ইমাম গাজালিকে বলা হয় ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ইসলামের প্রামাণ্য অবয়ব। তাঁর অগাধ জ্ঞান এবং প্রভাবশালী দর্শন সমসময়ে নয়টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক হাজার বছর পর আজও ব্যাপক পরিসরে তাঁর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক প্রস্তাবনাগুলো চর্চিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইউনেসকো ‘থিংকার্স অন এডুকেশন’ শিরোনামে চার ভলিউমে বিশ্বের নির্বাচিত ১০০ জন মনীষীর শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা প্রকাশ করে। তাতে একাদশ শতাব্দীর সেরা শিক্ষাবিদ হিসেবে ইমাম গাজালির শিক্ষাভাবনা নিয়ে সবিস্তার পর্যালোচনা করা হয়। তাতে বলা হয়, ‘গত তিন দশকে মুসলিম সমাজে “সংঘাতময় ইসলাম”-এর রূপ পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছে, সে বিবেচনায় গাজালি ছিলেন “মৈত্রী ইসলাম”-এর প্রতিনিধি।’ তারিক রামাদান ও ভারতের বিখ্যাত দাই আবুল হাসান আলী নদভির মতো আধুনিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে ভাবছেন, মুসলিম সমাজের এই অস্থিতিশীল অবস্থার প্রধান কারণ যুগসন্ধিৎসার অনুকূলে একাডেমিক শিক্ষার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারা। ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ হিসেবে গাজালির শিক্ষাভাবনা শিক্ষার্থীকে জ্ঞান আহরণে, শিক্ষককে শিক্ষা প্রদানে এবং গবেষককে নতুন উদ্ভাবনের পথ দেখাতে পারে।
আরও পড়ুনসুরা আর রাহমান কোরআনের প্রসিদ্ধ একটি সুরা০৮ ডিসেম্বর ২০২৪গাজালির জীবনকাল
গুণীরা বলেছেন,−বড় হতে হলে একটা প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। ইমাম গাজালির সেই প্রতিজ্ঞা তৈরি হয়েছিল একটি রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে। মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে জুরজান থেকে তুছ নগরে ফিরে আসছিলেন গাজালি। পথে ডাকাত পড়ে এবং সবকিছুর সঙ্গে ডাকাতরা তাঁর ব্যাগটিও কেড়ে নেয়, যাতে ছিল তাঁর নোট-পাণ্ডুলিপি ‘তালিক’। তিনি ডাকাত দলের পিছু নেন। ডাকাত সরদার তা দেখে বলল, মরতে না চাইলে ফিরে যাও।
যে সত্তার কাছে তুমিও নিরাপত্তা চাও, তার কসম, আমার থলেটি ফিরিয়ে দাও। গাজালি বললেন।
কী আছে তাতে?
আমার দীর্ঘদিনের জ্ঞান।
‘আমার জ্ঞান’ বলছ কেন, (হাসতে হাসতে) এটা তো এখন আমার কাছে।
গাজালি সংকেতটি বুঝতে পারলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, এমনভাবে জ্ঞান অর্জন করবেন যেন কেউ কখনো ডাকাতি করতে না পারে।
খোরাসানের ওই ‘তুছ’ শহরেই ৪৫০ হিজরিতে (১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পূর্ণ নাম আবু হামেদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-গাজালি। বাবা ছিলেন গাজ্জাল বা তাঁতি। ঐতিহাসিক সামআনি লিখেছেন, তাঁর গ্রামের নাম ‘গাজাল’। সেখান থেকেই ‘গাজালি’ বা গাজ্জালি। খুব ছোটবেলায় বাবা হারান। বাবার এক বন্ধুর কাছে দুই ভাইয়ের প্রতিপালনের ভার ছিল। তিনি অর্থাভাবে কয়েকজন বিত্তশালীর সহযোগিতায় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানেই আরবি, ফারসি, কোরআন ও ইসলামের বনিয়াদি শিক্ষা সমাপ্ত হয়। তারপর ‘ফিকহ’ পড়ার জন্য যান জুরজান শহরে। সেখান থেকে ফেরার পথেই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তারপর উচ্চতর এলেম শিখতে যান ইরানের নিশাপুর। কয়েক বছর থাকেন যুগশ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম জুয়াইনির কাছে। ১০৮৫ সালে জুয়াইনির মৃত্যু হলে তাঁর শিক্ষানবিশকাল শেষ হয়। এর মধ্যে তিনি যুক্তিবিদ্যা ও কালাম শাস্ত্রসহ সে যুগে যে শিক্ষা পার্থিব উন্নতির বাহন হতে পারে, প্রথমেই তা শেখেন এবং বাজারে যেসব বিদ্যার কাঙ্ক্ষা বেশি, তা-ও অর্জন করেন। তারপর শায়খ ফারমাদির অধীনে সুফিবাদ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন।
তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। তিনি সেলজুক মন্ত্রী নিজামুল মুলকের সঙ্গে দেখা করেন এবং পরবর্তী ৬ বছর তাঁর পরিচালিত স্কলার শিবিরে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি রাজনীতি ও বিতার্কিক বিষয়গুলোতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। পরে মন্ত্রীর ইচ্ছায় তখনকার সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ বাগদাদের ‘নিজামিয়া’ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন। কিন্তু সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেন যে সেলজুকি শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দূরীকরণে তাঁর খেদমত তলব করা হতো। তিনি সে সময় প্রায়ই শাসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্দেশে সরাসরি নৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত পত্রাবলি প্রেরণ করতেন। রাষ্ট্রদর্শনবিষয়ক আলোচনায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি, আইন, শাসনতন্ত্র ও ধর্ম, রাজস্ব আদায়, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা, জ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ, শাসক ও প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের কর্তব্য প্রভৃতি তুলে ধরতেন। একবার রাজদরবারে গিয়ে বাদশাহর মুখের ওপর বলে বসেন, স্বর্ণালংকারের ভারে তোমার ঘোড়ার পিঠ ভাঙেনি তো কী হয়েছে, অনাহারে-অর্ধাহারে মুসলমানদের পিঠ তো ঠিকই ভেঙেছে।
)–এর কাছে মেয়ে বিয়ে দিলেন যে নবী১১ ডিসেম্বর ২০২৪
১০৯৬ সালে নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে বিদায় জানানোর উদ্যোগ নেন বিচার দিবসের ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে। ইতিহাস লিখেছে,−তাঁর এ ভয় তীব্রতর হয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অবশেষে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর পরিব্রাজক জীবন যাপন করেন। অথচ আশৈশব অর্থকষ্টে ভোগা তাঁতির ছেলে গাজালি বাগদাদে দারুণ সুখে জীবন কাটাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি ‘আল-মুস্তাজহারি’এর মতো বৃহৎ কলেবরের কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। ভ্রমণের অবসরে তিনি দামেস্ক, জেরুজালেম ও মক্কায় সময় কাটান। একই সময় ‘ইহয়াউ উলুম আদ-দীন’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনায় হাত দেন।
১১০৭ সালে বাগদাদে ফিরে এসে কিছুদিন পূর্বেকার অধ্যাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এরপর নিজামিয়া ত্যাগ করেন। সরকারের মাসোহারা গ্রহণ করা বন্ধ করেন। সরকারি প্রভাবে পরিচালিত শিক্ষায়তনে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তুছে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান−একটা মাদ্রাসা ও একটা খানকা−কায়েম করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ পদ্ধতিতে তালিম দিয়ে তৈরি করতে চাইছিলেন।
গাজালি বিয়ে করেননি বলে জনশ্রুতি আছে। তবে ইতিহাস জানায়, বিদেশ থেকে জন্মভূমি তুছ নগরে আবার তিনি ফিরে এসেছিলেন প্রধানত তাঁর মেয়েদের অনুরোধে। জ্ঞান সাধনা, দর্শনচর্চা এবং বই লেখা ছাড়াও গাজালি জীবনে আরও অনেক কাজ করেছেন। তিনি তাঁর মেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। অধিবিদ্য, নীতিবিদ্যার মতো বিষয়েও তাঁর সুসংগত চিন্তাধারা ছিল। কবিতাও লিখতেন। ওমর খৈয়াম তাঁর বন্ধু ছিলেন এবং খৈয়ামের মতো তাঁর প্রিয় কাব্যভঙ্গি ছিল রুবাইয়াত। তিনি জীবনাশ্রিত ভাষায় বেশ ভালো গল্পও বলতেন।
আরও পড়ুনইস্তিগফার কীভাবে করবেন১০ ডিসেম্বর ২০২৪৫০৫ হিজরির ১৪ জমাদিউস সানি (১৮ ডিসেম্বর ১১১১ ইং) রোববার এক সুন্দর সকালে ইন্তেকাল করেন। ইরানের অমর কবি ফেরদৌসির সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর দিন ভোরবেলায় তিনি ফজর নামাজ আদায় করেন এবং নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করে শুয়ে পড়েন।
ইমাম গাজালি মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রেখে যান তাঁর রচনার একটি বিরাট ভান্ডার। বলা হয়, গাজালির রচিত চার শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তবে ডব্লিউ এম ওয়াট তাঁর ‘আ স্টাডি অব ইমাম গাজালি’ গ্রন্থে সাবধান করে দিয়েছেন,−গাজালির নামে প্রচারিত সব গ্রন্থ আদতে তাঁর নয়। আর জোশা (R. Gosche) জার্মান ভাষায়, ‘গাজালির জীবন এবং রচনাবলি সম্পর্কে’ (Leben und Werk von al-Ghazali) শিরোনামে একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখেছিলেন; বার্লিন থেকে যা প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। এই গবেষণায় জোশা অধুনা বিলুপ্ত গাজালির ৪০টি বইয়ের একটি তালিকা উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলোর স্বত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এগুলো গাজালির নিজের লেখা। এগুলোর পাণ্ডুলিপি কোথায় কোথায় সংরক্ষিত আছে, জোশা সে তথ্যও দিয়েছেন। তদুপরি কেউ কেউ এ-ও বলেছেন, যদি সব মুসলিম চিন্তাধারা বিলুপ্ত হয় এবং গাজালির গ্রন্থাবলি সংরক্ষিত থাকে, তবে ইসলামের পক্ষে সে ক্ষতি সামান্য মাত্র। এমনকি সুফিরাও তাঁর ‘ইহয়াউ উলুম আদ-দীন’ গ্রন্থটিকে ‘কোরআনের পর অন্যতম দ্বিতীয় গ্রন্থে’র মর্যাদা দান করে রেখেছেন।
আরও পড়ুনরাগ নিয়ন্ত্রণে যা করবেন... ১০ ডিসেম্বর ২০২৪গাজালির দর্শন
ইমাম গাজালির আবির্ভাব ঘটে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে, যখন পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শন বিস্তার লাভ করেছে। তিনি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য দেখান এবং ধর্মকে দর্শনের ওপর প্রাধান্য দেন। গাজালির একমাত্র বিশ্বাস ও অবস্থান ছিল, ওহি বা নবুয়তি চিন্তাধারা মানুষের সমস্ত আকল বা বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। তিনি বলেছেন, ওহি ছাড়া কোনো দার্শনিক মতবাদ কখনো ধর্মীয় চিন্তার ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও প্রজ্ঞার জ্ঞান প্রতারণামূলক হতে পারে। তাঁর মতে, দূরকল্পী কোনো যুক্তির সাহায্যে কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রমাণ করা যায় না। জনসাধারণের ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তিবিজ্ঞানের সাহায্যে বিন্যস্ত কতগুলো আকাইদ সূত্রে পরিণত করার প্রবণতাকে প্রকাশ্যভাবে নিন্দা করেন। একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক পরিচয়ে ইউরোপীয়রা তাঁকে পরিচিত করাতে চাইলেও গাজালি দর্শনকেও সরাসরি আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, দর্শন নিছক একটি চিন্তাধারা। যে কেউ তা উপলব্ধি করতে সক্ষম। মধ্যযুগীয় দার্শনিক চিন্তার প্রভাব থেকে মুক্ত করে মুসলিমদের কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার কারণেই তাঁকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বলা হয়।
অনেক বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিকের মতো গাজালিও বিশ্বকে অস্থায়ী ও চিরন্তন—এই দুভাবে দেখেছেন। এই বিশ্ব বা ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্ব সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত,−এটি কোনো আইন বা সরকার কর্তৃক পরিচালিত নয়। তাঁর মতে, তিনি কেবল বিশ্বই সৃষ্টি করেননি, বরং বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিষয়েরও স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক।
