শুল্কযুদ্ধের হুঙ্কার দিয়ে মাঠে নামলেও এক সপ্তাহের মাথায় পিছু হটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পুঁজিবাজারে ব্যাপক পতন, ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ এবং এমনকি ঘনিষ্ঠজনের চাপের পরও পাল্টা শুল্ক নিয়ে অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে মার্কিন সরকারি বন্ড বাজারে তীব্র পতনের পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রেসিডেন্টের কৌশলের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্ভাব্যভাবে বিপর্যয়কর এবং তাঁর উপদেষ্টাদের পূর্বাভাসের চেয়েও খারাপ হতে পারে। এ অবস্থায় বন্ড বাজার নিয়ে ট্রেজারি বিভাগের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ট্রাম্পকে পাল্টা শুল্ক স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে। বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত তিনজন সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। 

এদিকে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমঝোতায় এলেও চীনের ওপর ব্যাপক ক্ষেপেছেন ট্রাম্প। তিনি চীনা পণ্যে কয়েক ধাপে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর কারণ হলো, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করেছে, যা আগে ছিল মাত্র ৩৪ শতাংশ। তবে তাত্ত্বিকভাবে এই বাণিজ্যযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের ওপরই বেশি প্রভাব ফেলবে। যদিও এর আগে চীনা পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্কের কথা বলা হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্ক বেড়ে ১২৫ শতাংশ নয় বরং ১৪৫ শতাংশ হয়েছে। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেন, ১২৫ শতাংশ মূলত পাল্টা শুল্ক। এর সঙ্গে দেশটির ওপর আগে থেকেই আরোপ করে রাখা ২০ শতাংশ শুল্কও যুক্ত হবে। ফলে চীন আসলে প্রায় ১৪৫ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। 
গত কয়েক দিন ধরেই রিপাবলিকান ও ব্যবসায়ীরা ট্রাম্পকে পাল্টা শুল্ক আরোপ বন্ধের তাগিদ দিচ্ছিলেন। তারা আশঙ্কা করছিলেন, এই নীতি তুমুল বাণিজ্যযুদ্ধ, বৈশ্বিক বাজারের পতন, বিশ্বব্যাপী মন্দার আবির্ভাব ঘটাতে পারে। এতকিছুর পরও ট্রাম্প বলছিলেন, তিনি তাঁর এই নীতি থেকে কখনোই সরে আসবেন না। তবে বন্ড বাজারে অস্থিরতা তাঁকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করে। এর সঙ্গে বাকি উদ্বেগগুলোও এতে রসদ জুগিয়েছে। পরে অবশ্য ট্রাম্প বিষয়টি স্বীকারও করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বন্ড বাজার খুবই জটিল, আমি এটা দেখছিলাম। এখন বন্ড বাজার সুন্দর। তবে গত রাতে আমি দেখেছি, মানুষ একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল। 
সিএনএন জানায়, ট্রাম্পের হঠাৎ উল্টো পথে হাঁটার অন্যতম কারণ হলো, বন্ডের সুদহার এবং বন্ড বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়া। মার্কিন বন্ডের সুদহার গতকাল ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উঠে যায়। সেই সঙ্গে বিক্রির চাপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিপ্রণেতাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। এমনকি অর্ধশত বিলিয়ন ডলারের বন্ডের নিলামের নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়। সেটা হলে দেউলিয়া হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। সম্ভবত এই চাপেই ট্রাম্প শেষমেশ নতিস্বীকার করেন। 

বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পেডেন অ্যান্ড রাইগেলের প্রধান অর্থনীতিবিদ জেফরি ক্লিভল্যান্ড বিবিসিকে বলেন, বাস্তবতা হলো, বিপদ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এই অনিশ্চয়তার কারণে আগামী তিন মাস বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে যাবে। মন্দা এড়ানো গেলেও প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে। হঠাৎ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে। 
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের ঘোষণায় বিশ্ববাজারে স্বস্তি ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি এশিয়া ও ইউরোপের পুঁজিবাজারে ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা দেয়। শুল্ক স্থগিতের ঘোষণায় বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি– এনভিডিয়া, অ্যাপল, টেসলা, মাইক্রোসফট, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ও অ্যামাজন। গত বুধবার এই সাত কোম্পানির শেয়ারের দর এক লাফে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে এক দিনেই তাদের সম্মিলিত বাজারমূল্য দেড় ট্রিলিয়ন ডলার বাড়ে। 
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ পুরো পৃথিবীর সামনে নতুন এক নেতিবাচক পরিস্থিতি হাজির হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধস নামতে শুরু করে। ডলারের বিনিময় হার কমে যায়, তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। বাজার অর্থনীতিতে রীতিমতো কাঁপন শুরু হয়ে যায়। 
এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে শুরু করে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছে। অর্থাৎ, সবাই আপাতত নির্ভার হয়েছে। কিন্তু এখনই উদযাপন করার কিছু নেই। 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাল্টা শুল্ক স্থগিত হলেও এখনও বেজলাইন বা ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক রয়ে গেছে। তার সঙ্গে আছে আগের আরোপিত শুল্ক। তাছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের পণ্যে ব্যাপক শুল্কও রয়ে গেছে। ফলে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য এখনই স্বাভাবিক হচ্ছে না। এশিয়া অঞ্চলের অনেক দেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। এই দেশগুলো দেশটির রপ্তানিমুখী শিল্পের সংযোগ শিল্প হিসেবে কাজ করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমে গেলে এসব দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

