Samakal:
2025-04-12@21:11:49 GMT

জীবনশিল্পীর অভিজ্ঞান

Published: 10th, April 2025 GMT

জীবনশিল্পীর অভিজ্ঞান

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের দিক থেকেই রবীন্দ্রনাথ রচনায় ও ভাষণে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সমালোচনায় পূর্বাপেক্ষা হয়ে ওঠেন স্পষ্টবাদী। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী মনোভাবের চরম প্রকাশ ঘটে ‘ন্যাশনালিজম’ সম্পর্কে আমেরিকা ও জাপানে প্রদত্ত বক্তৃতায় (১৯১৬)। এসব বক্তৃতার প্রধান লক্ষ্য ছিল মানবতাবাদের প্রেক্ষাপটে শোষণধর্মী রাষ্ট্রনীতির নগ্নরূপের উদ্ঘাটন। পূর্বেই রবীন্দ্রচেতনা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে আশ্রয় করেছিল, (‘গোরা’ উপন্যাস) তারই ধারা এ-পর্যায়ে উপনীত হচ্ছিল বিশ্বমানববাদে। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ মননকে তিনি নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে চাইলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর্যায়ে তিনি স্বদেশি সমাজের রাজনীতিক সমস্যার চিন্তায় শুধুই দেশজ সংস্কৃতিসত্তার গভীরে মগ্ন বা প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ ভাঙনে উৎসাহী। ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’তে আমরা বিশ্বসংকট, সংকটের শ্রেণিগত রূপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তিত চৈতন্যকে প্রত্যক্ষ করি। ব্যক্তিবিশ্বের সংকটকে বিধৃত করার পূর্বধরন বদলে গেল, জীবন ও প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বকে তিনি বিশ্বব্যাপী ধনতান্ত্রিক সংকটের পটভূমির বিস্তৃত সীমায় পর্যবেক্ষণ করতে চাইলেন। এটা রবীন্দ্রচেতনার দ্বান্দ্বিক ক্রমবিকাশ বা আপতিক সূত্র নয়, তাঁর চৈতন্যস্থিত মানবতাবাদের ধারাবাহিক চিন্তাটির রূপান্তরিত-মাত্রা, ব্যক্তির আত্মত্রাণ ও যূথবদ্ধ মানবের মুক্তিকে ঐতিহাসিক সত্যের বিবেচনাসাপেক্ষ করা। কাব্যনাট্য সর্বদা আরাধ্য করে তোলে যৌথ মানবের মুক্তির সূত্রে ব্যক্তিমানুষের পরিত্রাণ-লক্ষ্য এবং অন্তিমত মানবপ্রজাতির অন্তঃসারকে। রবীন্দ্রনাথ কাব্যনাট্যের নান্দনিকরূপে বিচরণরত তাঁর শিল্পভাবনাকে উক্ত সূত্রে করে তোলেন আরও বেশি সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাবহ, কিন্তু পূর্বাপেক্ষা বিজ্ঞানমনস্ক। তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন দেশজ পটপ্রেক্ষার সঙ্গে বিশ্বের লোকায়ত সংস্কৃতির অনুষঙ্গ সংযোজনায়। ‘রক্তকরবী’র ধ্বজাপূজা, খোদাইকর– এগুলোর মধ্যে ভিন্নদেশের লোকায়ত ভাবনার প্রবর্তনা ঘটেছে। 
