সামাজিক মাধ্যমকেন্দ্রিক গণতন্ত্রচর্চার ঝুঁকি
Published: 11th, April 2025 GMT
আমাদের গণতন্ত্র কতটুকু শক্তিশালী এবং এর ভিত্তি কতটা গভীরে, তা একটি প্রশ্ন। গণতন্ত্র যে এ দেশে বারবার হোঁচট খেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কেন এই দশা, তার কারণ নিয়ে আলোচনার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি তা দরকারও বটে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্র নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, আবার গণপ্রতিরোধের মধ্য দিয়ে জনগণ নতুন শাসন ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে চেয়েছে। তবে সেই বিশ্বাস উবে যেতে বেশি সময় নেয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের আস্থা অনাস্থায় রূপান্তরিত হয় শাসকগোষ্ঠীর কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে।
যদিও গণতন্ত্র আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি; হয়নি সংস্কৃতির অংশও। গণতন্ত্রচর্চার সুযোগের অভাবে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের পারদ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পাশাপাশি জনগণ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রতিবাদের উপায় খুঁজতে থাকে। গত কয়েক বছরে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি ডিজিটাল মাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে। নিঃসন্দেহে ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যম জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আওতা বাড়িয়েছে এবং বেশির ভাগ জনগণ একে একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই দেখে। তবে সামাজিক মাধ্যম জনমত প্রকাশের টুল হিসেবে কতটা গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও ঝুঁকিমুক্ত?
প্রায়ই দেখি সামাজিক মাধ্যম জনতুষ্টিবাদ সংস্কৃতির একটি মাধ্যম হয়ে উঠছে। এখানে সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট লেন্সের মাধ্যমে দেখার জন্য সামাজিক চাপ তৈরি করা হয়। আবার জনতুষ্টিবাদ দিয়ে বিরোধী পক্ষকে দমনের প্রবণতা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেন স্বাভাবিক ঘটনা। যাকে এক বাক্যে আধিপত্যবাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী বলা যায়। অন্যদিকে আজকে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য ও ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি দেখা যায়, যার বেশির ভাগ রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য সত্যের অপলাপ এবং জনগণের মতকে প্রভাবিত করা। আজকাল তো এই প্রপাগান্ডা মেকানিজমের জন্য মানুষের দরকার নেই; অ্যালগরিদম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি অপতথ্য সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়। খুব সহজেই মিথ্যা ও অপতথ্যের ভিত্তিতে জনমতকে প্রভাবিত করা যায়। সহিংসতা উস্কে দেওয়া যায়; যার দৃষ্টান্ত আমরা সময় সময় দেখি।
ইদানীং দেখা যায়, ফেসবুকে কোনো কিছু ভাইরাল না হলে তার আর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ফেসবুকই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিকার পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এই ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিমূলের কাঠামোগত দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। পাশাপাশি আইনের শাসনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর মানে, আইনের শাসনকে সামাজিক মাধ্যম এবং এর অ্যালগরিদমের ইচ্ছাধীন করা। যার ফল হচ্ছে, দেশের জনগণের একটি বড় অংশ আইনের শাসনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যম কি সমাজের গণতান্ত্রিক চর্চার চেতনার সহায়ক, নাকি আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণবিরোধী চর্চার একটি উপায়? এটি সারা পৃথিবীতেই একটি বিতর্কের বিষয়। দেখা যাচ্ছে, ফেসবুক গণতন্ত্রের নামে আমরা শুধু ভাইরাল কালচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। অন্যদিকে শুধু ফেসবুককেন্দ্রিক গণতন্ত্রচর্চার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রতিদিন শত শত ঘটনা ভাইরালের আড়ালে থেকে যাচ্ছে; কোনো ধরনের প্রতিকারবিহীন।
ফেসবুককেন্দ্রিক গণতন্ত্রচর্চা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের অভাবে একটি সাময়িক উপায় হতে পারে। কিন্তু এটিই যদি একমাত্র হয়ে ওঠে, তাহলে তার সুবিধার চেয়ে বিপদের হার অনেক বেশি। আমাদের জাতীয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে এই বিপদ টের পেয়েছি এবং বিপদ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে এমন একটা দিকে ধাবিত করবে, যেখানে শুধু পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদের অস্তিত্ব থাকবে এবং সামাজিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নমত পড়বে ধ্বংসের মুখে।
মুক্ত গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বড় সমস্যা শাসন ব্যবস্থার অতিকেন্দ্রিকতা, আমলানির্ভরতা ও অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। শুধু সেখানেই শেষ না। শাসন কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারাও বড় সংকট। তাই আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিকতার অর্থ হচ্ছে বিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেই প্রযুক্তি হতে হবে সবার জন্য সহজলভ্য। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য শুধু জনগণের মত শোনা না; তাদের মতের প্রতিফলন ঘটনা। আমাদের বাস্তবতায় অনেক সময় পপুলিস্ট পদক্ষেপকে গণতন্ত্র হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যেটাকে টোকেনেস্টিক বা সিলেক্টিভও বলা যায়। এ ধরনের দায়সারা পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। যার একটি উদাহরণ হতে পারে এই সময়ে সংঘটিত নারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলনে রাষ্ট্রের ব্যবস্থা। এ ধরনের ব্যবস্থা যতটা না সামগ্রিক পরিবর্তনের জায়গা থেকে, তার চেয়ে অধিক পপুলিস্ট বা দায়সারা গোছের। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সব গোষ্ঠীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলে।
এটিই গণতন্ত্র শক্তিশালী করার উপায়। এখন ক্ষমতাসীনরা এটা করতে চায় কিনা, তা একটি বড় প্রশ্ন। ক্ষমতায় যারা থাকে, তারা এই দরজাগুলো উন্মুক্ত করতে ভয় পায়। জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি করতে চায় না। ফলে তারা এমন একটি চক্রে পড়ে, যা শাসকশ্রেণিকে স্বৈরাচার বানিয়ে সাধারণ মানুষদেরই ভুক্তভোগী করে তোলে। সেটিই সামাজিক মাধ্যমকেন্দ্রিক গণতন্ত্রচর্চার মূল ঝুঁকি।
নাজমুল আহসান: উন্নয়নকর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র পর প র ক ষ ত গণত ন ত র ক ব যবস থ জনগণ র ব ত কর ফ সব ক আম দ র র জন য র একট ধরন র র গণত
এছাড়াও পড়ুন:
ফ্যাসিস্টরা নানাভাবে অভ্যুত্থানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে: জোনায়েদ সাকি
ফ্যাসিস্টরা নানাভাবে জুলাই অভ্যুত্থানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেছেন, দেশের মানুষ যখন বিরাট এক অভ্যুত্থান করে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা দেখছেন, তখন অনেকেই যেন ওই শেখ হাসিনার অপতৎপরতার মতো নানাভাবে আবার দখলদারি করতে এবং জনগণের কণ্ঠ ও স্বাধীনতা রুখে দিতে চান।
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আজ শুক্রবার বিকেলে এক বিক্ষোভ সমাবেশে জোনায়েদ সাকি এ কথা বলেন। গণসংহতি আন্দোলনের উদ্যোগে ‘গাজা ও রাফার মজলুম ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নৃশংস গণহত্যা’র প্রতিবাদে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বাংলাদেশের মজলুমরা আজ যদি ঐক্যবদ্ধ হই, আমরা যেমন অভ্যুত্থান করে হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছি...। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করে এ দেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে পারব এবং সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারব।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ চায় তারা নিজের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে, নিজের চিন্তা ও মত প্রকাশ করতে পারবে, এ জন্য ভয় পেতে হবে না। ছাত্ররা হলে থেকে নিজের চিন্তা প্রকাশ করতে পারবে, আবরার ফাহাদের মতো শহীদ হতে হবে না। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি এটা বন্ধ করতে চায়, তারা হাসিনারই পথ অবলম্বন করছে। শেখ হাসিনার নতুন রূপে হাজির হওয়া বাংলাদেশের মানুষ বরদাশত করবে না।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সেটাই, যখন আপনার নিজের মত অন্যর ওপর চাপিয়ে দিতে চান। আপনি আপনার মত প্রকাশ করবেন, অন্যকে আহ্বান করবেন। মত প্রকাশ করার জন্য জবরদস্তি করার অধিকার কারও নেই। জবরদস্তি মানেই ফ্যাসিবাদ।’
ইসরায়েলের জায়নবাদী প্রকল্প এক ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী প্রকল্প মন্তব্য করে জোনায়েদ সাকি বলেন, বছরের পর বছর ধরে তারা ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন ও দখলদারত্ব চালিয়ে আসছে, তা মানব জাতির জন্য কলঙ্ক। ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শান্তিকামী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের দরবারে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিন, রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে সোচ্চার হোন।’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক বলেন, বাংলাদেশেও নানা নির্যাতন দেখেছি। এ দেশে ধর্মীয় নির্যাতনকে কেন্দ্র করে পাশের দেশ ভারত তাদের ফায়দা তুলতে চায়। নানা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
বাংলাদেশের নারীরা নানাভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, মাজারে যাঁরা ধর্মচর্চা করেন, তাঁদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। ফ্যাসিস্টরা নানাভাবে অভ্যুত্থানকে ধ্বংস করতে চাইছে।
গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, বিশ্বের যত নিপীড়িত মানুষ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত হচ্ছে ফিলিস্তিনের জনগণ। অথচ তাদের এই নিপীড়ন দেখেও না দেখার ভান করে তথাকথিত বিশ্ব বিবেক। তিনি বলেন, একদিকে সারা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে সোচ্চার, অন্যদিকে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু জুটি গাজায় গণহত্যা চালিয়ে সেখানে প্রমোদনগরী তৈরির স্বপ্ন দেখছে। এই নব্য ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী বিবেকবান গণতন্ত্রকামী মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূঁইয়া, জুলহাসনাইন বাবু, তরিকুল সুজন প্রমুখ। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কৃষক মজুর সংহতির সাধারণ সম্পাদক আলিমুল কবীর, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহিম চৌধুরীসহ ঢাকা জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন ইউনিটের নেতা–কর্মীরা।