সমাজ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা হলো, সমাজ মানুষের তৈরি। সমাজের কেবল মন্দ বিষয়গুলো পরিবর্তন করতে হয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকারের চেয়ে দলগত অধিকারকে সমাজে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমাজে মৌলিকভাবে দুটি শ্রেণি থাকে—শাসক ও শাসিত। শাসকশ্রেণি চিন্তাভাবনা করে এবং জনসাধারণ সম্পূর্ণভাবে তা মেনে নেয়। সাধারণ মানুষের কোনো নিজস্ব রুচি নেই, তারা শুধু সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলে। সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তা পুরো সমাজের নিয়ন্ত্রক এবং পথনির্দেশক।
মানুষ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সচেতনতা ও প্রজ্ঞা মানুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য। প্রজ্ঞার দুটি উৎস রয়েছে—একটি হলো মানুষের অনুভূতি এবং বুদ্ধি-বিবেচনা, যা আদতে খুব অল্প। এটা হলো পৃথিবীতে শুধু বসবাসের জন্য একজন মানুষ যা নিজ উদ্যোগে জেনে নেয়। অন্যটি হলো উৎসাহ,−যা বিশ্বকে জানার জন্য কার্যকর। উৎস-পদ্ধতির আলোকে এই দুটি উৎসকে অবশ্যই সমানভাবে দেখতে হবে। তবে সত্যিকারের জ্ঞান শুধু অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অর্জিত হয়।
গাজালির দর্শন অনুযায়ী মানুষ ধর্মপরায়ণ। এটা ঠিক যে দারিদ্র্যের জন্য সম্পদ এবং ক্ষুধার জন্য পেটভর্তি খাবারেরও প্রয়োজন হয় তার। তবে মানুষ যে ধার্মিক,−এই বিষয়টি সৃষ্টিগতভাবে গড়ে ওঠে, আধিপত্যের ওপর ভিত্তি করে নয়। মানুষের অভ্যাসগুলো সংগ্রামের চেয়ে ধৈর্যের ওপর বেশি নির্ভর করে।
শিক্ষার মূলনীতি ও লক্ষ্যসম্পর্কিত দর্শন
গাজালি তাঁর দর্শনে শিক্ষাবিষয়ক ভাবনাকে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করেছেন। তিনি আইন, দর্শন ও অতিন্দ্রীয় ধারণার মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষাচিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছেন। কেননা, তিনি গতানুগতিক শিক্ষাবিদ ছিলেন না,−ছিলেন ধর্মীয় ও নৈতিকতা বিষয়ের দার্শনিক। তবে এটাও ভুললে চলবে না যে দর্শন শুধু তাঁর ভাবনা ছিল না, তিনি তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন এবং একাডেমিক ও নন-একাডেমিক নানা পর্যায়ে তিনি শিক্ষা প্রদান, শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজে সময় ব্যয় করেছেন।
গাজালির দর্শনের মূল সুর হলো আত্মিক বিষয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর বিশেষ মতাদর্শ হলো, শিক্ষাকে গতিশীল, পরিবর্তনের মধ্যেও টেকসই এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সক্ষম হতে হবে। তিনি সমাজের জন্য যে শরিয়াহ চালু করেছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল, মানুষ যেন তার সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যসুখ লাভ করতে পারে। এ কারণে তাঁর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এমনভাবে জ্ঞান অর্জন করে, যাতে ধর্মীয় নিয়ম-নীতি সুচারুরূপে মেনে পার্থিব ও পরকালীন উভয় জগতে সে সুখী হতে পারে। অন্যান্য পার্থিব লক্ষ্য, যেমন−সম্পদ উপার্জন, সামাজিক অবস্থান বা শক্তি অর্জন এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা—এ এসবই মায়াছায়া, যেহেতু এগুলো শুধু ক্ষণস্থায়ী জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর মতে, প্রাকৃতিকভাবে শৈশবকালে শিশুরা বুঝতে পারে না কোন ধরনের কথা বলা উচিত এবং কোনটা উচিত নয়। তাই এ সময় তাদের কোনো পাপ হয় না। পরিবার, বিশেষত, মা-বাবা তাকে শেখায় কোথায়, কখন, কীভাবে কথা বলতে হয়। শিশুরা পরিবারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, সংস্কৃতি শেখে, নৈতিকতা শেখে এবং এমনকি প্রতিবেশ বোঝে তারা পরিবারের মাধ্যমে। সুতরাং শিশুর শিক্ষার জন্য দায় হলো পরিবারের। সেই দায়ের খানিকটা রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষালয়ের শিক্ষকেরও। শিশুর তাই প্রধান শিক্ষার বিষয় হবে নৈতিকতা এবং শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো তাকে চরিত্রবান করে বেড়ে ওঠার পথ দেখিয়ে দেওয়া।
আরও পড়ুনঅচেনা লোক আর বাগানের মালিকের ঘটনা০৯ ডিসেম্বর ২০২৪একজন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক হিসেবে গাজালি উভয় প্রকারের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাবলির প্রতি আগ্রহ লালন করতেন। এসবের ধরন-ধারণ, পদ্ধতি, শ্রেণি ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি মতামত দিয়েছেন। জ্ঞান বা শিক্ষা সম্পর্কে গাজালির মতাদর্শ হলো, সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান প্রকাশিত হয় তাঁর নবীর মাধ্যমে। শরিয়তের শিক্ষা ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় বিষয়কে ধারণ করে। কেননা, জ্ঞান বা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষের সত্যিকারের সুখকে সম্পূর্ণরূপে অর্জন করতে সাহায্য করা। তবে তিনি মনে করতেন, অনারবি বা ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানের চেয়ে আরব বা ধর্মীয় বিজ্ঞান উত্তম। কেননা, মানুষ চিরস্থায়ী সুখের চেয়ে পার্থিব সুখকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে না। তার মানে এই নয় যে ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানকে অবহেলা করা হচ্ছে,−সমাজে এরও প্রয়োজন রয়েছে। আসলে আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে আন-নাদিম, ইবনে সিনা ও অন্যান্য আরব দার্শনিক ও বিশেষজ্ঞ যখন অনারবীয় বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে নিরত ছিলেন, তখন গাজালির ভাবনা হয়েছিল, অ্যারিস্টটলের দ্বারা প্রভাবিত এই বিজ্ঞান মুসলিমদের পরকালীন সুখের ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।
গাজালি জ্ঞানকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। প্রথমত, ‘প্রকৃতি’ অনুসারে জ্ঞানবিজ্ঞানের দুই ভাগ—এক. থিওলজি ও ধর্মীয় জ্ঞান; দুই. প্রায়োগিক জ্ঞান; যেমন নৈতিকতা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও রাজনীতি। দ্বিতীয়ত, উৎস অনুসারে জ্ঞানের দুই ভাগ—এক. ওহির জ্ঞান, যা নবী-রসুলদের থেকে প্রাপ্ত; যেমন তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ব, ধর্মগ্রন্থ, মৃতের সৎকারের মতো নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং নৈতিকতা; দুই. যুক্তিসংগত বিজ্ঞান, যা মানুষের যুক্তি ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে উদ্ভাবিত। যেমন গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ইত্যাদি। তবে গাজালির মতে, ধর্মীয় বিজ্ঞান এবং যুক্তিসংগত বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। একটি হলো প্রাপ্ত জ্ঞান এবং আরেকটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। একটি আরেকটির জন্য অপরিহার্য।
আরও পড়ুনহাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল কখন পড়বেন৩১ মার্চ ২০২৫গাজালি এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের পাঠ্যসূচির কথা বলেছেন—এক. বাধ্যতামূলক শিক্ষা, যা সবাইকে শিখতে হবে। এতে থাকবে বিশেষ করে ধর্মবিষয়ক জ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য। দুই. ঐচ্ছিক শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা ও ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। এগুলোর প্রতিটিতে আবার দুই ধরনের পাঠ্যক্রম থাকবে:
এক. ওহির জ্ঞান। এটি আবার চার প্রকার—১. মূল পাঠ, যেমন−কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং সাহাবিদের উক্তি। ২. শাখাবিষয়ক পাঠ, যেমন−ফিকহ (ইসলামি আইন) ও নৈতিকতা। ৩. অর্থবিষয়ক পাঠ, যেমন−ভাষা ও ব্যাকরণ। ৪. উপকরণবিষয়ক পাঠ, যেমন−তাফসির, ফিকহের সূত্রাবলি, সন ও বংশবর্ণনা।
দুই. ওহি নয় এমন জ্ঞান, যেমন−চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, কাব্য ও ইতিহাস।
