সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় সচেতন নাগরিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এর প্রতিবাদ ও বিভিন্ন উপায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ মার্চ মঙ্গলবার ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে একটি গণপদযাত্রা কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি ধর্ষণের বিচারের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে শাহবাগ মোড় পার হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে গেলে পুলিশ আটকে দেয়। এক পর্যায়ে সেখানে সংঘর্ষ বাধে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পুলিশ বিনা উস্কানিতে তাদের ওপর হামলা চালায়, লাঠিপেটা করে। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, তারা ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করতে বাধ্য হয়। পরে পুলিশ কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠনের ১২ নেতাকর্মীর নামে মামলা করে। তাদের দু’জন দাবি করেন, তারা ওই সময় সেখানে উপস্থিতই ছিলেন না (সমকাল, ১৩ মার্চ)। অন্যদিকে একই দিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের ‘শাহবাগী’ তকমা দিয়ে পুলিশের ওপর হামলার দায়ে তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করে।
এর আগে ৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী প্রকাশ্যে রাস্তায় যৌন হয়রানি করে। সে তাঁর পোশাক (ওড়না) নিয়ে আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে। ওই ছাত্রী ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলে (অভিযুক্তের ছবিসহ) তাঁর সহপাঠীরা অভিযুক্তকে ধরে প্রক্টর অফিসে সোপর্দ করেন। তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতেই ‘তৌহিদি জনতা’ নামে সংঘবদ্ধ এক গোষ্ঠী থানায় গিয়ে জোরপূর্বক তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একটি দৈনিক পত্রিকা জানায়, ‘ভুক্তভোগী মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন তারা। এমনকি ভুক্তভোগী ছাত্রীর মামলার নথি থেকে তার পরিচয় বের করে তাকে মেসেঞ্জারে কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে সেগুলো ফেসবুকে উন্মুক্ত করে দেন।’ তারা থানা অবরুদ্ধ করে রাখে। শেষ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম, ঢাবির কয়েক ছাত্রনেতা এর মধ্যস্থতায় নামেন। ফলস্বরূপ হেনস্তাকারীকে পুলিশ আদালতে পাঠায় এবং নথিতে এটা লিখে যে, অভিযোগকারী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন ও অভিযুক্তের জামিনপ্রাপ্তিতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই (ডেইলি স্টার, ৭ মার্চ)। আদালত জামিন মঞ্জুর করলে ওই ‘তৌহিদি জনতা’ তাকে ফুলের মালা ও কোরআন শরিফ দিয়ে সংবর্ধনা দেয়।
গত ১২ মার্চ লক্ষ্মীপুর শহরের চকবাজার এলাকার বণিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল আজিজ রমজান মাসে দিনের বেলা হোটেলে খাবার খাওয়ায় চারজনকে লাঠি হাতে কান ধরে ওঠবস করান। সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হলে তাঁকে থানায় ‘ডেকে’ নেওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি ভুক্তভোগী কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ভিডিও বার্তায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ভুক্তভোগী কেউ তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো অভিযোগ দেননি। এ ছাড়া আব্দুল আজিজ এ ঘটনায় নিজেও ক্ষমা চেয়েছেন। কোনো অভিযোগ না থাকায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে’ (সমকাল, ১৩ মার্চ)।
ঘটনাগুলো সরকার সমর্থকদের কাছে ‘বিচ্ছিন্ন’ ও খুব ‘চাঞ্চল্যকর’ নয় মনে হতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে নারী অধিকার খর্বের এসব ঘটনা উপেক্ষার সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে প্রকাশ্য দিবালোকে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির সাহস দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মচারী। তাকে স্বাভাবিক নিয়মে ছাত্র-শিক্ষকরা পুলিশে দিয়েছেন। কিন্তু তাকে রক্ষার জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক দল ছাত্র-শিক্ষক এগিয়ে যান। সেই দলে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা এবং জুলাই আন্দোলনের নেতা। এদের চাপে ভুক্তভোগী ছাত্রী মামলা তুলে নেন এবং যৌন হয়রানিকারী জামিন পায়। এখানে রাষ্ট্র স্পষ্টভাবে ভুক্তভোগীর বদলে নারী নির্যাতনকারীর পক্ষ নিয়েছে। এ যেন অজপাড়াগাঁয়ের সালিশ; দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কোনো ঘটনা নয়। এর পর কি যৌন হয়রানির শিকার কোনো নারী বিচার চাইতে থানায় যাবেন?