কেননা রবীন্দ্রভাবনায় দেশ-জাতির মর্মস্থল রাষ্ট্র নয়, সমাজ। সেই সমাজকেন্দ্রিক মর্মস্থলটি আবিষ্করণে তিনি ক্রমে আন্তর্জাতিক মানবসংস্কৃতির প্রতি নিবিষ্ট হয়েছেন। তবে উক্ত অনুষঙ্গসমূহ তাঁর নাট্যবিষয়ের রূপকল্পের প্রযুক্তি হিসেবেই এসেছে।
‘মুক্তধারা’য় (১৯২২) পরিলক্ষিত হয় একটি বিদ্রোহের মাত্রা। শিল্পবিপ্লবের আদি পর্যায়ে মানুষ যন্ত্রকে তার অস্তিত্ববিনাশক প্রতিশক্তি হিসেবে দেখেছে, নিষ্পেষক-যন্ত্রের কবল থেকে শস্যময় প্রকৃতিসত্তার উজ্জীবন ঘটাতে চাইছে এবং নিজের শ্রমশক্তির মুক্তিকে বাঁধ ভাঙার প্রতীকে রূপ দিয়েছে। যদিও আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে আত্মশক্তির স্ফুরণকে তিনি প্রধান করেন, কিন্তু শ্রেণিবদ্ধ ব্যক্তির সক্রিয় সংঘবদ্ধ রূপটিও তাঁর দৃষ্টিলোকে প্রতিভাসিত হয়ে উঠছিল। ‘মুক্তধারা’য় নায়ক অভিজিতের কল্যাণধর্মী নেতৃত্বের প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে সত্য করে তুলেছেন, আবার একটি হতবীর্য, পরাধীন জাতি বহির্জগতের প্রতিকূলতাকে ব্যক্তিবিশেষের অন্তর্শক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে চায়– এ তথ্যও তুলে ধরেন। কিন্তু ‘রক্তকরবী’র বক্তব্য এ রকম দোলাচলে আক্রান্ত নয়, সেখানে মানুষের সম্মিলিত সক্রিয় হস্তক্ষেপে শ্রেণিসংঘর্ষের অবসান ঘটে। শত্রু ধ্বংসের মধ্য দিয়েই মুক্তি সম্ভব হয় এবং এ-মুক্তি শ্রেণিবদ্ধ বন্দিব্যক্তিত্বের মুক্তিকেও সত্য করে তোলে। এখানে অন্তর্নিহিতরূপে রবীন্দ্রচেতনার রূপান্তরিত-সূত্রটি খুঁজে পাই, যখন তিনি শ্রেণিহীন ব্যক্তির মধ্যেই তাঁর অন্বিষ্ট বিশ্বমানবের রূপান্তর ঘটান। 
‘রক্তকরবী’ নাটকে শ্রেণিভিত্তিক বাস্তব পটভূমিটি পরিপ্রেক্ষিতসহ নির্মিত। শ্রমবিভক্ত মানবিক সত্তার বিচ্ছিন্নতা ও মানবেতর বিকৃত রূপটি তিনি শ্রেণিসত্যের আলোকে তুলে ধরেছেন, আগের মতো অসীম সত্যের প্রবাহে এই অসংগতিকে নিছক বৈপরীত্যরূপে প্রতীকায়িত করছেন না। তবে একথাও বলা যাবে না, রবীন্দ্রচেতনা মূলরূপ থেকে বিপ্রতীপ অবস্থানে সরে গেছে। এখানেও শ্রেণিসংগ্রাম চিরায়তকালের ঘটনাপটেই অনুসন্ধেয়, আজকের সমস্যার একটি চিরায়ত রূপ তাঁর চিন্তায় ছিল জাগরূক। নাটকে বিধৃত ধনতান্ত্রিক সংকট ও কৃষিজ সভ্যতার দ্বন্দ্বরূপ রামায়ণের যুগেও সত্য ছিল বলে তিনি ইঙ্গিত করেছেন (বর্তমানকালে অবশ্য সমস্যার রূপটি হয়েছে অতি প্রকট, নন্দিনীর মানবীসত্তার অন্তরালে অরূপসত্তার আভাসকে বিশ্বমানবের সত্তা হিসেবে ভাবেন। আদি কবি বাল্মীকির ধ্যাননেত্রে উদ্ভাসিত রামায়ণ কাহিনির মতোই রবীন্দ্রনাথের চেতনায় বিরাজমান ছিল একটি ভাবসত্য, বিশ্বসংকটের ঘনীভূত রূপ ও তার দ্বন্দ্ব হয়েছে যে-ভাব সত্যের কাঠামো। ‘বিসর্জন’ বা ‘মালিনী’ নাটকের মতো এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ স্বপ্নলব্ধ কাহিনির যুক্তি দেখান না, চেতন-অবচেতনের প্রতিচ্ছায়ায় ঘটনাকে পান না, প্রত্যক্ষ বস্তুবিশ্ব তাঁকে ঘটনাসূত্র সরবরাহ করেছে। ফলে তিনি প্রতীতির ভিত্তিমূল পেয়েছেন, যেখানে জীবন ও শিল্পময়তার অভিন্ন প্রকাশ যথাযথ নাট্যরূপটি গড়ে নিতে পেরেছে, যে-রূপ ব্যতীত আমরা তাঁর ভিশনকে নানা মাত্রায় বিশ্লেষণের সুযোগ পেতাম না। উক্ত নাট্যরূপে রয়েছে চতুর্থমাত্রিক প্রবাহ, দেশ-কাল-ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষের যে কোনো সংকটকে তার মধ্যে প্রতীকায়িত রূপে খুঁজে পাওয়া যাবে। আবার সেই প্রবাহে বাস্তবতার অস্তিত্বের মধ্যেই ভাবীকালের নির্মাণকে নাট্যকার কাব্যশক্তি দিয়ে সত্য করে তুলেছেন। ‘রক্তকরবী’র দেশ-কাল-ব্যক্তি ও ঘটনায় ভাবীকালের সত্যরূপ দর্শনের এরকম প্রসূতমাত্রা রবীন্দ্রনাটকে পূর্বে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেনি। স্থানকালপাত্রকে যে অসীমত্ব দিয়ে তিনি দেখেছেন, সেই অসীমত্ব এখানে অনিবার্য বাস্তবতার প্রকল্পনায় শুধু সম্ভাবনাকে নয়, ঘটনাকেও রূপবদ্ধ করেছে। তাই স্বপ্ন নয়, অবচেতন নয়, বিচ্ছিন্নতার ঊর্ধ্বায়নও নয়, ‘রক্তকরবী’তে একটি ইতিহাসের সত্য বিম্বিত।
ইতিহাসের বহির্তথ্য ও মানবজাতির যৌথ জগৎ নাটকটির ভিত্তি হলেও অন্তর্গত বিষয়রূপে ব্যক্ত হয়েছে ব্যক্তি-আত্মার সংগ্রাম ও যন্ত্রণা। ‘রক্তকরবী’র ভেতরের কথা হলো, মানসজগতের তথা আত্মবদ্ধ, নিঃসঙ্গ ব্যক্তিমানুষের বন্দিচেতনা থেকে মুক্তি। ‘মুক্তধারা’য় যন্ত্ররাজ বিভূতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব ছিল প্রত্যক্ষ, ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরীর রাজা আত্মদ্বন্দ্বের মাত্রায় অবস্থান করে। সে একদিকে শ্রেণিমানুষের প্রতিনিধি, আরেকদিকে ব্যক্তিমানুষের আত্মিক লক্ষ্যে নিজের গভীরে অনন্য মূল্য সন্ধানের প্রতীক। ফলে নাটক আর রূপকের দ্বিচারিতায় আবদ্ধ থাকে না, উত্তীর্ণ হয় বিশ্ব ও ব্যক্তিমানসের নানামাত্রিক প্রতীকতায়।
যক্ষপুরীর রাজার শ্রেণিরূপ যা-ই হোক, রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখেন শ্রেণিস্বার্থের বন্ধনে পীড়িত মানবাত্মারূপে এবং এ বন্ধন স্বসৃষ্ট। তাঁর দৃষ্টি শ্রেণিমানুষটির মধ্যে ব্যক্তির সীমাবদ্ধতার সূত্র হিসেবে শ্রেণিরূপকে বিবেচনা করে। নন্দিনীর আহ্বানে রাজার শ্রেণিবন্ধন লুপ্ত হয়, সে আহ্বানও সম্মিলিত শক্তির ধারক, সামাজিক সংহতির প্রতীক। এ রকম মুক্তির প্রকল্প ‘বিসর্জন’ বা ‘রাজা’ নাটকেও পূর্বাপর অঙ্কিত হয়েছিল, সেখানে জয়সিংহের আত্মবিসর্জন ছিল ব্যক্তির মানসিক তদন্ত ও আত্মসিদ্ধান্তের সূচক; রঘুপতির মুক্তিলাভও ছিল একক ব্যক্তির মানসপরিবর্তন মাত্র। ‘রক্তকরবী’র অদৃশ্য চরিত্র রঞ্জনের আত্মোৎসর্গ অনুরূপ অর্থে একমাত্রিক নয়, তার আত্মদান মানবপ্রজাতির বৃহৎ তাৎপর্যের মধ্যে অঙ্গীকৃত। মানুষকে গভীর কিছু পেতে হলে