Samakal:
2025-04-13@05:14:11 GMT

উটভক্তি ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে

Published: 11th, April 2025 GMT

উটভক্তি ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে

ঢাকা শহরে উট আগে কখনও দেখা যায়নি, অধিকৃত পাকিস্তান আমলেও নয়। উট ছিল, তবে থাকত তারা ছবি ও কবিতায়। তারা যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠল আমাদের এই রাজধানীতে, তখনই উট দেখে নয়, উটের ভক্তদের দেখে খুবই পীড়িত হয়েছে সংবেদনশীল মানুষ। শামসুর রাহমানও হয়েছিলেন, যে জন্য তিনি কবিতা লিখে দুঃখ ও পীড়ার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ও কেমন করে ঘটল এই অদ্ভুত উটভক্তি? ঘটেছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। সেটাই প্রথম সত্য।

সামরিক শাসক এরশাদ মোটেই ধার্মিক, ধর্মভীরু ইত্যাদি ছিলেন না। তাঁর বেহায়াপনার মতো ব্যভিচারও বিশ্ববিখ্যাত ছিল। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তিনি যতদূর সম্ভব করেছেন; ক্ষান্ত হননি। সামরিক শাসন পাকিস্তান আমলেও এসেছে। আইয়ুব খানও একটানা ১০ বছর সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দেশ শাসন করেছেন। কিন্তু তিনি ধর্ম নিয়ে মোটেই বাড়াবাড়ি করেননি। মোল্লারা তাঁর ওপর খুশি ছিল না। জামায়াতে ইসলামী তো রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আইয়ুব মোল্লাদের ছাড় দেননি। এরশাদ দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন; পীরের আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত করেছেন। তাঁর এক পীরের উরস উপলক্ষেই তো উটের আগমন ঘটেছিল ঢাকা তথা বাংলাদেশে।

আইয়ুব খানের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসও ছিল। যে জন্য তিনি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মের ভাষাতে কথা বলেননি। এরশাদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস একেবারেই ছিল না। তিনি জানতেন, লোকে তাঁকে পছন্দ করে না। তাই তিনি ধর্মের কথা বলে নিজে যে খুবই ধর্মভক্ত– এ রকম প্রমাণ করতে চাইতেন। 
আত্মবিশ্বাস মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও ছিল। যে জন্য ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন– পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জিন্নাহর পর যেসব রাজনীতিক এসেছেন, তারা সংবিধান তৈরিতে সময় নিয়েছিলেন ৯ বছর এবং রাষ্ট্রকে ঘোষণা করেছিলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে। লক্ষণীয়, আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যে সংবিধান জারি করেন, তাতে রাষ্ট্রকে তিনি ইসলামী বলেননি, সাদামাটা প্রজাতন্ত্র বলেই শান্ত হয়েছেন।

এরশাদ অবশ্য তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের আত্মবিশ্বাসের অভাবের ঐতিহ্যের মধ্যেই ছিলেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর ফরমান জারি করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসিতও করেছেন। শুধু তা-ই নয়; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। তাতে সুবিধা হয়েছে জামায়াতওয়ালাদের। তারা তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের (বিএনপি এবং আওয়ামী উভয় ঘরানার) পিছু পিছু চলেছে; জাতীয়তাবাদীদের সহায়তা দিয়ে এবং তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়ে পড়েছিল। এমনকি পাকিস্তানের ২৩ বছরেও যা ছিল তাদের জন্য অকল্পনীয়। উটেরা আসবে না কেন; তারা তো আসবেই।

এরশাদকে টেনে নামানোর পর যে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে, তারাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার ব্যাপারে আগ্রহের কোনো অভাব দেখায়নি। বরং উভয় দলই প্রায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে লোকের ধর্মবোধ উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার চেষ্টা করেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার আবশ্যকতা বিএনপির তো অনুভব করার কথাই নয়। তারা তো ক্রমে নব্য মুসলিম লীগেই পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে যারা নিজেদের মনে করে, সেই আওয়ামী লীগও চুপচাপ থাকেনি; এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দিয়েছিল। ওদিকে সমাজে যে ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বেড়েছে, তা মোটেই নয়। বরং ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে, বুর্জোয়া শাসনাধীনে।


