রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ পহেলা বৈশাখে এখনও পুরনো দিনের রীতি অনুসরণ করে চলেন। সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সেই রেওয়াজ তারা এখনও লালন করেন। বাংলা বছরের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে সন্ন্যাসীরা বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে দেবদেবীর প্রতিকৃতি (পাট) মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা যে বাড়িতে যান, সেই বাড়ির গৃহিণী পরিষ্কার পিঁড়ি বা জলচৌকি পেতে দেন। এরপর তাঁরা ওই পিঁড়ি বা জলচৌকির ওপর পাট নামান। এই সময় গৃহস্তের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান পরিবেশন করেন সন্ন্যাসীরা। গান পরিবেশন শেষে সন্ন্যাসীদের চাল, সবজি কিংবা টাকা উপঢৌকন দেন গৃহিণীরা। সংগৃহিত অর্থে বাংলার সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব ও চড়ক মেলার আয়োজন করা হয়। 

পুরনো রীতি অনুয়ায়ী রংপুরের গ্রামাঞ্চলের লোকজন চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় (ভাটির পাতার রস, জাত নিমের পাতার রস, নীলতাতের রস) খাবার খান। তাদের বিশ্বাস এতে সারাবছর ধরে শরীরে কোন রোগ-বালাই হবে না। এছাড়া মুলত খেসারী, মসুর, ছোলা জাতীয় কলাই ভেজে চিবিয়ে খাওয়া হয়। বিষয়টি মুলত দাতকে শক্তিশালী করার জন্য। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মেলার আয়োজন অনেক পুরনো রীতি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মেলা। গ্রামীণ সমাজ জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল একসময়। মেলাকে কেন্দ্র করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। সামাজিক স¤প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্যই থাকে গ্রামীণ মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস। বাঁশ, বেত, পাট, শোলা, ধাতব, মৃৎ, চামড়া, তন্তুজাত হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি থাকে খাজা, গজা, মওয়া এসব খাদ্যসামগ্রীর সমাবেশ। থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, গাজির গান, যাত্রাপালা, সার্কাস, লাঠিখেলাসহ হরেক রকমের আয়োজন। 

নবাব মুর্শিদ কুলি খান পয়লা বৈশাখে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব চালু করেন। তখন কিছুটা জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি উন্নত অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই ব্যবসায়ীরাই পুণ্যাহর আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান হিসেবে ‘হালখাতা’ উৎসব চালু করেন। বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ফলে কৃষকের হাতে নগদ অর্থের জোগান শুধু ফসল কাটার সময়েই আসত। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবসায়ী বা দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে কিনতে বাধ্য হতেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে হালখাতা উৎসবে বকেয়া অর্থের পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ করে হালখাতা বা নতুন খাতায় নাম লেখা হতো। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের রেওয়াজ ছিল। সেই রীতি অনুসরণ করে রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখে বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়নে বাড়িতে তৈরি করা হয় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক রকম খাবারের জিনিস। 

আর পহেলা বৈশাখে ভালো খাবার, ভালো কাপড় পরিধান, ঝগড়াঝাটি না করা, কারো সঙ্গে লেন-দেন না করাসহ বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এতে করে আগামী বছরজুড়ে ভালো থাকা যাবে-এই বিশ^াস থেকেই পহেলা বৈশাখে রংপুর অঞ্চলের মানুষজন এসব পুরনো রীতিনীতি মেনে চলেন।

রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি। এতে থাকছে বৈশাখী শোভাযাত্রা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ত রস ক র ন ত ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি মুছে দিল দুর্বৃত্তরা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) সংলগ্ন ছাত্র আন্দোলন চত্বরে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন ‘পাটাতন’ অঙ্কিত গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি সংবলিত গ্রাফিতি রাতের কোনো এক সময় মুছে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাটি জানাজানি হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার রাতেও গ্রাফিতিগুলো রঙিন ছিল। রাতের কোনো এক সময় গ্রাফিতির ওপর কালো রঙের স্প্রে দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে।

পাটাতনের সাধারণ সম্পাদক সায়েম মোহাইমিন জানান, গণহত্যার ইতিহাসকে যদি ভুলে যাওয়া হয়, তাহলে গণহত্যা বারবার হবে। তাই পাটাতন থেকে জুলাইয়ের শহীদদের স্মৃতিকে গ্রাফিতি আকারে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন তারা। বিশেষ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকেই এ আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছিল, বাংলা ব্লকেড এখান থেকেই করা হয়। এখানে এমন ঘৃণ্য কাজ করা কেবল গণহত্যার দোসরদের দ্বারাই সম্ভব। এ ধরনের কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। 
প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি। সেই সঙ্গে জুলাইয়ের স্মৃতিতে ক্যাম্পাসে একটি ‘স্মৃতি মিনার’ তৈরি করতে অনুরোধ জানান তিনি।

এ বিষয়ে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হান্নান রহিম বলেন, ‘গ্রাফিতি মুছে ফেলার মাধ্যমে স্বৈরাচারের দোসররা জুলাইকে মুছতে চায়, ছাত্র আন্দোলন চত্বরকে মুছতে চায়, তারা জানে না– যা কিছু রক্ত দিয়া লেখা হয়, তা মুছা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, পাশাপাশি জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই।’

কুবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভর ভাষ্য, গণআন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তারা। এ আন্দোলনে অনেকে শহীদ হয়েছেন। তাদের স্মৃতিতে গ্রাফিতি অঙ্কনের জন্য ‘পাটাতন’ সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। ছাত্রদলও এমন কিছু করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে যারা এগুলো মুছে দিতে চাইছে, হয়তো তারা ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের দোসর। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, স্বৈরাচার এখনও বিদ্যমান।

কুবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইউসুফ ইসলাহী বলেন, ‘পাটাতন যে গ্রাফিতি অঙ্কন করেছিল, সেগুলো যারাই মুছে দিয়েছে, তারা ফ্যাসিস্টের পদলেহী বলেই আমরা মনে করি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই।’

সহকারী প্রক্টর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ জানান, প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ ও দাবি এলে হয়তো প্রশাসন আমলে নেবে। গণআন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই এর স্মৃতি সংরক্ষণে দাবি-দাওয়া আমলে নিয়ে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. আব্দুল হাকিমের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এখনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আর জুলাই স্মৃতি মিনার করার ব্যাপারে রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত আবেদন করলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অবিরাম কাজ করেও যারা কোনো নাম-দাম পান না
  • চেন্নাই প্লে’অফ খেলবে, দাবি ব্যাটিং কোচের
  • এখনও পুরনো যেসব রীতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন রংপুরের মানুষ
  • রাশিয়া সফরে ট্রাম্পের দূত, ইউরোপের উদ্বেগ
  • ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ থামলেও প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী
  • গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি মুছে দিল দুর্বৃত্তরা
  • বামপন্থার পুনর্জাগরণ হচ্ছে না কেন
  • খুলনা ওয়াসা: প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ 
  • লালগালিচা দেখে চটে গেলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা