যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও ১২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য সামনে নতুন সুযোগ নিয়ে আসতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অধিকাংশ পণ্যে চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকবে না। ফলে চীন থেকে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ সরাবে। সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও স্থানান্তরিত হবে। চীনের ব্যবসা নিতে হলে বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। ব্যবসা সহজীকরণেও সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) আরোপ করেন। এ ছাড়া ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। যদিও গত বুধবার পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের স্থগিত করেন ট্রাম্প। তবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক সব দেশের পণ্যের ওপর বহাল রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। শুরুতে ২ এপ্রিল চীনের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ১৪৫ শতাংশ। বিপরীতে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক বেড়ে হয়েছে ১২৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা থাকবে। তাতে স্বল্প মেয়াদে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। তবে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য সোনালি সময় আসবে। এম এ রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট

চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পণ্যবাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এটি মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৩ শতাংশ। সংস্থার প্রধান এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বড় ক্ষতি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৫৮২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। তার মধ্যে চীন থেকে দেশটিতে ৪৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে চীন।

চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খুবই নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত বছর উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশটি থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা থাকবে। তাতে স্বল্প মেয়াদে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। তবে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য সোনালি সময় আসবে। কারণ, চীন থেকে ব্যবসা ও বিনিয়োগ দুটোই সরবে। চীন আগামী দিনে যতই দর-কষাকষি করুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতিরিক্ত শুল্ক শূন্য হবে না।’

বাংলাদেশের সুযোগ কোথায়

যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। তারপর রয়েছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে ৮৭ শতাংশ তৈরি পোশাক।

ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে দাঁড়াত ৫২ শতাংশ। পাল্টা শুল্ক স্থগিত হওয়ায় আগামী তিন মাস ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক থাকছে। তাতে গড় মোট শুল্ক হবে ২৫ শতাংশ। তার বিপরীতে চীনের পণ্যে নতুন শুল্ক বসেছে ১৪৫ শতাংশ।

পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে তৈরি পোশাক, চামড়া পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিকারকেরা মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ স্থগিতাদেশ পেতে শুরু করেছিলেন। এখন সেগুলো আবার ফিরছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

এমনটা জানিয়ে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে বেশ কিছু ই-মেইল পেয়েছি। তারা চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরাতে চায়। কারণ, দেশটির ওপর যে হারে শুল্ক বসেছে, তাতে চীন থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে ব্যবসা করতে পারবে না মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো।’

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, উচ্চ শুল্ক আরোপের পর চীনের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। চীন থেকে বর্তমানে জাহাজে করে যেসব পণ্য যাচ্ছে, সেগুলোও বাতিল করে দিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।

চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপকে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ মনে করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনের ব্যবসা নিতে আমাদের প্রতিযোগী দেশও চেষ্টা করবে। তবে আমাদের অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, যা অনেকের নেই। ঠিকমতো কাজ করতে পারলে আগামী ১০ বছরের জন্য সম্ভাবনা খুলে যাবে।’

আব্দুল্লাহ হিল রাকিব আরও বলেন, ‘চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে নজর দিচ্ছে। তারা অনেক কম দাম প্রস্তাব করছে। কারণ, দেশটির সরকার প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু ইইউ বাজারে পণ্য রপ্তানি করে তাদের প্রতিযোগিতা বেড়ে যেতে পারে।’

ইউএন কমট্রেড, চীনের কাস্টমস এবং ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইলেকট্রনিকস পণ্য। তারপর রয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স, তৈরি পোশাক, চিকিৎসা পণ্য, কাঠের পণ্য, নির্মাণযন্ত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি, রাসায়নিক, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, যাতায়াতের সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ও চামড়া পণ্য।

জানতে চাইলে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীন থেকে রপ্তানি হওয়া উচ্চমূল্যের পোশাকের ক্রয়াদেশ সরবে। আমাদের সেসব পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। চীন থেকে বিনিয়োগ সরবে। তার একটি অংশের গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। তবে বিনিয়োগ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পোশাক, কৃত্রিম তন্তু, ইলেকট্রনিকস, জুতা, খেলনা পণ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। তবে তার আগে পাল্টা শুল্ক থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক শ ল ক আর প র জন য স র ব যবস আম দ র আমদ ন দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

আজ চৈত্র সংক্রান্তি

চৈত্র সংক্রান্তি বা চৈত্র মাসের শেষদিন আজ। বাংলা মাসের সর্বশেষ দিনটিকে সংক্রান্তির দিন বলা হয়। এছাড়াও আগামীকাল সোমবার পহেলা বৈশাখ, নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩২।

আবহমান বাংলার চিরায়িত বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। মনে করা হয়, চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে থাকেন। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন।

এছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে নানা ধরনের মেলা ও উৎসব হয়। হালখাতার জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, সংযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি।

চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এ উপলক্ষে গ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য গ্রামের শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।

চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে সোমবার সফলতা ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দেখা দেবে নতুন ভোর। পুরনো বছরের সব জরাজীর্ণতা মুছে ফেলে বাঙালি মিলিত হবে পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন উৎসবে। জরাজীর্ণতা, ক্লেশ ও বেদনার সব কিছুকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি সব অন্ধকারকে বিদায় জানিয়ে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার থাকবে গোটা জাতির।

সম্পর্কিত নিবন্ধ