বিদেশি বিনিয়োগেও দাঁড়াতে পারল না আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
Published: 11th, April 2025 GMT
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাকা নিলামের মাধ্যমে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৫৩ শতাংশ শেয়ার কিনলেও সফল হতে পারেনি। নিলামের শর্ত মেনে এ ব্যাংকে বিনিয়োগ করে বিদেশি গ্রুপটি। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এরই মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা মামলা করায় দেশীয় ব্যাংকটির শেয়ার কেনাবেচার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। ফলে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বুঝে পায়নি আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ। যে কারণে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে চলতি বছরে এসে পর্ষদ বিলুপ্ত করে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ আগ্রহ নিয়ে ব্যাংকটিতে বিনিয়োগ করেছিল। তবে আইনগত কারণে তারা পুরো নিয়ন্ত্রণ বুঝে পায়নি। রাষ্ট্রীয় সহায়তায় আইনি সমাধান হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহী হবে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, দেশীয় এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। তখন এটি আল-বারাকা ব্যাংক নামে পরিচালিত হতো। ১৯৯৪ সালে এটি ‘সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে’ পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে।
এরপর ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ায় ২০০৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে। ২০০৭ সালে ব্যাংকটির নতুন শেয়ার ইস্যু করে নিলামে তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার কিনে ব্যাংকটির অংশীদার হয় সুইজারল্যান্ডের আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ। তারা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে গ্রুপটির শেয়ার কেনাবেচার চুক্তি হয় এবং ২০০৮ সালের ৫ মে ব্যাংকটি ব্যবসা চালুর অনুমতি পায়। এ সময় ব্যাংকটির নামকরণ করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে শেয়ার ধারণ করায় দেশের শীর্ষ দুটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করায় বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাজেয়াপ্ত করে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মামলা করে। এর মধো তিনটি মামলার রায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে যায়। তবে অন্যান্য মামলায় স্থিতিবস্থা জারি করা হয় এবং সব পক্ষকে চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। মামলার বাদীরা হলো মেহেদী হাসান, সালমান করিম, প্রুডেন্সিয়াল সিকিউরিটিজ, নিয়াজ আহমেদ, ওরিয়ন ইনফিউশন ও রেজাউল করিম। ফলে আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপও ব্যাংকটি নিয়ে আর এগোয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও মামলা নিষ্পত্তিতে জোর দেয়নি। এতে ব্যাংকটি দিনে দিনে খারাপ হয়ে পড়ে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটির প্রায় ৫৩ শতাংশ শেয়ার আইসিবি গ্রুপের, ৭ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের, ২৪ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ও ১৫ শতাংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল ১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের শেষে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ বা ৬৭২ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসান করে চলেছে। ২০২৩ সালে লোকসান হয় ৫৬ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল ব্যাংকটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২ টাকা ৯০ পয়সা।
গত বুধবার আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ–সংক্রান্ত চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সুশাসন নিশ্চিতে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের দুর্বলতার কারণে মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শ্রেণিকৃত বিনিয়োগ ও পূঞ্জীভূত ক্ষতি বিপুল। ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা ও তারল্যসংকট তীব্র হয়েছে। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণে পর্ষদের দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং সুশাসন বিঘ্নিত হচ্ছে। পর্ষদ আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এসব কারণে আমানতকারীদের স্বার্থ ও জনকল্যাণ নিশ্চিতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের অধীন বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষায় এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমানকে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ করা হলো।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশিরা বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠান চালাতে এভাবে বাধাগ্রস্ত হলে অন্য বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ হারাবে। তাই এসব মামলা দ্রুত সুরাহা করে বিদেশিদের কাছে ব্যবসা সহজ করার বার্তা দিতে হবে। তাহলেই বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ বিনিয়োগ করেও কেন সফল হয়নি, তা দেশের ব্যর্থতা। কেন এত দিনেও মামলার সমাধান হলো না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিশ্চয়ই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। দেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, এটা তার একটা বড় উদাহরণ। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনার আগে সমস্যার সমাধান করা উচিত। ব্যাংক খাত নিয়ে সরকারকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ওর য় ন ট ল ব য ইসল ম ক ব য ব ন য় গ কর পর চ ল ব যবস আইস ব
এছাড়াও পড়ুন:
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে পাওয়া গেল ২৮ বস্তা টাকা, চলছে গণনা
কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদের ১১টি দানবাক্সে এবার পাওয়া গেছে ২৮ বস্তা টাকা। এর মধ্যে আছে বিদেশি মুদ্রাসহ বেশ কিছু অলংকার এবং প্রচুর চিরকুট।
আজ শনিবার সকাল ৭টায় মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান, পুলিশ সুপার মো. হাছান চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার ও রূপালী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে বাক্সগুলো খোলা হয়।
এরপর বাক্সে পাওয়া টাকাসহ সবকিছু সিনথেটিক বস্তায় ভরে মসজিদের দোতলার মেঝেতে ঢেলে সেগুলো আলাদা করে শুরু করা হয় গণনা। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ৩০ নভেম্বর ১১টি দানবাক্স পাওয়া ২৯ বস্তা টাকা গণনা করে পাওয়া গিয়েছিল গিয়েছিল মোট ৮ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৪ টাকা। এরপর সমুদয় টাকা রূপালী ব্যাংকে মসজিদের হিসাবে জমা করা হয়।
পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সের নূরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার ৭৫ জন ছাত্র, ৪৫ জন শিক্ষক ও স্টাফ, আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার ১৯৪ জন ছাত্র, রূপালী ব্যাংকের ৮০ জন স্টাফ টাকা গণনার কাজে অংশ নিয়েছেন। পুরো কার্যক্রমে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ জন কর্মকর্তা, ১৪ জন সেনা সদস্য, ৩০ জন পুলিশ সদস্য ও ৯ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলার নিয়ম থাকলেও এবার রমজানের কারণে খোলা হয়েছে চার মাস ১২ দিন পর। দানবাক্সের বাইরেও মানতকারীরা বিভিন্ন জাতের গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, কবুতর, দুধ এবং সবজিও দান করে থাকেন। এগুলো উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করে মসজিদের ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়।
দানবাক্স খোলার পর জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেন, এসব টাকার থেকে দরিদ্র মানুষের বিভিন্ন বিপদে সহায়তা করা হয়। স্টাফদের বেতনসহ এতিম ছাত্রদের সমুদয় খরচ বহন করা হয়। রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ এখান থেকেই মেটানো হয়। মসজিদের কিছু উন্নয়ন কাজও হাতে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, টাকা গণনার সময় সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। দানবাক্স খোলা থেকে সমুদয় টাকা ব্যাংকে জমা করা পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে প্রায় পৌনে দুশ বছর আগে গড়ে ওঠা এই মসজিদে দেশ-বিদেশের নানা ধর্মের মানুষ অনুদান পাঠান। প্রতি জুমার দিন দেশের নানা জেলার প্রচুর মানুষ এখানে নামাজ আদায় করে অনুদান দিয়ে যান। অনেকে মানি অর্ডারের মাধ্যমেও অনুদান পাঠান। এখানে দান করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় বলে মানুষের বিশ্বাস। ব্যাংকে জমা রাখা দানের টাকার লভ্যাংশ থেকে মসজিদ কমপ্লেক্সের নানা রকম খরচ মিটিয়ে হতদরিদ্র মানুষদের নানা আপদ বিপদে সহায্যও করা হয়ে থাকে।
জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেছেন, দানবাক্সে পাওয়া টাকা থেকে অসহায় জটিল রোগীদের অনুদান দেওয়া হয়। মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসার ১৩০ জন এতিম ছাত্রের খরচসহ মসজিদ পরিচালনার খরচও মেটানো হয়। জমানো টাকা থেকে পুরুষ ও মহিলাদের নামাজের আরও দুটি শেড নির্মাণ করা হবে। এছাড়া মসজিদ কমপ্লেক্সের সম্প্রসারণের কাজও করা হবে।