চীনা শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব পড়বে 
গত বছর চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে। এটি চীনে মার্কিন রপ্তানির প্রায় তিন গুণ। এই হিসাব ইঙ্গিত দেয়, উচ্চ শুল্ক চীনা ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও বড় ক্ষতির মুখে ফেলবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডিস অ্যানালিটিকসের সারাহ ট্যান বলেন, ৮৪ শতাংশ চীনা শুল্ক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। চীনের পাল্টা পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব খাত বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে, তার মধ্যে অন্যতম কৃষি। 

১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপকে কীভাবে দেখছে চীন
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। সেটা এখন বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে ১৪৫ শতাংশে। তবে পিছু না হটার ইঙ্গিত দিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, তাদের সরকার উস্কানিকে ভয় পায় না। এরই মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ করেছে চীন। 
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের উচ্চ হারের শুল্ক আরোপ করা হলে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে লাভ করা প্রায় অসম্ভব। আবার এই শুল্কহার চলমান থাকলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের আরও অবমূল্যায়ন হতে পারে। বৃহস্পতিবার গত ১৯ মাসের মধ্যে ডলারের বিপরীতে ইউয়ান সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। 

এদিকে, পুঁজিবাজারে লেনদেন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘোষণা দিয়েছে ডেমোক্র্যাট শিবির। সিনেটর অ্যাডাম শিফ বলেছেন, কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতার পর অভ্যন্তরীণ লেনদেনের তদন্ত শুরু করবেন। 
বুধবার ট্রাম্প শুল্ক স্থগিতের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে নিজের মিডিয়া গ্রুপ ডিজেটির শেয়ার কিনতে উৎসাহিত করেছিলেন। এ নিয়ে শিফ বলেন, তাহলে প্রশ্ন হলো– পাল্টা শুল্ক তুলে নেওয়ার বিষয়টি ট্রাম্প ছাড়া কে কে জানত? প্রেসিডেন্টের আশপাশের লোকজন কি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেয়ার বিক্রি করেছিলেন? 

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প বন ড ব জ র ব ষয়ট র ওপর ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

চুরির অপবাদ দেওয়ায় শরীরে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা, দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে

কুমিল্লার চান্দিনায় চুরির অপবাদ দেওয়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার এক চালক শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চান্দিনা উপজেলা সদরের সরকারি হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

মো. সবুজ নামের ওই চালককে চান্দিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরিফুর রহমান জানান, আগুনে সুবজের শরীরের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

সবুজ চান্দিনা উপজেলার বাড়েরা ইউনিয়নের গড়ামারা গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চান্দিনা উপজেলা সদরের বেলাশহর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চান্দিনা সদরের হাসপাতাল সড়কের ইউনুছ মিয়ার অটোরিকশা গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে সবুজসহ তিনজন ওই গ্যারেজে তাঁদের অটোরিকশা রাখেন। পালাক্রমে তাঁরা তিনজন পাহারাও দেন। প্রায় চার মাস আগে এক রাতে পাহারার দায়িত্ব ছিলেন সবুজ। ওই দিন রাত আনুমানিক দুইটার দিকে গ্যারেজে তালা দিয়ে সবুজ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ওই সময় চোরচক্র দুটি অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন ওই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মানিক নামের একজনকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়। সেদিন রাতেই পুলিশ মানিককে ছেড়ে দেয়। পরে স্থানীয় কয়েকজন মাতবর সবুজকে চোর আখ্যা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু সবুজ জানান, তিনি ওই রায় মানেন না এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় স্থানীয় কয়েকজন মাতবরের প্ররোচনায় সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি সবুজকে আটক করে তাঁর অটোরিকশা নিয়ে যান। এ সময় তাঁকে চোর আখ্যা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে চাপ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সে প্রকাশ্যে শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।

সুবজের স্ত্রী খুশি আক্তার বলেন, ‘মাতবররা চোর ধরে ছেড়ে দিছে আর আমার স্বামীরে চুরির অপবাদ দিয়ে জরিমানা করেছে। আমার স্বামী চোর আখ্যা দেওয়ার এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গরিবের জন্য আইন নাই, বিচার নাই। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’

গতকাল রাতে চান্দিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাবেদ উল ইসলাম বলেন, ‘অটোরিকশা চুরির ঘটনায় সময় মানিক, সাইফুল ও নাজমুল নামের তিনজনের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি মামলা হয়। ওই চুরির ঘটনায় সবুজকে দায়ী করে চাপ সৃষ্টি করলে সে অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জেনেছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