সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের নতুন ভরসা বাংলাদেশি প্রকৌশলীর বানানাে হোমটাউন অ্যাপ
Published: 11th, April 2025 GMT
নেত্রকোনার মাহবুব আলম কাজ করেন সিঙ্গাপুরের পেইন্টিং ঠিকাদারের সঙ্গে। একদিন কাজ শেষে ট্রেনে করে বাসায় ফেরার সময় টের পেলেন বাসা থেকে অনেকবার ফোন এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানতে পারেন বাড়িতে মা অসুস্থ। অস্থির মাহবুব ভাবলেন বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। কোনো ট্রাভেল এজেন্টের অফিস খোলা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বন্ধুরা তাঁকে ‘হোমটাউন’ অ্যাপ ইনস্টল করতে বললেন। বন্ধুদের পরামর্শে ট্রেনেই অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিজের আইডি দিয়ে অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশন করেন মাহবুব। তারপর টিকিট কাটার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেন, পরদিন ভোরবেলায় ঢাকায় যাওয়া যাবে।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! অবাক হয়ে মাহবুব হোমটাউনের হটলাইনে ফোন করেন এবং নিজ ভাষায় কথা বলতে পেরে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান। তখনই নিশ্চিন্তে অ্যাপে টিকিট কেটে পরদিনই নেত্রকোনায় অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছে যান। ঘটনাটি ছয় মাস আগের। ‘মা এখন অনেক সুস্থ আছেন’—ফোনে প্রথম আলোকে বলেন মাহবুব। আরও জানালেন, মা প্রায়ই বলেন বাড়ি যেতে। মা এখন জেনে গেছেন চাইলেই হোমটাউনের সাহায্যে দ্রুত বাড়ি যাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তা প্রকৌশলী রিদওয়ান হাফিজ তাঁর উদ্যোগ গো যায়ান (Go Zayan) এই অ্যাপ তৈরি করেছে। গো যায়ান দেশি স্টার্টআপগুলোর মধ্যে বেশ সফল। সাশ্রয়ী মূল্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গন্তব্যে বিমানের টিকিট কাটা যায় গো যায়ান থেকে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানেও তাদের টিকিটিং সেবা চালু রয়েছে।কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সাইফুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। প্রায় ১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে থাকা সাইফুল নিজের গ্রামে একটি জায়গা কেনার জন্য পছন্দ করে রেখেছেন।
কয়েক মাস আগে একদিন সকালে বাড়ি থেকে জানানো হলো, জমির মালিক রাজি হয়েছেন কিন্তু বায়নার টাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে হবে। ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে হোমটাউনের কথা ভেবেছি’—বলেন সাইফুল। ‘আমি নিয়মিত হোমটাউনের মাধ্যমে টাকা পাঠাই। কিন্তু একসঙ্গে এত বেশি টাকা পাঠাইনি। তাই একটু সংশয় থাকলেও হোমটাউনের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। আমি পাঠানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে জমির মালিককে বায়নার টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে আমার পরিবার।’ কথাগুলো বলার সময় উচ্ছ্বসিত ছিলেন সাইফুল। জানালেন হোমটাউনের কারণে তাঁর একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
মাহবুব বা সাইফুলের মতো দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার প্রবাসী আছেন সিঙ্গাপুরে। তাঁদের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—বাড়িতে যাওয়া-আসা ও সহজে টাকা পাঠানো—পাল্টে দিচ্ছে হোমটাউন অ্যাপ।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তা প্রকৌশলী রিদওয়ান হাফিজ তাঁর উদ্যোগ গো যায়ান (Go Zayan) এই অ্যাপ তৈরি করেছে। গো যায়ান দেশি স্টার্টআপগুলোর মধ্যে বেশ সফল। সাশ্রয়ী মূল্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গন্তব্যে বিমানের টিকিট কাটা যায় গো যায়ান থেকে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানেও তাদের টিকিটিং সেবা চালু রয়েছে।
প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে একদিন রিদওয়ান জানালেন, দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ৬০ শতাংশের টিকিটই প্রবাসীরা কেনেন। কিন্তু ভাষার জটিলতা, অনলাইনে অনভ্যস্ততা, সময় স্বল্পতা এবং সর্বোপরি একশ্রেণির দালালের খপ্পরে পড়ে তাঁরা প্রায়ই ন্যায্য মূল্যে টিকিট কিনতে পারেন না। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক টিকিট কাটার ক্ষেত্রে কমপক্ষে একবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং প্রায়ই তাঁরা বাজারমূল্যের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি পরিশোধ করেন টিকিটের জন্য।
আবার প্রায় সব প্রবাসীর স্মার্টফোন থাকলেও তাঁরা অনলাইন পেমেন্ট করতে চান না। কারণ, অভিবাসীদের কাছে এটি জটিল মনে হয়। ভাষার বাধা তো আছেই। এই দুই সমস্যার সমাধানের জন্য রিদওয়ান তৈরি করলেন ‘হোমটাউন অ্যাপ’।
মাহবুব বা সাইফুলের মতো দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার প্রবাসী আছেন সিঙ্গাপুরে। তাঁদের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—বাড়িতে যাওয়া-আসা ও সহজে টাকা পাঠানো—পাল্টে দিচ্ছে হোমটাউন অ্যাপ।২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি চালু হয় শুধু সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের জন্য। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ইন্টারফেস, ব্যবহারকারীর চাহিদা বুঝে গাইড করা, যেন গন্তব্যের টিকিট কাটতে পারে। যেমন সিঙ্গাপুর থেকে কেউ টিকিট কাটতে চাইলে বোঝা যায়, তিনি দেশে যেতে চান। ফলে শুধু তারিখ জেনে তাকে টিকিটের অপশন দেখানো যায়। ব্যবহারকারীর পাসপোর্ট, ছবি ইত্যাদি হোমটাউন অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নেওয়া হয়ে থাকে। এ জন্য টিকিট কাটার জন্য আর কোনো বাড়তি তথ্যের প্রয়োজন হয় না। আবার হোমটাউন অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ফলে টিকিট নিশ্চিত হয়ে ব্যবহারকারী ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেন। এ জন্য সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে হোমটাউন অ্যাপ ব্যবহারকারীকে একটি কিউআর কোড দেয়। ব্যবহারকারী মুঠোফোনে সেটি সেইভ করেন এবং ব্যাংকের অ্যাপে সেটি আপলোড করলেই টিকিটের টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়। টিকিটও কাটা হয়ে যায়।
মাহবুব বলেন, ‘টিকিট কাটার পুরো কাজটি করতে সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগে। সবচেয়ে বড় কথা কথা, আমাকে কোথাও যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসেই আমি টিকিট পেয়ে যাচ্ছি।’ টিকিটের দাম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তিনি জেনেছেন, হোমটাউন তাঁকে ন্যায্য দামেই টিকিট দিয়েছে, বাড়তি টাকা নেয়নি।
রিদওয়ান বলছিলেন, গো যায়ান বাংলাদেশের পর পাকিস্তানে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। তারপর তাঁরা সিঙ্গাপুরের কথা ভাবেন। মার্কেট অ্যানালিসিস করার জন্য তাঁরা কোনো সংস্থাকে নিয়োগ দেননি।
রিদওয়ান ও তাঁর কর্মীরা সপ্তাহান্তে সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মার্টের ওখানে যেতেন। সেখানে প্রতি শনি ও রোববার প্রবাসী বাংলাদেশিরা জড়ো হয়ে নিজেদের নানান বিষয়ে আলাপের পাশাপাশি বাড়িতে কত কম খরচে টাকা পাঠানো যায়, টিকিট কাটা যায়, কোন ফ্লাইটে একটু বেশি লাগেজ নেওয়া যায় ইত্যাদি আলোচনা করেন। ‘আমরা তাদের সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি। ফলে টিকিটের সমস্যার সমাধান করাটা আমাদের জন্য সহজ ছিল। কেননা এটাই গো যায়ানের মূল কাজ। টিকিটিং দিয়ে আমরা হোমটাউনের যাত্রা শুরু করি’—বললেন রিদওয়ান।
অল্পদিনের মধ্যেই প্রবাসীরা তাঁদের বলতে থাকেন, টিকিট করার মতোই দেশে টাকা পাঠানোর একটা সহজ অ্যাপ তৈরি করা যায় কি না। কারণ, কম খরচে টাকা পাঠাতে হলে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে হয় এবং সেটার জন্য কর্মদিবসে ব্যাংকে যেতে হয়। আবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেশি টাকা পাঠালে বাড়িতে সেই টাকা তুলতে বাড়তি খরচ হয়। যে কয়টা অ্যাপে টাকা পাঠানো যায়, সেগুলোর সার্ভিস চার্জও বেশি। আবার হুন্ডি করে টাকা পাঠালে নিরাপত্তার শঙ্কা থাকে এবং প্রণোদনাও পাওয়া যায় না। এসব ভেবে ‘হোমটাউন রেমিট্যান্স সেবা’ চালুর উদ্যোগ নেন রিদওয়ান।
