কক্সবাজার ট্যুরে আমাদের খুবই অল্প সময় হাতে নিয়ে কিছু জায়গায় ঘোরা হয়েছিল। এর মধ্যে আমরা একটা জায়গায় শুধু ‘সিএনজি মামার’ অনুরোধে ঘুরতে যাই। সেখানে পৌঁছাই খুব ভোরে। তখনো পার্কের গেট খোলার সময় হয়নি।
আমরা ফিরে যাব ভাবছি, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন ডাক দিলেন। তাকিয়ে দেখি, গেটের পাশেই কোনোমতে কয়েকটা ভাঙাচোরা কাঠ আর বাঁশের খুঁটির ওপর টিকে থাকা একটা চায়ের দোকান। সেখান থেকেই মাথা বের করে একজন ভদ্রমহিলা জানালেন, পার্কের দায়িত্বরত গাইড এখনো আসেননি। তবে আমরা চাইলে তিনি তাঁর মেয়েকে পাঠাবেন আমাদের গাইড করার জন্য।
রিজার্ভ করা সিএনজি মামার চোখের ইশারায় আস্থা পেয়ে আমরা সময়টুকু আর নষ্ট করতে চাইলাম না।
তখনো পার্কের কাউন্টার খোলেনি। সিএনজি মামা স্থানীয় লোক। তাই টাকা রেখে নিরাপত্তাকর্মীরা ঢুকতে দিলেন।
ভেতরে যাওয়ামাত্রই কেউ একজন সালাম দিল আমাদের।
‘আমি রুবা।’
স্বাভাবিক কুশলাদি বিনিময় হলেও আমাদের সবার মধ্যে কেমন এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। ১২–১৩ বছর বয়সী হবে মেয়েটা। পরিবারের সঙ্গে পার্কের ভেতরেই একটি ছোট্ট আশ্রয় ওদের।
মেয়েটির স্মিত হাসি, স্পষ্ট উচ্চারণ, নেই কোনো আঞ্চলিকতা। মুগ্ধ করার মতো। আমাদের সময়স্বল্পতা বুঝেই সে বেশ দ্রুততার সঙ্গে ভেতরের দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে গেল। সেই জায়গাগুলোর চমৎকার সব ইতিহাস শোনাল। আমরা মেয়েটিকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলাম। কেননা তার বাচনভঙ্গি, চলাফেরা প্রথমেই সবার নজর কেড়েছে।
পার্কের ভেতরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমরা অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছিলাম। দূরে পাহাড়ের বুকে ছোট্ট কিছু আবাস চোখে পড়ল। রুবা হাত উঁচিয়ে দেখাল, ওখানেই ওরা একসময় থাকত। পাহাড়ের সবুজের মাঝে, গুটিকয় বাড়ি, তাদের জন্যই গড়ে ওঠা চার–পাঁচটা দোকানের সমন্বয়ে ছোট্ট একটি বাজার। জীবনের কী অদ্ভুত রূপ!
রুবা ওর বড় বোনের কথা বলল। বোনটি লেখাপড়া করত। এ রকমভাবে গাইড করত পর্যটকদের। পরে কিশোরী বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়।
রুবা যখন আমাদের নিয়ে সিঁড়ি কাটা পাহাড়ের ওপরে ওঠে, তখনই পেছন থেকে একটি কুকুর দৌড়ে এসে ওর গায়ে উঠতে থাকে। আমরা রীতিমতো ভয় পেয়ে যাই। ওদের আদর বিনিময় আমাদের নজর কাড়ে। রুবা ওকে কোনোমতে শান্ত করে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘ওর নাম টাইগার।’
এই পার্কের ভেতরে রুবার একমাত্র সাথি এই টাইগার। বাবা–মা দুজনই চায়ের দোকানে ব্যস্ত থাকেন। আর রুবা স্কুলের সময় বাদে বাকি সময়টা টাইগারের সঙ্গেই এই বিশাল এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। কী সুন্দর জীবন! পরিশুদ্ধ বাতাস, সবুজ প্রকৃতি, নেই কোনো কৃত্রিম আবেগ, প্রযুক্তির ছোবল।
যে কিশোর বয়সের সুন্দর সময়গুলো আমাদের শহরের ছেলেমেয়েরা মোবাইলের স্ক্রিনে মাথা গুঁজে হারিয়ে ফেলে। পাঁচজন মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপনের বেলায় ব্যক্তিত্বের চেয়ে পোশাক আর মেকআপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভেতরটা ফাঁপা রয়ে যায়। সম্ভবত এসব কারণেই রুবার সাধারণ জীবনের গল্প আমাদের এতটা বিমোহিত করছিল!