বড় কিছুর আত্মোৎসর্গ ঘটাতে হয়। আত্মবিসর্জনকে মানবগোষ্ঠীর সমবেত মুক্তির অপরিহার্য নিদানরূপেই রবীন্দ্রনাথ স্থির করেছেন। ঐতিহাসিক স্তরবদ্ধ মানুষকে যেমন কর্ষণজীবী/আকর্ষণজীবী সভ্যতার দ্বন্দ্ব সম্পর্কের মধ্যে বিশ্লিষ্ট করেছেন, তেমনি তার মুক্তির ক্ষেত্রেও বিপ্লব, আত্মোৎসর্গ এবং রক্তপাতের অনিবার্যতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সর্বোপরি ব্যক্তির আত্মসচেতনতা তার মুক্তিকে সত্যতা দেয়, এ তাৎপর্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘রক্তকরবী’র দ্বিমাত্রিক মুক্তিকল্পনায় রাজার এই আত্মদ্বন্দ্বরূপের মুক্তি সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতেও বিশ্লেষণীয় হয়ে ওঠে। নিজ অবস্থানকে মানুষ পরিবর্তিত করতে পারে সম্মিলিত যৌথমানবের শক্তিতে, নিষ্ক্রিয় কল্পনাসত্যে নয়– তার মুক্তি হয়ে ওঠে সক্রিয় ও বাস্তব। এ রকম ধারণার সংগঠন ‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে অযৌক্তিক নয়।
‘রক্তকরবী’র জীবনমুক্তির প্রকল্প পরিবেশিত হয়েছে কাব্যময় ব্যঞ্জনা ও অনুষঙ্গের রূপকল্পে। কাব্যনাটকে দেশজ মহান ক্ল্যাসিকের পুনরুদ্ধার ঘটে এবং প্রবহমান যৌথ জীবনের প্রাত্যহিক ছন্দকেও ব্যবহার করা হয়। অতীতের রূপকগুলো বর্তমানের চাঞ্চল্যে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ভাবনাটির সঙ্গে দর্শককে একাত্ম করে। নাটকে ব্যবহৃত লোকায়ত ভাবনার প্রতিষঙ্গ, প্রাণশক্তির স্বতঃচল প্রবাহ, এমনকি প্রাত্যহিক অথচ নিত্যরূপের অনুসরণে উক্ত একাত্মতা রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন নাটকে পৌষ, চণ্ডীমণ্ডপ, নবান্ন, পার্বণ, মেলা– এসব অনুষঙ্গ দিয়ে দৃশ্যকল্প গড়ে তোলেন, ঘটনা ও কালমাত্রার অবতল নির্মাণ করেন, কখনও-বা তৈরি করেন পটভূমি, তখন আমাদের চৈতন্য জেগে উঠে প্রবিষ্ট হয় হাজার বছরব্যাপী প্রবাহিত জীবনযাত্রার অন্তর্মূলে, প্রকৃতিতে, সত্তার উৎসে। আমরা নাট্যমঞ্চে দর্শন করি উৎপাদনশীল কাঠামোর মধ্যে মানুষের কর্মের সৃজনশীল মুক্তিকে, আনন্দকে এবং যাথার্থ্যকেও। যদিও যে-কৃষিজীবী সভ্যতার উৎপাদন কাঠামো রবীন্দ্রনাথ নির্বাচন করেন, সে-নির্বাচনকে আমরা একটি জীবন্মুক্তির বর্ণিল আবেগের প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করি। শ্রমশক্তির মানবীয় রূপ সম্পর্কে যখন তিনি নিশ্চিত হচ্ছেন, তখনও তিনি অনুভবময়তার পরিমণ্ডল দিয়েই তার আভাস পরিস্ফুট করেছেন। এই পরিমণ্ডল রচিত হয় ফসল ফলানোর আনন্দে, পাকা ধানের চিত্রকল্পে, নবান্নের উৎসবে। আমরা কবির ভাবনায় বৃত হই যখন নাট্যমঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে এই সংগীত– ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয়/ ধুলার আঁচল ভরেছে আজ পাকা ফসলে.