তবে রিদওয়ানদের জন্য কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, রেমিট্যান্স লেনদেনের জন্য সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে অনেক আর্থিক নিয়ম মানতে হয়। বিশেষ করে হিসাবধারীর কেওয়াইসি (KYC), দেশে কোনো একটি ব্যাংকের সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে ডিজিটালি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা, সেখান থেকে অন্য ব্যাংক বা মোবাইল আর্থিক সেবায় স্থানান্তরের সুযোগ থাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়। অবশেষে সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে হোমটাউন তাদের অ্যাপে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা যোগ করতে সক্ষম হয়।
সাইফুল বললেন, ‘এই অ্যাপের মাধ্যমে শুধু যে সহজে ঘরে বসে টাকা পাঠাতে পারছি তা নয়, বরং যত টাকা পাঠাই না কেন হোমটাউনের সার্ভিস চার্জ মাত্র তিন টাকা (সিঙ্গাপুর ডলার)। অন্য কোনো অ্যাপে টাকা পাঠালে টাকার পরিমাণ বাড়লে সার্ভিস চার্জও বেড়ে যায়।’
বর্তমানে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ ফ্লাইটের ৩৮ শতাংশ বাজার শেয়ার এবং মাসে ৮ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রসেসিং করে হোমটাউন। এ জন্য মার্কেটিংয়ের পেছনে তাদের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি।
সিঙ্গাপুরে সফলতার পর হোমটাউন এখন মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে সেবা সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছে। এই বড় বাজারগুলোতে বিভিন্ন নিয়মাবলি, নগদ নির্ভরতা এবং বিস্তৃত কমিউনিটির মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে রিদওয়ান আশাবাদী, এখানেও তাঁরা সফল হতে পারবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রব স র দওয় ন র জন য ম হব ব ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
রমনা বটমূলে বোমা হামলা: ২৪ বছরেও হয়নি বিস্ফোরক মামলার রায়
রাজধানীর রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর দুই যুগ পার হয়েছে। এ ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। কবে রায় হবে, নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা হয়। এতে ১০ জন প্রাণ হারান। ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে ১৩ বছর আগে। তবে, ২৪ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ।
তিন বছর আগে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে ছিল। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলাটি বদলি করে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি পাঠানো হয় মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৫ তে।
মামলাটি এখন আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির পর্যায়ে আছে। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, মামলার তিন আসামি সিলেটের এক মামলায় সেখানে থাকায় তাদের আদালতে হাজির করা হয়নি। এদিকে, এক আসামির পক্ষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হয়েছে। বিচারক সাইফুর রহমান মজুমদার আগামী ২০ এপ্রিল শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজ হাসান বলেছেন, “গত অক্টোবরে আমরা নিয়োগ পেয়েছি। ডিসেম্বরে ছিল শীতকালীন অবকাশ। আমরা খুব বেশি সুযোগ পাইনি। রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের পিপি স্যার আছেন। তাকে সব সময় ইনফর্ম করি। পিপি স্যার যে দিকনির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করব। আসামিরা অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ায় তাদের এ মামলায় হাজির করা যাচ্ছে না। এজন্য একটু সময় লাগছে।”
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এ মামলা সম্পর্কে আমার জানা নাই। খোঁজ নিয়ে দেখব।”
বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন—আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, শাহাদাতউল্লাহ ওরফে জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই। তাদের মধ্যে মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর ও মুফতি আব্দুল হাই পলাতক এবং অপর আট আসামি কারাগারে আছেন।