এরপর তিনি তাঁর যুগে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রথমবারের মতো তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করার সুপারিশ করেন—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। এমনকি তিনি প্রতিটি স্তরে পাঠ্যক্রম নির্ধারণ এবং পাঠ্যবইয়ের তালিকাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষণীয় বিষয় হবে শিক্ষার্থীর যেন পরিপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতা উভয়টি অর্জিত হয়। দক্ষতার প্রয়োজনে যদি এমন হয় যে সেটা প্রয়োগ করে দেখাতে হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে। একটি বিষয়ে দক্ষতা হাসিল হওয়ার আগে কিছুতেই তাকে অন্য বিষয়ে পাঠদান করা যাবে না।
বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী
ইমাম গাজালির আমলে এগারো শতকের শেষের দিকে সুফি, দার্শনিক ও বিশেষজ্ঞরা মিলে একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। গাজালি এ সময় ইসলামকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সমাজে তাদের ভূমিকাগুলো হলো: ১. সত্য অনুসন্ধান করা। ২. আত্মোন্নয়ন সাধন করা এবং তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, সে অনুসারে কাজ করা। ৩. সত্য প্রচার করা এবং নির্লোভ ও নির্ভীক থেকে অন্যদের সত্য শিক্ষা দেওয়া।
তিনি শিক্ষার্থীদের কিছু ‘কোড অব ইথিকস’ মেনে চলা উচিত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর উচিত:
১। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের আগে সত্যিকারের ধর্মভীরু হওয়া।
২। পার্থিব সম্পদ ও নিজের বাড়ি ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে জ্ঞানের সন্ধানে এবং পরকালের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা।
৩। শিক্ষকদের অধিকারগুলো জানা, তাঁদের সম্মান করা এবং তাঁদের সঙ্গে ভদ্রভাবে বিনীত ভঙ্গিমায় কথা বলা।
৪। প্রথম দিকে আকিদা-বিশ্বাসের বিষয়াবলি শেখার সময় সাবধান থাকা।
৫। ধর্মীয় বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়, যেমন ভাষা, তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও কালাম শাস্ত্রে স্পষ্ট ধারণা অর্জনে অনুবর্তী হওয়া।
৬। যুক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করা।
৭। জ্ঞানার্জনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো পার্থিব তৃপ্তি লাভ করা এবং প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন করা—কিছুতেই যশ, বিত্ত ও খ্যাতি নয়।
মুসলিম বিশ্ব দীর্ঘকাল গাজালির পাঠ্যক্রম অনুসরণ করেছিল এবং পশ্চিমা সভ্যতার আগমন, এমনকি সমসাময়িক আরব সভ্যতার উত্থানের পরও এই প্রভাব কার্যকর ছিল। পরবর্তী অনেক পণ্ডিতের মতে, গাজালি মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় সংস্কারক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ষ ট কর ত ড স ম বর র ভ বন ন ত কত র জন য কর ছ ল ন কর ন র জন ত পর ব র বল ছ ন কর ছ ন র ওপর ক রআন অবস থ এ সময় ইসল ম ব ষয়ক
এছাড়াও পড়ুন:
অংশগ্রহণ বেশি স্বীকৃতি কম
মোমেনা আক্তার। ৪৫ বছর বয়সী এ নারী বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর দিন শুরু হয় ভোরে, রান্নাঘরে চুলার ধোঁয়ার মাঝে। সকালের খাবার তৈরি শেষে তিনি স্বামী ও ছেলের সঙ্গে মাঠে যান। সেখানে ধান, আলু, ভুট্টা, ডাল– এসব চাষের কঠোর পরিশ্রমে তিনি সমানভাবে অংশ নেন। মাঠের কাজ শেষ হলে ঘরে ফিরে আবার শুরু হয় রান্না, মাড়াই, পানি আনা– এমন অসংখ্য কাজের ধারাবাহিকতা। মোমেনা একজন নারী কৃষক, যাঁর জীবন-সংসার আর কৃষির শ্রমের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তিনি বলেন, ‘স্বামী ও ছেলের সঙ্গে আমি মাঠে কাজ করি। তারপরও ঘরের কাজ, রান্না সবই করি। যদি তারা অন্য কৃষকের কাছ থেকে কাজ নিত, তাহলে তাঁকে অনেক মজুরি দিতে হতো। আমি তো প্রতিদিন মাঠে পুরুষের মতো কাজ করি। আমার কাজের মূল্য কেউ দেয় না।’