..।’ প্রকৃতি কর্ষণজীবী সভ্যতার লালনে শস্যময় হয়, এই সভ্যতাই মানুষের সৃজনীক্ষমতা ও শ্রমসত্তাকে প্রকৃতিলগ্ন করে, তাকে মুক্ত রাখে। শ্রমদাসত্ব থেকে এই মুক্তি ছুটির আনন্দে ও ফসল ফলানোর যৌথ আবেগে বাঁধা। কর্ষণবৃত্তি মানুষের আত্মবিচ্ছিন্নতাকে প্রবল করে না, তাকে অহমিকায় আবদ্ধ করে না। এ রকম নানা কৌণিক শ্রম তাৎপর্যের অপরূপ উদ্ভাসনই ‘রক্তকরবী’। ‘মুক্তধারা’য় বাঁধ ভেঙে প্রকৃতির প্রাণপ্রবাহ জলস্রোতকে মুক্ত করা হয়েছিল; সেটা ছিল প্রাকৃতিক সত্তার উজ্জীবনে সম্মিলিত মানবশক্তিকে যুক্ত করার ভাবনা। তারও আগে ‘রাজা’ নাটকে ভয়ংকর রূপের মধ্যে, আঘাতের মধ্যে অন্তর্জীবনের মুক্তি ঘটেছিল, সেটাও ছিল মানবিকরূপের ভয়ংকর শক্তিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। ‘রক্তকরবী’ মানুষের ভয়ংকর রূপ ও অন্তর্জীবনের শক্তিকে রূপান্তরিত করেছে ব্যক্তি ও সমষ্টির আন্তঃসংযোগের ব্যাপ্তিতে। রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে ব্যক্ত করেছেন যন্ত্রসভ্যতার পীড়নগ্রস্ত শ্রমজীবীদের মানবাত্মার বিকৃতি তাকে দিয়েছেন মানবীয় সত্তার স্পর্শ ও শ্রমের দাসত্বহীন আনন্দ। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল আত্মিক-সচেতনতায়, কিন্তু ‘রক্তকরবী’তে মানবশক্তির সম্মিলিতরূপই যে ঘটনা সংঘটিত করে– এমনকি রক্তক্ষয়ের মতো বৈপ্লবিক বিধান যে অনিবার্য, সে তথ্যটি বিদ্যমান। আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করি, নাটকের নামকরণে ‘যক্ষপুরী’ বা ‘নন্দিনীর পালা’ নামের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ‘রক্তকরবী’ নামটি নির্বাচন করেছিলেন। এই নাটক রচনার শতবর্ষ পূর্তি হচ্ছে। ‘রক্তকরবী’ জীবনের সেই স্বতঃচল সত্তা, যা আপন শক্তিতে মানবরচিত সকল বিরুদ্ধতা জয় করে নিজেকে বিকশিত করে। v

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র দ বন দ ব ই রব ন দ জ বন র ত হয় ছ প রব হ কর ছ ন র অন ত ত র অন এ রকম আনন দ রকল প

এছাড়াও পড়ুন:

আত্মার অংশ

‘দেবতার সময়ের অভাব নেই, পুজোর জন্য যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে পারেন। মানুষের দুখ মানুষের নাগাল চায় যে, তার তো সময় অল্প।’ সংলাপটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। যতবার ‘রক্তকরবী’ পড়ি, বা কোথাও কোনো আলোচনা শুনি, ঠিক তখনই মনে হয়, আমার ভেতরে অনেক অনেক দিনের জমাট অন্ধকার এখনও আমাকে বেঁধে রেখেছে, ‘এ আমির আবরণে’ এখনও আচ্ছন্ন আমি। 
বাংলা ১৩৩০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রক্তকরবী নাটক লেখেন তখন তাঁর বয়েস ষাট বছরের কিছু বেশি। এ নাটকটি তিনি বহুবার সংশোধন করেছেন। খসড়া করার সময় মূল নাম কখনও নন্দিনী রেখেছেন, কখনও রেখেছেন যক্ষপুরী। অনেক সংশোধনের পর শেষতম নামটি দেন রক্তকরবী।
রক্তকরবী কেমন নাটক? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন পালা, মানবিক পালা। যেখানে আছে একটি যক্ষপুরী, সেই যক্ষপুরীর ভূগর্ভে আছে তাল তাল সোনা। ভূগর্ভের সেই সোনা তুলে আনে সাধারণ মানুষেরা। আছে এক রাজা আর আছে রাজার শাসন। রাজাই সেই যক্ষপুরীর ব্যবস্থার অধিকারী। কিন্তু সে রাজা বড়ই বিচ্ছিন্ন রাজা। যে নির্মম শাসনে সকলকে নিষ্পেষণ করছেন, সেই শাসনযন্ত্রই একসময় চলে যাচ্ছে তাঁর নাগালের বাইরে। তাঁর হাতের মরা ব্যাঙ নিয়ে তিনি অনেক আস্ফালন করেন, করেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও, কিন্তু যে প্রাণের স্পর্শ তিনি পেতে চান, তা আর কিছুতে মেলে না।