একে যদি আমরা প্রথম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখি, তাহলে আরও উদ্বেগজনক চিত্র সামনে চলে আসে। ধর্ষণের প্রতিবাদে করা বিক্ষোভে পুলিশ হামলা করেছে, বেধড়ক পিটিয়েছে। শুধু তাই নয়; তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। এমনকি অনুপস্থিত ব্যক্তিও সে মামলা থেকে রেহাই পাননি। এ যেন বিগত সময়ের ‘গায়েবি মামলা’, হামলার ছায়া। ওই দিনের সংঘর্ষের দায় কার, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু ওই দিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের ওপর হামলার প্রতিবাদে মিছিল ও তাতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ‘শাহবাগী’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বিচার দাবি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই মিছিল সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী ছাড়া আয়োজন করা সম্ভব নয়।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন হয়েছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের বিচারের দাবিতে, যাদের বেশির ভাগই ছিল জামায়াত নেতা। কাজেই ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কাদের ক্ষোভ রয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। নারী অধিকার সম্পর্কে জামায়াত-শিবিরের অবস্থান, ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় শিবির নেতার ‘মধ্যস্থতা’, মধ্যরাতের মিছিল– এসবকে বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে বিচ্ছিন্ন, কাকতালীয় হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। ওই তৌহিদি জনতারূপী উগ্রবাদীরা যে বিচ্ছিন্ন কোনো গোষ্ঠী নয়, বরং বৃহত্তর সাংগঠনিক কাঠামো ও যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত– সে ধারণাও এতে পোক্ত হয়। এসবের সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। সবই নিজের ধর্মীয়, আদর্শিক মূল্যবোধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া; অন্যের ইচ্ছা, মতামত, পছন্দকে দাবিয়ে রাখার ফ্যাসিবাদী মনোভাবের প্রকাশ।
লক্ষ্মীপুরের ঘটনার আরও আইনি ও রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। প্রথমত, একজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কিছু দরিদ্র, দুর্বলতর ব্যক্তিকে জোরপূর্বক অপদস্থ করেছেন। একইভাবে তিনি হুমকি দিয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মালিকানাধীন খাবারের দোকানগুলোকে। যদি তারা ক্ষমতাবান হতেন তাহলে ওই ব্যক্তি তা করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। অন্যদিকে বলপূর্বক ওই ব্যক্তিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের পরও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে এই অজুহাতে– কেউ অভিযোগ করেনি। এটা শুধু এবার নয়; প্রায়ই পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে এমন কথা শুনি। কিন্তু এর নেপথ্যে কী আছে, সচেতন মহলের না বোঝার কথা নয়। বিচারপ্রত্যাশীর এমন অসহায়ত্ব অন্তত দেশে আইনের শাসনের অস্তিত্ব নির্দেশ করে না।
ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রাকারীদের ওপর পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, অন্য দুটো ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পক্ষে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার ঘটনা এমন ধারণাই দেয়– এখনও রাষ্ট্র ও তার প্রশাসন (সরকার) আইনকে পছন্দমতো প্রয়োগের পুরোনো ধারায় চলছে। আইনের এমন ‘নির্বাচিত ব্যবহার’ বৈষম্য ও অবিচারেরই নামান্তর। আইনের যথাযথ, বৈষম্যহীন ও প্রভাবমুক্ত প্রয়োগ ছাড়া জবাবদিহিমূলক, ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে জাতি একটি মুক্ত, জবাবদিহিমূলক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছে। আলোচ্য ঘটনাগুলো সেই স্বপ্নভঙ্গের লক্ষণ ও আশু অমানিশার আভাস দেয়।
আবু আলা মাহমুদুল হাসান: গবেষক, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ শ হব গ র ঘটন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতা কয়েস গ্রেপ্তার
সিলেটে আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা মিসবাউল ইসলাম কয়েসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ নগরীর জিন্দাবাজার এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
তিনি গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ বসন্তপুর গ্রামের নিমার আলীর ছেলে। বর্তমানে সিলেট এয়ারপোর্ট থানার বড়শালা এলাকায় বাস করেন।
পুলিশ জানায়, মিসবাউল ইসলাম কয়েসের বিরুদ্ধে মারামারি, হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার আইনে সাতটি মামলা আছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা রয়েছে ৬টি, দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আব্দুল মোমেন ও তাঁর স্ত্রী সেলিনা মোমেনের প্রভাব খাটিয়ে টিলা কাটা, জমি দখলসহ নানা কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জিয়াউল হক বলেন, গ্রেপ্তার কয়েসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।