যে কণ্ঠস্বর ইসরায়েলের মিথ্যাচার ব্যর্থ করে দিচ্ছে
Published: 11th, April 2025 GMT
মাআমাকে ক্ষমা করো। এ পথটাই আমি বেছে নিয়েছি। আমি মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো, মা। আমি শপথ করে বলছি, আমি কেবল মানুষকে সাহায্য করার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছিলাম। এগুলো ছিল গাজার তরুণ ফিলিস্তিনি চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ানের শেষ কথা। রাফার ঠান্ডা রাতের আকাশের নিচে ইসরায়েলি সৈন্যঘেরা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত একটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। আহতদের বাঁচাতে তিনি তাঁর চিকিৎসক দলের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। কেউ ফিরে আসেননি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালিয়ে রাদওয়ানসহ ১৪ জন জরুরি ভিত্তিতে কর্মরত চিকিৎসককে হত্যা করে। পরে তাদের মৃতদেহ একটি অগভীর কবর থেকে উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে কারও কারও হাত বা পা বাঁধা ছিল। স্পষ্টত, খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করা হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যদিও তারা চিকিৎসকের পোশাক পরা ছিলেন। সঙ্গে ছিল রেডিও, গ্লাভস ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম। তবুও ইসরায়েল মিথ্যাচার করছে। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বকে বলেছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো চিহ্নিত করা যায়নি এবং ‘সন্দেহজনক’ ছিল। এ কারণে ইসরায়েলি আক্রমণ ন্যায্য ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ফুটেজে দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল। আলো জ্বলছিল এবং মেডিকেল জ্যাকেটগুলো দেখা যাচ্ছিল। এতে কোনো হুমকির চিহ্ন ছিল না; ছিল না কোনো ক্রসফায়ার। এমনকি কোনো অস্পষ্টতাও ছিল না। মনে হচ্ছে, এগুলো শুধুই ইচ্ছাকৃত নির্বিচার হত্যা।
অতি জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা পুষ্ট হয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন: ‘এটি আমাদের সবার জন্য, সমস্ত সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা বর্বরতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লড়ছি.
গাজায় ইসরায়েল যা করছে তা যুদ্ধ নয়। এটি জীবন নিশ্চিহ্ন করা। শ্বাস-প্রশ্বাস বা স্বপ্ন যা কিছু আছে, তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধ্বংস করা। এখানে কোনো লাল সীমারেখা নেই। কি চিকিৎসক, শিশু, এমনকি মৃত ব্যক্তির জন্যও কোনো চিহ্নরেখা নেই। ইসরায়েলি সৈন্যরা হাসপাতালে হামলাকালে একজন নার্স অস্ত্রোপচারের মাঝখানে এক রোগীকে ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। অন্য এক চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, তারা তাকে হাঁটুতে গুলি করে হাড় ভেঙে দেয় এবং পরে টেনে নিয়ে যায়। তাকে নির্যাতন করে অন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গুরুতর অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়।
গাজার শীর্ষস্থানীয় অর্থোপেডিক সার্জন আদনান আল-বুরশকে আল-আওদা হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে ইসরায়েলি কারাগারে ফেলে রাখা হয়েছিল। তাঁকে মারধর, ধর্ষণ করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়। তথাকথিত যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে ভয়াবহতা আরও তীব্র হয়েছে। খাবার নেই, জ্বালানি নেই এবং জলজ উদ্ভিদগুলো নির্জীব হয়ে পড়েছে। গাজার বেকারিগুলো ভেঙে পড়েছে। পরিবারগুলো নালার পানি পান এবং পশুখাদ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছে। অথচ তাঁর চিকিৎসা করার জন্য কেউ অবশিষ্ট নেই। এটি ‘সভ্যতা’র নামে ইসরায়েলের যুদ্ধ। দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জোনাথন হুইটল একে ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ বলে তুলে ধরেছেন। ইসরায়েল আইন, নীতি ও শালীনতার প্রতিটি সীমা পদদলিত করেছে। কোনো অঞ্চল নিরাপদ নয়; কোনো হাসপাতাল রেহাই পায় না; কোনো শিশুও বাদ যায় না। এটি কোনো সংঘাত নয়, বরং অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ।
আর যে মিথ্যাচার এতে উস্কানি দিচ্ছে, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তৈরি হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে ‘সহিংস ফিলিস্তিনিদের’ ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে প্রচারিত হচ্ছে, যা একটি আধুনিক ঔপনিবেশিক মিথ। ইসরায়েল নিজেকে গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা এবং অবরুদ্ধ সভ্যতার ঘাঁটি হিসেবে উপস্থাপন করে। তেল আবিব গল্পটি তৈরি করেছে; ওয়াশিংটন অস্ত্রের জোগান দিয়েছে, লন্ডন তা মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছে এবং হলিউড এটি বিক্রি করেছে। এটি কখনোই সত্য ছিল না। এটি ছিল প্রোপাগান্ডা, ঘষামাজা করে তৈরি, বারবার তুলে ধরা এবং হাতিয়ারে পরিণত করা।