এ কারণেই তাঁর নন্দিনীকে প্রয়োজন। নন্দিনী হলো পূর্ণ প্রাণের অধিকারী। এক আদিগন্ত খোলা হাওয়া যার চিরসঙ্গী। আনন্দই যার প্রাণশক্তির উৎস। তাই রাজা চান নন্দিনীর সঙ্গে প্রাণের সংযোগ ঘটাতে। কিছুতেই তা পান না রাজা। 
পূর্ণ প্রাণে যা চাইতে হয়, তাকে রিক্ত হাতে চাইলে, চাওয়াও অসম্পূর্ণ থাকে আর পাওয়া তো যায়ই না। একসময় রাজা সেকথা বোঝেন, অনুভব করেন তিনি নিজেই নিজের কাছে বন্দি। তাই নন্দিনীর কাছে নেমে আসেন তিনি, তার হাত ধরে মুক্তির স্বাদ পেতে চান তিনি। রাজা তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন, কিন্তু নন্দিনী রাজার সবটুকু বাদ দিয়ে শুধু হাত ধরতে চায় না। সমর্পন কখনও আংশিক হয় না। 
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় আমার জীবনের অনন্য এক ঘটনা। নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় শুধু অভিনয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল একটি যাত্রা, এক ধরনের আত্মসন্ধান। আজও আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সেই নারী ‘নন্দিনী’, যিনি ‘রক্তকরবী’র অন্ধকার রাজ্যে আলো নিয়ে এসেছিলেন। নন্দিনী কেবল একটি চরিত্র নয়, এক দর্শন, এক প্রতিবাদ, এক আলোকবর্তিকা। নন্দিনী হচ্ছে সেই নারী, যে ভালোবাসে, প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে, আর সাহসের সঙ্গে সত্যকে গ্রহণ করে। তার কণ্ঠস্বর শুধু নাটকে নয়–সমাজেও প্রতিধ্বনিত হয়।
মানুষের আবেগ, ভাবনা ও স্বপ্নপূরণের কথা তো সবচেয়ে বেশি থিয়েটারে ফুটে ওঠে। আমার জীবনেও অনেক কিছু শিখেছি এই থিয়েটারের মাধ্যমে। ২০০১ সালে আমি যখন থিয়েটারে যোগ দিলাম তখন বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সেই সময় একদিন যুবদা [খালেদ খান] ফোন করে বললেন, ‘‘আমরা দল থেকে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আনছি। তোমাকে আমরা ‘রক্তকরবী’তে একটি চরিত্রে ভাবছি।’’ তার এই কথা শোনা মাত্র আমি রাজি হই। যুবদার সঙ্গে কথা শেষ করে আম্মার কাছে গিয়ে বললাম, যুবদা রক্তকরবীতে অভিনয়ের কথা বলেছেন। মা বললেন কোন চরিত্রে। বললাম তা জানতে চাইনি। আমাকে যেতে বলেছেন। তার কিছুসময় পর আবারো ফোন করলেন যুবদা। বললেন, ‘আমরা নন্দিনী চরিত্রের জন্য তোমায় চিন্তা করেছি। তোমার কাছে রক্তকরবী বইটি আছে। থাকলে একটু পড়ে এসো।’ কথাটি শোনার পর খুশিতে আত্মহারা। 
আমার অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটকে আলী যাকেরকে রাজা হিসেবে পেলাম। আমার অভিনয় জীবনে অনেক ধরনের চরিত্রে কাজ করেছি–আধুনিক, ক্লাসিক, বাস্তবধর্মী, কিংবা একেবারে প্রতীকী। কিন্তু নন্দিনী একেবারে আলাদা। এই চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমাকে মানসিকভাবে তৈরি হতে হয়েছে। কতবার ‘রক্তকরবী’ পড়েছি। নিজের মধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা খুঁজেছি। 