রাষ্ট্রক্ষমতা ওই চর্চাকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করেছে। আর সমাজ তো রয়ে গেছে আগের মতোই। আমাদের দেশে নির্বাচনে, গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে বটে, কিন্তু সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। উল্টো সমাজ বরং পিছিয়ে গেছে। রাষ্ট্র এখন ট্রেনে না উঠে সওয়ার হতে চাচ্ছে উটের পিঠে। আমরা পীড়িত হয়েছি, শাসকশ্রেণি হয়তোবা উপভোগ করেছে। 
ওদিকে বেড়েছে বৈষম্য; দারিদ্র্য কমেনি। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় মানুষ স্বভাবতই নেশাগ্রস্ত হয়; হয় আশ্রয়হীন। আশ্রয়হীন মানুষ কোথাও কোনো আশা দেখে না; ন্যায়বিচারের আলো পায় না। বিচ্ছিন্নতার বোধে তার পীড়া বাড়ে; সে তখন আশ্রয় খোঁজে ধর্মের কাছে। মৌলবাদ বিকাশের পেছনে এই আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে যদি না দেখি তাহলে রোগটাকে বুঝতে পারব না। তার চিকিৎসার যে সুরাহা করব, তাও সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসের সঙ্গে বেকারত্ব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বেকার যুবকরাই সন্ত্রাসী হয়। কেননা, তাদের কাছে জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। তারা অতি অল্প দামে বিক্রি হয়। খুব সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। 

সমাজের পশ্চাৎপদতা আজকের নয়; বহুকালের পুরোনো। কিন্তু কথা ছিল– আমরা সামনে এগোব। পারলাম না। তার কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এলো তারা সেটা চাইল না। চাওয়ার কথাও নয়। তাদের আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র ও দেশকে রাখবে নিজেদের কবজায়। লুণ্ঠন করবে বিনা বাধায়। লুণ্ঠনের লিপ্সাই তাদের পরস্পরবিরোধী শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে; নইলে তারা একই– ওই লুণ্ঠনকারী। যেন ডাকাতদের লড়াই, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে ক্ষমতাকে অবলম্বন হিসেবে। এই কাজটা সহজ। ধর্মের বাণী সরল, তার প্রতিশ্রুতিও সরল। ধর্মের ভাষা সহজ এবং হৃদয়স্পর্শী। কেননা, তা সমষ্টিগত নয়। ব্যক্তিগত লাভের কথা বলে; ভোগের উপায় জানিয়ে দেয়; প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে পরকালে সিদ্ধিপ্রাপ্তির। মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়।
বাংলাদেশে এখন যত মাদ্রাসা আছে, পাকিস্তান আমলেও তা ছিল অকল্পনীয়। মাদ্রাসাশিক্ষিত তরুণরা উৎপাদনে অংশ নিতে পারে না। ওই শিক্ষা তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষা কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার সমমানের নয়। অথচ দুই শিক্ষাকে একই মানে চালানো হচ্ছে। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা জনপ্রিয় হবে। কেননা, মাদ্রাসায় পাস করা তো বটেই, উচ্চ নম্বর পাওয়া সহজ এবং মাদ্রাসায় পাড়াশোনা করতে খরচও পড়ে কম। নিচু মানের এবং অল্প খরচায় ‘শিক্ষা’প্রাপ্তরা নম্বরের জোরে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদেরও জব্দ করবে– এমন আশঙ্কা মোটেই অযৌক্তিক নয়। অচিরেই আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্লাবন দেখতে পাব।

তার ফলে এমনিতেই দুর্বল সাধারণ শিক্ষার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পাবে। বলা বাহুল্য, এই প্লাবন যে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারবে, তা নয়। কেননা ওই শিক্ষার দালানকোঠা একাধারে উঁচু ও শক্ত। সাধারণ শিক্ষা যত নামবে ইংরেজি শিক্ষার আকর্ষণ ও দাপট ততই চড়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। লোকে বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরেজি বিদ্যালয়ে পাঠাতে চেষ্টা করবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবহ র কর ছ ন ত হয় ছ আইয় ব এরশ দ ক ষমত ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

উটভক্তি ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে

ঢাকা শহরে উট আগে কখনও দেখা যায়নি, অধিকৃত পাকিস্তান আমলেও নয়। উট ছিল, তবে থাকত তারা ছবি ও কবিতায়। তারা যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠল আমাদের এই রাজধানীতে, তখনই উট দেখে নয়, উটের ভক্তদের দেখে খুবই পীড়িত হয়েছে সংবেদনশীল মানুষ। শামসুর রাহমানও হয়েছিলেন, যে জন্য তিনি কবিতা লিখে দুঃখ ও পীড়ার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ও কেমন করে ঘটল এই অদ্ভুত উটভক্তি? ঘটেছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। সেটাই প্রথম সত্য।

সামরিক শাসক এরশাদ মোটেই ধার্মিক, ধর্মভীরু ইত্যাদি ছিলেন না। তাঁর বেহায়াপনার মতো ব্যভিচারও বিশ্ববিখ্যাত ছিল। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তিনি যতদূর সম্ভব করেছেন; ক্ষান্ত হননি। সামরিক শাসন পাকিস্তান আমলেও এসেছে। আইয়ুব খানও একটানা ১০ বছর সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দেশ শাসন করেছেন। কিন্তু তিনি ধর্ম নিয়ে মোটেই বাড়াবাড়ি করেননি। মোল্লারা তাঁর ওপর খুশি ছিল না। জামায়াতে ইসলামী তো রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আইয়ুব মোল্লাদের ছাড় দেননি। এরশাদ দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন; পীরের আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত করেছেন। তাঁর এক পীরের উরস উপলক্ষেই তো উটের আগমন ঘটেছিল ঢাকা তথা বাংলাদেশে।

আইয়ুব খানের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসও ছিল। যে জন্য তিনি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মের ভাষাতে কথা বলেননি। এরশাদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস একেবারেই ছিল না। তিনি জানতেন, লোকে তাঁকে পছন্দ করে না। তাই তিনি ধর্মের কথা বলে নিজে যে খুবই ধর্মভক্ত– এ রকম প্রমাণ করতে চাইতেন। 
আত্মবিশ্বাস মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও ছিল। যে জন্য ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন– পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জিন্নাহর পর যেসব রাজনীতিক এসেছেন, তারা সংবিধান তৈরিতে সময় নিয়েছিলেন ৯ বছর এবং রাষ্ট্রকে ঘোষণা করেছিলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে। লক্ষণীয়, আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যে সংবিধান জারি করেন, তাতে রাষ্ট্রকে তিনি ইসলামী বলেননি, সাদামাটা প্রজাতন্ত্র বলেই শান্ত হয়েছেন।

এরশাদ অবশ্য তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের আত্মবিশ্বাসের অভাবের ঐতিহ্যের মধ্যেই ছিলেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর ফরমান জারি করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসিতও করেছেন। শুধু তা-ই নয়; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। তাতে সুবিধা হয়েছে জামায়াতওয়ালাদের। তারা তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের (বিএনপি এবং আওয়ামী উভয় ঘরানার) পিছু পিছু চলেছে; জাতীয়তাবাদীদের সহায়তা দিয়ে এবং তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়ে পড়েছিল। এমনকি পাকিস্তানের ২৩ বছরেও যা ছিল তাদের জন্য অকল্পনীয়। উটেরা আসবে না কেন; তারা তো আসবেই।

এরশাদকে টেনে নামানোর পর যে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে, তারাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার ব্যাপারে আগ্রহের কোনো অভাব দেখায়নি। বরং উভয় দলই প্রায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে লোকের ধর্মবোধ উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার চেষ্টা করেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার আবশ্যকতা বিএনপির তো অনুভব করার কথাই নয়। তারা তো ক্রমে নব্য মুসলিম লীগেই পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে যারা নিজেদের মনে করে, সেই আওয়ামী লীগও চুপচাপ থাকেনি; এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দিয়েছিল। ওদিকে সমাজে যে ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বেড়েছে, তা মোটেই নয়। বরং ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে, বুর্জোয়া শাসনাধীনে।


রাষ্ট্রক্ষমতা ওই চর্চাকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করেছে। আর সমাজ তো রয়ে গেছে আগের মতোই। আমাদের দেশে নির্বাচনে, গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে বটে, কিন্তু সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। উল্টো সমাজ বরং পিছিয়ে গেছে। রাষ্ট্র এখন ট্রেনে না উঠে সওয়ার হতে চাচ্ছে উটের পিঠে। আমরা পীড়িত হয়েছি, শাসকশ্রেণি হয়তোবা উপভোগ করেছে। 
ওদিকে বেড়েছে বৈষম্য; দারিদ্র্য কমেনি। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় মানুষ স্বভাবতই নেশাগ্রস্ত হয়; হয় আশ্রয়হীন। আশ্রয়হীন মানুষ কোথাও কোনো আশা দেখে না; ন্যায়বিচারের আলো পায় না। বিচ্ছিন্নতার বোধে তার পীড়া বাড়ে; সে তখন আশ্রয় খোঁজে ধর্মের কাছে। মৌলবাদ বিকাশের পেছনে এই আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে যদি না দেখি তাহলে রোগটাকে বুঝতে পারব না। তার চিকিৎসার যে সুরাহা করব, তাও সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসের সঙ্গে বেকারত্ব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বেকার যুবকরাই সন্ত্রাসী হয়। কেননা, তাদের কাছে জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। তারা অতি অল্প দামে বিক্রি হয়। খুব সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। 

সমাজের পশ্চাৎপদতা আজকের নয়; বহুকালের পুরোনো। কিন্তু কথা ছিল– আমরা সামনে এগোব। পারলাম না। তার কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এলো তারা সেটা চাইল না। চাওয়ার কথাও নয়। তাদের আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র ও দেশকে রাখবে নিজেদের কবজায়। লুণ্ঠন করবে বিনা বাধায়। লুণ্ঠনের লিপ্সাই তাদের পরস্পরবিরোধী শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে; নইলে তারা একই– ওই লুণ্ঠনকারী। যেন ডাকাতদের লড়াই, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে ক্ষমতাকে অবলম্বন হিসেবে। এই কাজটা সহজ। ধর্মের বাণী সরল, তার প্রতিশ্রুতিও সরল। ধর্মের ভাষা সহজ এবং হৃদয়স্পর্শী। কেননা, তা সমষ্টিগত নয়। ব্যক্তিগত লাভের কথা বলে; ভোগের উপায় জানিয়ে দেয়; প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে পরকালে সিদ্ধিপ্রাপ্তির। মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়।
বাংলাদেশে এখন যত মাদ্রাসা আছে, পাকিস্তান আমলেও তা ছিল অকল্পনীয়। মাদ্রাসাশিক্ষিত তরুণরা উৎপাদনে অংশ নিতে পারে না। ওই শিক্ষা তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষা কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার সমমানের নয়। অথচ দুই শিক্ষাকে একই মানে চালানো হচ্ছে। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা জনপ্রিয় হবে। কেননা, মাদ্রাসায় পাস করা তো বটেই, উচ্চ নম্বর পাওয়া সহজ এবং মাদ্রাসায় পাড়াশোনা করতে খরচও পড়ে কম। নিচু মানের এবং অল্প খরচায় ‘শিক্ষা’প্রাপ্তরা নম্বরের জোরে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদেরও জব্দ করবে– এমন আশঙ্কা মোটেই অযৌক্তিক নয়। অচিরেই আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্লাবন দেখতে পাব।

তার ফলে এমনিতেই দুর্বল সাধারণ শিক্ষার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পাবে। বলা বাহুল্য, এই প্লাবন যে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারবে, তা নয়। কেননা ওই শিক্ষার দালানকোঠা একাধারে উঁচু ও শক্ত। সাধারণ শিক্ষা যত নামবে ইংরেজি শিক্ষার আকর্ষণ ও দাপট ততই চড়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। লোকে বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরেজি বিদ্যালয়ে পাঠাতে চেষ্টা করবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