এই গণহত্যা দুর্ঘটনাজনিত কারণে নয়; যুদ্ধের কোনো মর্মান্তিক উৎসজাতও নয়। এটি একটি পলিসি। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট, যা বিশ্বব্যাপী একটি উদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রশংসিত, মানবিক কারণে গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার আবেদন সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একজন বিচারকও শিশুসহ আটকে পড়া জনগোষ্ঠীকে অনাহারে রাখার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।
ইসরায়েল হত্যা করবে, তারপর মিথ্যা বলবে। আত্মরক্ষার জন্য হত্যা পুনরায় চালিয়ে যেতে তারা আরেকটি মিডিয়া বিবৃতি দেবে। রাদওয়ান জেগে উঠেছেন– কেবল স্পিরিট নিয়ে নয়, প্রতিরোধের সঙ্গে। তিনি ভয়, প্রোপাগান্ডা, মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছেন। যে পৃথিবী কেবল মৃত্যুসংখ্যায় নিমগ্ন, সেখানে তিনি মানবতা ফিরিয়ে এনেছেন। এখন রাদওয়ান ইসরায়েলের সব চেষ্টার স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন, যারা সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সেখানে রাদওয়ান একজন মর্যাদার প্রতীক ও নিষ্ঠুরতার পাল্টা জবাবে উপস্থিত।
সুমাইয়া ঘানুশি: ব্রিটিশ তিউনিসিয়ান লেখক এবং
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ; মিডল ইস্ট আই
থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র জন য ত র জন ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
আত্মপ্রকাশ করল নতুন দল গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি
আত্মপ্রকাশ করেছে গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। দলটির স্লোগান ‘এ লড়াই জাতীয় মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার’।
শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে নতুন দলের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেন এর চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মালেক ফরাজী।
অনুষ্ঠানে আব্দুল মালেক ফরাজী বলেন, ‘আমি দেশের প্রতি ভালোবাসা ও সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে, একজন সমাজকর্মী হিসেবে মনে করছি, ড. ইউনূস সাহেবের মতো আরও কিছু ব্যক্তিত্ব দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন। তবে আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না, কতদিন প্রয়োজন, পাঁচ বছর না পাঁচ মাস। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, যোগ্যদের নেতৃত্বে এই দেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর গর্ব বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ এখন নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। সেখানে যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, আমরা পারতাম একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। একটি বিপ্লবী সরকার প্রজ্ঞাপন জারি ও সংবিধান বাতিল করে নতুন যুগের সূচনা করতে পারত। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। কারণ আমাদের দুর্ভাগ্য যে সম্মিলিত শক্তির অভাব ছিল।’
অনুষ্ঠানে গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তির যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল হোসেন খান দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, চলমান পক্ষপাতিত্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল বদলে দেওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অভিযাত্রায় নতুন রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করছি। নতুন রেনেসাঁ, নতুন গণজাগরণ, নতুন রাজনীতি ও মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করে আমাদের জাতি সুস্থ, স্বাভাবিক, সমৃদ্ধিশালী, শক্তিমান ও প্রগতিশীল হয়ে উঠবে। আমরা নানা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হওয়া বহুস্তরবিশিষ্ট বৈষম্য দূর করে বাংলাদেশকে মানবিক উন্নয়নের প্রগতিশীল ধারায় স্থাপন করব।
দলের যুগ্ম আহ্বায়ক নাহিদ নিয়াজীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণআজাদী দলের সভাপতি মুহাম্মদ আতাউল্লাহ খান, অধ্যাপক দেওয়ান ইবনে সাজ্জাদ আফজাল খান, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তির সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন জামাল প্রমুখ।