আসামি আরিফ হাসানের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেছেন, আগের সরকার ইচ্ছে করে এ মামলার বিচার শেষ করেনি। আসামিদের আটকে রেখে দিয়েছে। কারণ, তারা জানত, আসামিরা রমনায় বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেনি। উচ্চ আদালতে তারা খালাস পাবেন। এ কারণে মামলা শেষ না করে ঝুলিয়ে রেখে আসামিদের আটকে রেখেছে। আমরা চাই, মামলার বিচার শেষ হোক। রমনা বটমূলে ঘটনা ঘটেছে, মানুষও মারা গেছে। দোষীদের বিচার আমরাও চাই। মামলার বিচার শেষ হলর কেউ দোষী হলে সাজা পাবে আর দোষ না করলে খালাস পাবে।
২০০১ সালের পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং এর পরপরই আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই সাত ব্যক্তি প্রাণ হারান এবং ২০-২৫ জন আহত হন। পরে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। এতে ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ।
দুটি মামলার মধ্যে প্রায় ১৩ বছর পর হত্যা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালের ২৩ জুন। রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আব্দুল মান্নান, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলালউদ্দিন, মো. তাজউদ্দিন, আলহাজ মাওলানা হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আব্দুল হাই।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা সাব্বির ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ ও হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া।
তাদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিনসহ তিন আসামি এখনো পলাতক। শীর্ষ জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আব্দুল মান্নানের অপর এক মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এজন্য বিস্ফোরক মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের ওপর আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষ হয়। শুনানি শেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ মার্চ চূড়ান্ত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের তারিখ ঠিক করা হয়। পরে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপর মামলাটি যায় বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এসএম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চে। সেখানে দীর্ঘদিন থাকার পরও মামলাটির শুনানি হয়নি।
হত্যা মামলা সম্পর্কে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবি বলেছেন, ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। শুনানিতে আমরা বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। প্রত্যাশা করছি, সর্বোচ্চ সাজা রায়ে বহাল থাকবে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বোমা হামলায় নিহতরা হলেন—চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার দুবলা গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩৫), বরগুনা জেলার বামনা থানার বাইজোরা গ্রামের আবুল হোসেন ওরফে এনায়েত হোসেনের ছেলে জসিম (২৩), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার বিরামকান্দি গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে এমরান (৩২), পটুয়াখালীর সদর থানার ছোট বিমাই গ্রামের মৃত অনবী ভূষণ সরকারের ছেলে অসীম চন্দ্র সরকার (২৫), পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার কাজীপাড়া গ্রামের আবুল কাশেম গাজীর ছেলে মামুন (২৫), একই গ্রামের সামছুল হক কাজীর ছেলে রিয়াজ (২৫), একই এলাকার আবুল হাশেম গাজীর মেয়ে শিল্পী (২০), নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার রথি রুহিত রামপুর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে ইসমাইল হোসেন স্বপন (২৭), ঢাকার দোহার থানার চরনটসোলা গ্রামের মৃত আয়নাল খাঁর ছেলে আফসার (৩৫) ও অপর এক জন অজ্ঞাত পুরুষ।
ঢাকা/মামুন/রফিক