তবে দিনের যে সময়ে পর্যটকদের ভিড় থাকে, রুবার তখন এখানে আসা নিষেধ! নগরজীবন থেকে দূরে থাকলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর ঠিকই রাখেন রুবার মা–বাবা।
এলাকাটি ঘুরে দেখিয়ে রুবা আমাদের চমৎকার একটি স্থাপনার কাছে নিয়ে গেল। কক্সবাজারের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি স্থাপনা, যেখানে কাঁকড়া থেকে শুরু করে ঝিনুক, শামুক, ডাব— সবকিছুর টেরাকোটা করা হয়েছে।
ফেরার সময় রুবার মা–বাবা আমাদের যখন বিদায় দেন, ছোট্ট করে একটা অনুরোধ করলাম, ওকে যেন পড়াশোনার সুযোগ দেন, সে যত দূর পড়তে চায়।
কক্সবাজার থেকে আসার সময় আমরা ব্যাগ ভর্তি করে অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলাম, যেগুলো বাসায় এনে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে, একে–ওকে দিয়ে, খেয়ে শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু রুবার গল্পটা মনের মধ্যে নিয়ে আসায় এটা আর শেষ হয়নি।
ডা.
মো. জাহিদুল আলম, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনে বহু কিছু করার পর ‘ধৈর্য-সহ্যে’ কপাল খুলছে গোলাম রসুলের
সবে সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। খুলনা নগরের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে ছোট একটা দোকানের সামনে বেশ ভিড়। অর্ডার দিয়ে কেউ টুলে বসে আছেন, কেউ আবার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। বিক্রেতা দুজনের চার হাত যেন চলছে সমানতালে। একজন ছোট ছোট ফুচকা বানাচ্ছেন, তো আরেকজন ভেলপুরির প্লেট সাজাচ্ছেন। আবার কখনো একজন পেঁয়াজ–শসা কুচি করে নিচ্ছেন আর আরেকজন বিল রাখা বা টিস্যু এগিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত।
নগরের আহসান আহমেদ রোডের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের একটি ছোট ফুচকা ও ভেলপুরির ভ্রাম্যমাণ দোকানের চিত্র এটি। দোকানের নামটাও বেশ অন্য রকম। ‘ধৈর্য-সহ্য ছোট ফুচকা ও ভেলপুরি স্টোর’। দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান। এই দোকানের ছোট ফুচকা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গোলাম রসুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের পুরাতন ঘোষগাতী গ্রামে। সাত ভাই–বোনের সংসারে রসুলের বড় ভাই ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবসা করতেন। বুঝতে শেখার পর থেকেই তাই এতেই হাতেখড়ি হয় রসুলের। তবে তাতে ঠিক পোষাচ্ছিল না। তাই বছর ৩০ আগে কিছু করার আশায় খুলনা শহরে আসেন গোলাম রসুল। তবে এই শহরে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। নানা টানাপোড়েনে কখনো খুলনা, কখনো মোল্লাহাট, আবার কখনো ঢাকায় কেটেছে তাঁর সময়। ৪৮ বছরের এই জীবনে নানা রকম কাজ করেছেন। ব্যবসাও করেছেন অনেক কিছুর। তবে সেসব ব্যবসায় কেবল লোকসানই হয়েছে তাঁর। অবশেষে ‘ছোট ফুচকায়’ তাঁর কপাল খুলেছে।
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় গোলাম রসুলের সঙ্গে। রসুল বলেন, ‘আগে রিকশা চালাইছি। নানা রকম ব্যবসাও করছি। গ্রাম থেকে কিনে মাওয়া ফেরিঘাট আর ঢাকায় ডাব বেচছি। ওই ব্যবসায় অনেক মার খাইছি। মানুষ টাকা দেয় নাই। এখনো ৬০-৭০ হাজার টাকা পাব। ডাব ব্যবসায় মার খেয়ে দুই বছর আগে আবারও খুলনা শহরে আসি কিছু করা যায় কী না সেই জন্যি।’ খুলনা এসে আবারও রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে থাকেন রসুল একই সঙ্গে মাথায় ঘুরতে থাকে চিন্তা। এরপর শীতের পিঠা বিক্রি শুরু করেন। শীত শেষ হতে আবারও অনিশ্চয়তা। এখন কী হবে!
গোলাম রসুল বলেন, ‘গরম চলে আসল, কী করব বুঝে পাচ্ছিলাম না। পরে খুলনার ৭ নম্বর ঘাট থেকে কিনে ভেলপুরি বেচছি। কিন্তু এতে হচ্ছিল না। এরপর চিন্তা করলাম আনকমন কিছু করা যায় কি না। গত বছরের কোরবানির ঈদের পর থেকে শুরু করি ছোট ফুচকা বিক্রি।’
দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান