আমরা বিভাজিত হতে হতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর গোত্রে ভাগ করে ফেলছি নিজেদের। মতাদর্শিক বিভাজন, দলগত বিভাজন, বিশ্বাসকেন্দ্রিক বিভাজন, চর্চাগত বিভাজন, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন, ভৌগোলিক বিভাজন– আর কতভাবে বিভাজিত হবো আমরা! এই বিভাজনে অর্জনই বা কী? ছেলেবেলায় পড়েছি একতার ক্ষমতার কথা। ‘দশের লাঠি, একের বোঝা’, ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’– এমন সব প্রবচন কখনও লেখা ছিল পাঠ্যবইয়ে, কখনওবা শহরের দেয়াল লিখনে। ঐক্যের বিপরীতে বিভাজন– অন্তর্নিহিত এই ধারণা আমরা হয়তো উপলব্ধি করতাম। অথচ আমরা বিভাজিত হয়েই চলেছি। নিজের ক্যাম্প তৈরি করে চলেছি নিজেকে একটি গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে; বাকিদের অন্য গোষ্ঠীর বলে ট্যাগ দেওয়া মানুষের স্বভাবজাত।
এই প্রবণতাকে অতিক্রম করার জন্য তাই স্বতঃপ্রণোদিত ব্যক্তিগত চেষ্টার যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এমন নেতৃত্বের, যা বিভাজিত সমাজকে পুনরায় জুড়ে দেওয়ার মন্ত্রণা দেবে। বিভাজনের দার্শনিক ভিত্তি আর বিভাজন মোচনের ঐতিহাসিক উদাহরণ ব্যবহার করে আমরা কি জাতিগত ঐক্যের দিকে এগোতে পারি না? কী বলেছিলেন হেগেল, নিটশে, তাইফেল আর কান্ট? কী করেছিলেন সম্রাট মেইজি, মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলা?
বিভাজনের সৃষ্টি আমাদের মনোজগতে। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব বলছে, মানবমনে ইরোস বা ঐক্যের প্রেষণা এবং থানাটোস বা সংঘর্ষের ইচ্ছা পাশাপাশি অবস্থান করে। সমাজে একটি গোষ্ঠী যখন প্রতারিত বা নিষ্পেষিত হয়, তখন থানাটোস সামনে এসে দাঁড়ায়। তাই বলে যে ইরোস হারিয়ে যায়, এমনটি নয়। সে কেবল পশ্চাদপসরণ করে। ইরোসকে পুনর্জাগ্রত করার জন্য তাই প্রয়োজন ব্যক্তি বা সামষ্টিক নেতৃত্বের।
আমরা যত বেশি সাংঘর্ষিক হবো, ঐক্যের বাসনা ততটাই অবদমিত হবে এবং এর পুনর্জাগরণ হয়ে দাঁড়াবে ততটুকুই জটিল। দর্শনশাস্ত্রে হেগেল এবং নিটশে চিন্তায় দ্বান্দ্বিকতার কথা বলেছেন। চিন্তার দ্বন্দ্ব থেকেই প্রগতি আসে। তাঁরা এও বলেছেন, যদি দ্বন্দ্ব থেকে চরম বিভাজন ও ঘৃণা উৎসারণের দিকে যখন অগ্রসর হয় কোনো জাতি, তা তখন তার ভাঙনের পথকেই অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এই মত প্লেটোও দিয়েছিলেন তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’ রচনায়। মানুষ কী করে বিভাজনমুখী হয় তা জানা যায় পোলিশ-ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ হেনরি তাইফেলের সত্তরের দশকে দেওয়া ‘সামাজিক পরিচয়’তত্ত্বে। এই তত্ত্বানুসারে একজন ব্যক্তি স্বভাবজাতভাবেই সমাজের কোনো না কোনো গোত্র বা গোষ্ঠীতে নিজেকে শামিল করে। এই বর্গীকরণ সাধারণত হয়ে থাকে ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ বা জাতির ভিত্তিতে। এই প্রাথমিক শ্রেণীকরণের পরপর সেই গোত্র বা গোষ্ঠীর পরিচয় যেমন– ভাষা, মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধারণ করতে শুরু করে সে। গোত্রটির শ্রেষ্ঠত্ব, গোষ্ঠীটির সাফল্যই যেন হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক। এমনিভাবে একটি সামষ্টিক পরিচয় একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে। এই গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রাখতে, সাফল্যকে অর্জন করতে চলতে থাকে অন্য গোত্রের সঙ্গে তুলনা, সে গোত্রের সমালোচনা এবং চরম পর্যায়ে তার অবমাননা। একটি দেশের সীমানার ভেতরেই ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’– এই দ্বন্দ্ব যেন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ‘আদারিং’-এর এই নির্মম চর্চায় এর পর ইন্ধন জোগায় আঞ্চলিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সুবিধালোভীরা। রুয়ান্ডায় এভাবেই হুতু-তুতসিদের ভেতরকার অহিংস আন্তঃগোত্রীয় মতবিরোধ বৃদ্ধি পেতে পেতে ১৯৯৪-এর গণহত্যায় রূপ নিয়েছিল। বিভাজনকে বাড়তে দিলে এর চরম রূপ হয়ে দাঁড়ায় এমনই অমানবিক।
ভাবলে অবাক হতে হয়, একটি স্বভাবজাত বর্গীকরণ কত সহজেই না রাবণের মতো ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠতে পারে! এই রূপান্তর যে অনিবার্য, তা কিন্তু নয়। কান্ট তাঁর ‘মেটাফিজিক্স অ্যান্ড মোরালস’ বা আধিদৈবিকতা ও নীতিশাস্ত্রে বলছেন, মানবমনের ঘৃণা যখন উৎসারিত হতে শুরু করে, তখনই ভাঙনের সূত্রপাত। তিনি বলেছেন, চিন্তার দ্বন্দ্ব তো সমাজে থাকবেই। গোত্রে-গোত্রে পরিচয়গত বিভেদ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে আদারিংয়ের চর্চায় কেন পর্যবসিত হতে হবে? আমি এক ধর্ম, এক বর্ণ বা এক চেতনার মানুষ থেকে অন্য ধর্ম-বর্ণ-চেতনার মানুষকে কেন ঘৃণা করব? কান্ট বলেছেন, ক্রোধ সাময়িক, তবে ঘৃণা চলে অবিরত, দীর্ঘকালব্যাপী। কান্টের নীতি দর্শন ‘ইউনিভার্সাল ল’ বা সর্বজনীন বিধানের ওপর দাঁড়িয়ে। ঘৃণার চর্চা কখনও সর্বজনীন হতে পারে না। সেদিকে অগ্রসর হতে গেলেই সমাজে ভাঙনের অবশ্যম্ভাবিতা জেগে ওঠে। কান্ট তাই বলেছেন, এই ঘৃণার উদ্রেক যেন না হয়, তার বীজ যেমন শৈশবে বপন করতে হবে, তেমনি জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে আদারিংয়ের চর্চা থেকে বেরিয়ে ঐক্যের পথে জনগণকে নিয়ে যাওয়া। এখানেই নেতৃত্বের সাফল্য।
একতা অর্জনে বিশ্বের কয়েকজন অবিসংবাদিত নেতার ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই হয়। ১৮ শতক পর্যন্ত জাপান ছিল অসংখ্য সামন্ত গোষ্ঠীতে খণ্ডিত। জাতীয় ঐক্য তখন ছিল কল্পনা মাত্র। সেই শতাব্দীর শেষ দিকে সম্রাট মেইজি ঐক্যের লক্ষ্যে সামন্তবাদী প্রথা বিলুপ্ত করেছিলেন আর সিন্টোবাদকে একটি জাতীয় ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। ১৮৮৯-তে জাতীয় ঐক্যকে পূর্ণতা দিতে তিনি মেইজি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। বিভাজন থেকে আজকের সমৃদ্ধি দেখেনি জাপান; দেখেছে জাতীয় ঐক্য থেকে। উনিশ শতক পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণ প্রথা ছিল স্পষ্ট। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রশ্নে আন্দোলন হয়েছে বহুবার; ফলপ্রসূ হয়নি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতরকার এই বিভাজন জানতেন ঠিক। তিনি এই বিভাজনে ঘৃতাহুতি না দিয়ে সামগ্রিক আমেরিকান মূল্যবোধের কথা বলেছিলেন। মার্কিন সিভিল রাইটস মুভমেন্ট কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল ঠিক, তবে কিং-এর নেতৃত্ব আদারিং-এর চর্চা না করে, শ্বেতাঙ্গদের দোষী সাব্যস্ত না করে ঐক্যের পথে হেঁটেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের কথা আমাদের কারও অজানা নয়। নব্বই দশক পর্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে শোষণ করা হয়েছে দেশটির জনগণকে শুধু বর্ণের ভিত্তিতে। কিং-এর মতো ম্যান্ডেলাও গোত্র বা বর্ণভিত্তিক পরিচয় থেকে জাতীয় পরিচয়ের পথে নেতৃত্বকে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের অবিচারকে ক্ষমার চোখে দেখতে উৎসাহিত করেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ জনতাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘অসন্তোষ হলো একটি বিষ, যে বিষপানে প্রত্যাশা থাকে শুধু শত্রুর বিনাশ।’ তবে ঘৃণা দিয়ে শত্রুর নিধন হবার আগে নিজকেই যে বধ করি আমরা। ঘৃণাতে তাই ক্ষতিই সাধিত হয়, মঙ্গল নয়। আসুন, আমরা বিভাজনের এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসি। আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ আর তোমারটা স্থূল; আমার চেতনা উত্তম আর তোমারটা বোধশূন্য; আমার নেতা মহান আর তোমার নেতা অসুর– এই চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা একই দেশের মানুষ। আমাদের একটিই পতাকা, একটিই মাতৃভাষা। এই দেশটির মঙ্গল আমরা সবাই চাই। শুধু একতা থেকেই তা অর্জন সম্ভব।
নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ব ভ জন কর ছ ল ন দ বন দ ব বল ছ ন আম দ র তত ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় হাসপাতালে মিসাইল ছুড়েছে ইসরায়েল, আইসিইউ ও অস্ত্রোপচার বিভাগ ধ্বংস
ফিলিস্তিনের গাজা সিটির প্রধান আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে মিসাইল হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। অনলাইনে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, হাসপাতালের দোতলা ভবনে মিসাইল ছোড়ার পর সেখান থেকে আগুনের বিশাল কুণ্ডলি ছড়িয়ে পড়ছে।
এতে হাসপাতালটির আইসিইউ এবং অস্ত্রোপচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই সময় হাসপাতালের বিছানায় থাকা বেশ কয়েকজন রোগী দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। সূত্র: বিবিসি
হামাস এই হামলাকে ‘ভয়াবহ অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক চিকিৎসকে ফোন করে জানায়, তারা হাসপাতালে হামলা চালাবে। তাই দ্রুত হাসপাতালের সবাইকে সরিয়ে নিতে হবে।
স্থানীয় ওই সাংবাদিক আরও জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে ফোন করেন, হুমকি দিয়ে বলেন, সব রোগী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষকে অবশ্যই নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে। আপনাদের হাতে আছে মাত্র ২০ মিনিট।
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, রাতের বেলা রোগীরাও হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালের সামনে যেসব নারী ও শিশু আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাও সরে যান।
দখলদার ইসরায়েল গাজা সিটির সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপর আল-আহলি হাসপাতালটি সেখানকার প্রধান হাসপাতালে পরিণত হয়। রোববার রাতে এই হাসপাতালটিতেও হামলা চালিয়েছে তারা। এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে একই হাসপাতালে হামলা চালিয়ে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করেছিল দখলদার ইসরায়েল।