদেশির।
জীবনের পাঠ
বাবর আলী বলেন, ‘অন্নপূর্ণা ১-এর ক্যাম্প ২ ও ৩-এর পথ অনিশ্চয়তায় ভরা। সেখানে প্রতি মুহূর্তে তুষারধস আর ওপর থেকে পাথর পড়ার ঝুঁকি থাকে। আমার অভিযানের সময় দুইজন শেরপার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি। ঝুঁকি বিবেচনায় অন্নপূর্ণা-১-কে আমি ১০-এ ১০ দেব; যেখানে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টকে দেব ১০-এ দুই, আর লোৎসের ক্ষেত্রে ১০-এ চার। আসলে এটি সত্যিই “মাউন্টেনিয়ারস মাউন্টেইন”, যা সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করে।’ বাবর আলী আরও বলেন, ‘মানুষ ইতোমধ্যে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছে যে, এরপর পা বাড়াবেন কোন পথে? আমি বলতে চাই, এখানেই শেষ নয়; প্রত্যেক নারী এবং পুরুষের জীবনে অন্য অন্নপূর্ণাও রয়েছে!’
বাবর আলীর দেখানো পথ ধরে আমরা জীবনের অন্নপূর্ণ জয় করার পথে হাঁটি; চলুন!