রাশিয়া সফরে ট্রাম্পের দূত, ইউরোপের উদ্বেগ
Published: 12th, April 2025 GMT
ইউক্রেন সংকট ঘিরে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা আরও জোরদার হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও জার্মানির উদ্যোগে শুক্রবার ব্রাসেলসে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউক্রেন প্রতিরক্ষা যোগাযোগ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠক। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি জানিয়েছেন, এ বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ আরও বাড়ানো।
বৈঠকে ইউক্রেনকে অতিরিক্ত ৫৮ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই প্যাকেজের আওতায় রাডার সিস্টেম, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন এবং বিপুল পরিমাণ ড্রোন সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সামরিক যান ও সরঞ্জাম মেরামতেও ব্যয় করা হবে এ অর্থের একটি অংশ।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ শুক্রবার রাশিয়ায় পৌঁছেছেন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হতে পারে। এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে তা হবে উইটকফ ও পুতিনের মধ্যে তৃতীয় বৈঠক। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে উইটকফ পুতিনের সঙ্গে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠক করে আমেরিকান শিক্ষক মার্ক ফোগেলকে মুক্ত করিয়েছিলেন। রাশিয়া সফরের আগে তিনি ওয়াশিংটনে রুশ আলোচক কিরিল দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে বৈঠক করেন। দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ‘একটি সমঝোতা’ হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এই আলোচনার মধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের মানবাধিকার কমিশনার দিমিত্র লুবিনেৎস জানিয়েছেন, রুশ সেনারা ১৩ মার্চ জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের পিয়াতিখাতকি গ্রামে চারজন নিরস্ত্র ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দিকে গুলি করে হত্যা করেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। লুবিনেৎস আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও জাতিসংঘের কাছে বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং রাশিয়ার একটি প্রাতিষ্ঠানিক নীতি, যা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উৎসাহিত হচ্ছে।’ এ ঘটনায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত একটি বন্দিবিনিময় হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকতার মামলায় রাশিয়ায় কারাবন্দি আমেরিকান নাগরিক ক্সেনিয়া কারেলিনাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র আর্থার পেত্রভ নামে এক রুশ-জার্মান নাগরিককে রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। এই বিনিময় প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কারেলিনার বাগদত্তা ক্রিস ভ্যান হেরডেন এই মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে আরও কয়েকজন মার্কিন নাগরিক এখনও রাশিয়ার হেফাজতে আছেন, যাদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি তুরস্ক ও ইস্তাম্বুলে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া, নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ ও সরাসরি বিমান চলাচল শুরু করার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধক্ষেত্র ও কূটনৈতিক পরিসরে এই নতুন আলোচনাপ্রবাহ ইউক্রেন সংকটের সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে, তবে এখনও বড় ধরনের অগ্রগতি অনিশ্চিত।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এখনও পুরনো রীতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন রংপুরের মানুষ
রংপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষ পহেলা বৈশাখে এখনও পুরনো দিনের রীতি অনুসরণ করে চলেন। সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সেই রেওয়াজ তারা এখনও লালন করেন। বাংলা বছরের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। শাস্ত্র অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে সন্ন্যাসীরা বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে দেবদেবীর প্রতিকৃতি (পাট) মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা যে বাড়িতে যান, সেই বাড়ির গৃহিণী পরিষ্কার পিঁড়ি বা জলচৌকি পেতে দেন। এরপর তাঁরা ওই পিঁড়ি বা জলচৌকির ওপর পাট নামান। এই সময় গৃহস্তের মঙ্গল কামনায় নেচে নেচে গান পরিবেশন করেন সন্ন্যাসীরা। গান পরিবেশন শেষে সন্ন্যাসীদের চাল, সবজি কিংবা টাকা উপঢৌকন দেন গৃহিণীরা। সংগৃহিত অর্থে বাংলার সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব ও চড়ক মেলার আয়োজন করা হয়।
পুরনো রীতি অনুয়ায়ী রংপুরের গ্রামাঞ্চলের লোকজন চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তিতা জাতীয় (ভাটির পাতার রস, জাত নিমের পাতার রস, নীলতাতের রস) খাবার খান। তাদের বিশ্বাস এতে সারাবছর ধরে শরীরে কোন রোগ-বালাই হবে না। এছাড়া মুলত খেসারী, মসুর, ছোলা জাতীয় কলাই ভেজে চিবিয়ে খাওয়া হয়। বিষয়টি মুলত দাতকে শক্তিশালী করার জন্য। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় মেলার আয়োজন অনেক পুরনো রীতি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মেলা। গ্রামীণ সমাজ জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল একসময়। মেলাকে কেন্দ্র করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। সামাজিক স¤প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। স্থানীয় কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য এবং কৃষিপণ্যই থাকে গ্রামীণ মেলার মূল বেচাকেনার জিনিস। বাঁশ, বেত, পাট, শোলা, ধাতব, মৃৎ, চামড়া, তন্তুজাত হরেক রকমের কারুপণ্য ও বাচ্চাদের খেলনার বিপুল সমাবেশ গ্রামীণ মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। এর পাশাপাশি থাকে খাজা, গজা, মওয়া এসব খাদ্যসামগ্রীর সমাবেশ। থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, গাজির গান, যাত্রাপালা, সার্কাস, লাঠিখেলাসহ হরেক রকমের আয়োজন।
নবাব মুর্শিদ কুলি খান পয়লা বৈশাখে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব চালু করেন। তখন কিছুটা জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটায় ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি উন্নত অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই ব্যবসায়ীরাই পুণ্যাহর আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান হিসেবে ‘হালখাতা’ উৎসব চালু করেন। বাংলার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। ফলে কৃষকের হাতে নগদ অর্থের জোগান শুধু ফসল কাটার সময়েই আসত। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবসায়ী বা দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে কিনতে বাধ্য হতেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে হালখাতা উৎসবে বকেয়া অর্থের পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ করে হালখাতা বা নতুন খাতায় নাম লেখা হতো। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের রেওয়াজ ছিল। সেই রীতি অনুসরণ করে রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখে বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের আপ্যায়নে বাড়িতে তৈরি করা হয় মন্ডা-মিঠাইসহ হরেক রকম খাবারের জিনিস।
আর পহেলা বৈশাখে ভালো খাবার, ভালো কাপড় পরিধান, ঝগড়াঝাটি না করা, কারো সঙ্গে লেন-দেন না করাসহ বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এতে করে আগামী বছরজুড়ে ভালো থাকা যাবে-এই বিশ^াস থেকেই পহেলা বৈশাখে রংপুর অঞ্চলের মানুষজন এসব পুরনো রীতিনীতি মেনে চলেন।
রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণে চলছে প্রস্তুতি। এতে থাকছে বৈশাখী শোভাযাত্রা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।