কখনও রাত জেগে নন্দিনীর সংলাপ বলেছি, শুধু অনুভবের জন্য নয়, মুখস্থ করার জন্যও। নন্দিনী যখন বলে, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না’–এই সংলাপটি প্রথম বলেছিলাম একা একা, আমার ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে। শুধু আমি আর শব্দ। কিন্তু সে দিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম–এই চরিত্রের মধ্যে কী অসম্ভব শক্তি লুকিয়ে আছে।
রিহার্সালের সময় শুরুটা সহজ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম নন্দিনীর প্রতিটি অনুভব আমার শরীরী প্রকাশে ফুটে উঠুক। শুধু সংলাপ উচ্চারণ নয়, তার হাঁটা, তাকানো, দাঁড়ানো–সব কিছু যেন সেই প্রতিবাদী, ভালোবাসাময় আত্মা হয়ে ওঠে। সহশিল্পীরা দারুণভাবে সহযোগিতা করেছেন। 
‘রক্তকরবী’ করতে গিয়ে আলী যাকের, খালেদ খান, গাজী রাকায়েত, আতাউর রহমানের কাছ থেকে কত কিছু যে শিখলাম। বিশেষ করে আতাউর রহমান এবং খালেদ খানের কাছে ঋণী হলাম। ওনারা যদি রক্তকরবী না দিত তাহলে আমি হয়তো অন্য অপি হতাম। নাটকটির মহড়ার সময় বুয়েট খুলে দিল। সেই সময় দেখা যেত আমি ক্লাসের ফাঁকে ড্রইং করছি, আর নাটকের সংলাপ বলছি। সেই সময় আমি ইউনিভার্সিটি শেষ করে মহড়ায় অংশ নিতাম। একদিন আলী যাকেরের সঙ্গে কাজ করছি। দুপুরে কিছু খাইনি। ফলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। এটি শুনে যাকের আঙ্কেল বললেন, কে আছে ওই মেয়েকে আগে খাওয়া দাও। ওর পেটের গুড়গুড়ানিতে ডায়ালগ ভুলে যাচ্ছি। মঞ্চ নাটকে যখন কাজ করি, তখন থিয়েটারের শিল্পীরা আমায় বলতেন ভাড়া করা নায়িকা। এ নাটকটির প্রথম শো থেকে শুরু করে যতদিন করেছি, ততদিন সবাই আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। অনেকে যেমন প্রশংসা করতেন, ঠিক তেমনি সমালোচনাও করতেন। যুবদার কথাই বলব। একটা শব্দের উচ্চারণ নিয়ে, তাঁর কাছে জানতে চাইলে, তখন তিনি এই শব্দের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সবই বলেছেন। এগুলো ছিল আশীর্বাদের মতো। একটি ঘটনা আজও মনে পড়ে–একদিন আমরা চূড়ান্ত দৃশ্যের মহড়া করছিলাম। রাজাকে যখন নন্দিনী যখন বলে, ‘জাগো, উঠে দাঁড়াও’–আমি সংলাপ বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম। গলা কেঁপে উঠেছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি অপি নই, আমি নন্দিনী এবং আমি কোনো মঞ্চে নয়, সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি ‘জেগে ওঠো!’ সেই মুহূর্তটি আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার সঙ্গে বোঝাপড়া করাও ছিল একটা বড় কাজ। তাঁর প্রতিটি সংলাপের গতি, ছন্দ, থেমে যাওয়ার সময়–সব নিয়ে বারবার আলোচনা করেছি। নন্দিনীর ভাষায় যে কাব্যিকতা, সেটি বজায় রেখেও অনুভূতিকে বাস্তব করে তোলা–এটি ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে বলেন, মঞ্চে অভিনয় সিনেমা বা টিভির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আমি বলবো, সেটি শুধু মঞ্চে সরাসরি অভিনয়ের জন্য নয়, মঞ্চের চরিত্রগুলোর জন্যও। তারা আপনাকে নিংড়ে নেয়। এবং নন্দিনী তো একেবারে তেমন একটি চরিত্র। সে যেন আমার আত্মাকে নিজের রূপে রাঙিয়ে দিয়েছিল।
১১৭ বার মঞ্চায়িত হয়েছে নাগরিকের ‘রক্তকরবী’। অন্যদিকে নাটকটি রচনার শতবর্ষ পূর্তি হলো এ বছর। বাংলা ভাষার চিরকালের সম্পদ ‘রক্তকরবী’। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐতিহ্যের আলোয়
  • আত্মার অংশ