মোমেনার স্বামী ও ছেলে মাঠের কাজ শেষে আড্ডায় মেতে ওঠেন বা বাজারে চা খেতে যান। মোমেনার জন্য এমন কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ঈদ ছাড়া কখনোই আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেয় না। শুধু পুরুষদের শ্রমকেই সম্মান করা হয়। আমাদের শ্রমের দাম নেই।’
এ অভিজ্ঞতা মোমেনার একার নয়। বাংলাদেশের লাখো নারী কৃষকের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা এমন। তারা মাঠে পুরুষের সমান কাজ করেন। মজুরি ও সম্মানে পিছিয়ে থাকেন। তবুও মোমেনার একটি স্বপ্ন আছে– একদিন নারীর কৃষি শ্রমের জন্য সমান মূল্যায়ন হবে এবং তাদের জীবনযাত্রা আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন এগ্রিকালচার সিস্টেম-২০২৩’ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৫.৩ শতাংশ, যা ২০০৫ সালের ৩৬.২ শতাংশ থেকে ৯.১ শতাংশ বেড়েছে। এটি বিশ্বে নারীর কৃষিতে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ বাড়ার হার। বিশ্ব গড় (৪০ শতাংশ) থেকে বাংলাদেশে এ হার ৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, কৃষি খাতে জড়িত প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৮৪ লাখই নারী, যা মোট কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৫৮ শতাংশ। নারী শুধু ধান চাষেই নয়, পোলট্রি, ডেইরি এবং বাণিজ্যিক সবজি চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র খামার রয়েছে, যার ৬০ শতাংশ গ্রামীণ নারীর দ্বারা পরিচালিত। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ৯০ শতাংশ পালন নারীর হাতে, যার বড় অংশ বাংলাদেশে।
তবে এ অবদানের পরও নারী কৃষকের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ কৃষি শ্রমিকরা দৈনিক গড়ে ৪৫০ টাকা মজুরি পান, যেখানে নারীরা একই কাজের জন্য মাত্র ৩০০ টাকা পান। এ বৈষম্যের পেছনে রয়েছে সামাজিক ধারণা, যেখানে নারীর শ্রমকে পুরুষের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে পুরুষ শ্রমিকরা শহরমুখী হচ্ছেন। ফলে নারীর কৃষিকাজে অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। এ বর্ধিত অংশগ্রহণের সঙ্গে তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়েনি। নীতিনির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, কৃষিঋণ বা জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ এখনও অনেক কম। এ অবমূল্যায়ন এবং ক্ষমতায়নের অভাব তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারী ঘরের কাজ করে, এটা এখন পুরোনো কথায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান গ্রামবাংলায় অধিকাংশ নারী ধান মাড়াই, বিজ রোপণসহ সব কৃষিকাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবে নারীর শ্রমের মূল্যায়ন ততক্ষণ পর্যন্ত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অংশগ্রহণ থাকে। যখন শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জিত হয়, তখন নারীর সেই অর্থের অধিকার বা দেখভাল করার সুযোগ থাকে না। ফলে অপ্রাপ্তি ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি উন্নয়নের জন্য নারীর কাজের স্বীকৃতি জরুরি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০১২ সাল থেকে গৃহকর্মী ও নারীর সংসারের কাজের স্বীকৃতি দাবি করছে। এ স্বীকৃতি মিললে কিষানির কাজের স্বীকৃতি আদায়ও সম্ভব হবে, যা কৃষি খাতের উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
মোমেনা আক্তারের মতো নারী কৃষকরা বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নারীর কৃষি শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা শুধু সামাজিক ন্যায়বিচার নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।