রক্তকরবী নাটকের আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে শত-সহস্র, অযুত-নিযুতবার, অযুত-নিযুতভাবে। এসব আলোচনা-সমালোচনায় দেশজ শিল্পানুষঙ্গ কালেভদ্রে থাকলেও পরাশ্রয়ী শিল্পশাস্ত্রের নানা কৌশল প্রয়োগের আধিক্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা রক্তকরবীকে স্বতন্ত্র মহিমায় উত্তীর্ণ করে পাঠকের মন থেকে এরূপ ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির অপনোদন ঘটাতে রবীন্দ্রনাথেরই শরণাপন্ন হই আমরা। রক্তকরবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন: “কর্ষণজীবী এবং আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ ক’রে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলি উজাড় ক’রে দিচ্ছে। তাছাড়া, শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধা-তৃষ্ণা দ্বেষ-হিংসা, বিলাস বিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।” তাঁর এ বক্তব্যেই রক্তকরবীর দ্বন্দ্ব চিহ্নিত। রক্তকরবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন: “রাম হ’লো আরাম, শান্তি; রাবণ হ’লো চীৎকার, অশান্তি। একটিতে নবাঙ্কুরের মাধুর্য্য, পল্লবের মর্মর, আর-একটিতে শান বাঁধানো। রাস্তার উপর দিয়ে দ্বৈত রথের বীভৎস শৃঙ্গধ্বনি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও রামায়ণ রূপক নয়, আমার রক্তকরবীর পালাটিও রূপক নাট্য নয়।” নাট্যকারের এমন স্বীকারোক্তির পরও রক্তকরবীকে ‘রূপক’ বা ‘সাংকেতিক’ নাটক হিসেবে প্রমাণের জন্য আমরা কী কুস্তিই-না করে চলেছি, সে ইতিহাসও প্রায় শতবর্ষের! এ নাটকের যক্ষপুরীর রাজা আর মানবী নন্দিনী সম্পর্কিত এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বক্তব্য আর কোথায়? রক্তকরবী রচনার শতবর্ষ উদযাপন বা উত্তীর্ণের কালেও আমরা নাটকটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনায় শিল্পশাস্ত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির নৈয়ায়িক নিরিখ প্রয়োগ করি না। অর্থাৎ দেশীয় নাট্যদর্শন ও নাট্যভঙ্গি নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ যে স্পষ্ট বয়ানে আমাদের সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, এ কালের নাট্যনন্দন ভাষ্যকারদের আলোচনা-সমালোচনায় তার প্রকাশ বা প্রমাণের অভাব এখনও স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাট্য আলোচনায় আমরা ঘুরেফিরে পাশ্চাত্য শিল্পশাস্ত্রের আনুকূল্য নিই।
তথাকার চশমার রঙিন ফ্রেমেই নাটক দেখি, ব্যাকুলও হই। বিভ্রান্তও যে হই তা কোনোক্রমেই বুঝতে চাই না। কী এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য কারণে রবীন্দ্রনাটক মূল্যায়নে ইউরোপাগত বাঁধাধরা ছককেই সমালোচকগণ যেন বা রক্ষাকবচ হিসেবে বেছে নেন! কিন্তু এ আত্মরক্ষা না আত্মহনন সে-সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার অবকাশটুকুও আমাদের নেই! বাংলা নাটক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধকে যে মাত্রায় সজ্ঞান করে গেছেন আমরা দিনদিন তার ওপর থেকে আলো সরিয়ে নিচ্ছি। উপরন্তু, বর্ণিত বিষয়ে নিজেদের চারপাশকে ক্রমাগত অন্ধকারে ছেয়ে ফেলছি। আর দূরবর্তী দৃষ্টিভঙ্গির খোরপোশ বহন করে চলেছি অনবরত। নিজস্ব নাট্যবোধ সম্পর্কে বাঙালির আত্মবিশ্বাস এতটাই নড়বড়ে যে, এখনও সে আত্মরক্ষার জন্য ধার করা শিল্পবোধেরই শরণ নিতে থাকে নিত্যনৈমিত্তিক। তাই বাংলা নাটক, নাট্যতত্ত্ব, প্রয়োগশৈলী, এমনকি নাটককেন্দ্রিক সমালোচনা শাস্ত্রটিও নানারূপ ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির ঘূর্ণিপাকে দ্বিধাগ্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ যা বলেননি আমরা তাই বলি, তিনি যা করেননি আমরা তাই করি। বরং বিভ্রান্ত কর্মযজ্ঞে গতি সঞ্চারে আমরা তিলমাত্র পিছপা হই না! আমরা এতটাই তড়িৎকর্মা যে, শতবর্ষ পরেও রক্তকরবী নাটক প্রসঙ্গে বিভ্রান্তির অপচ্ছায়াকেই আলিঙ্গন করি, এ বড় বিস্ময়কর! অর্থাৎ রক্তকরবীর আলোচনায় এখনও আমরা জোরপূর্বক ইউরোপাগত শিল্পশাস্ত্রের রূপক-সাংকেতিকতার অস্ত্রই তাক করে বসে থাকি! আমরা জানি, প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির অনুশীলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অল্প ক’টি নাটক লিখলেও পরবর্তীকালে (শারদোৎসব রচনার পর থেকে অবশ্যই) তিনি তাত্ত্বিক অবয়বসহ আমাদের নাটককে সাঙ্গীকৃত করেছেন হাজার বছরের বাংলা নাট্যধারার প্রবহমান স্রোতের সঙ্গে। এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের উপলব্ধি এরূপ: ‘জাতীয় জীবনের স্মৃতির মধ্যে কীভাবে তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁর নাট্যগঠনকে, বিষয় এবং বিন্যাসের সমন্বয়ে কেমন করে তিনি পাচ্ছিলেন এক দেশীয় নাট্যধরন।’
সহস্রবর্ষের বাংলা নাটকের ইতিহাসের ধারা অস্বীকার করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এ অঞ্চলে ইউরোপীয় আঙ্গিকের নাট্যচর্চার সূচনা। ইংরেজ আগমন ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের চর্চিত নাট্যধারা আধুনিককালের নাট্যচর্চা হিসেবে চিহ্নিত। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর রাশিয়ার পর্যটক লেবেদেফ প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’-এর কার্যক্রম থেকে এই অঞ্চলে প্রোসিনিয়াম মঞ্চে ইউরোপীয় ঢঙে বাংলা আধুনিক নাট্যধারার সূচনা। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে ইংরেজি-আদলে আধুনিক সাহিত্যচর্চারও শুরু। তথাকথিত এই আধুনিককালের নাট্যধারায় বিশেষ স্থান দখল করেছিল ইউরোপীয় নাট্যআঙ্গিকের অনুসরণ ও অনুকরণ। অপরদিকে, হাজার বছর ধরে বাহিত বঙ্গভূমির বিচিত্র আঙ্গিকের ঐতিহ্যবাহী নাট্যসমূহ অপাঙ্ক্তেয় ও গ্রামীণ মানুষের শিল্পরূপে অবহেলিত হতে থাকে। উপরন্তু, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সেসব নাট্যআঙ্গিক জাতীয়তাবোধের জায়গায় স্থানলাভেও সমর্থ হয়নি। বলা বাহুল্য, সমকালীন কলকাতাকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক প্রয়াস অনেকটা সে রকমই ছিল। তাই তাঁর রাজা ও রানী এবং বিসর্জন নাটকে শেক্সপিয়রীয় নাট্যরীতির অনুশীলন দেখা যায়। কিন্তু ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামক প্রবন্ধে দেশজ নাট্যের স্বকীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট মত ব্যক্ত হয়। ‘রঙ্গমঞ্চ’ পরবর্তী নাট্যরচনায় তিনি বাঙালির নিজস্ব নাট্যআঙ্গিকের এক নবতর প্রতিফলনে প্রয়াসী ছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাট্যের অবয়ব গঠনে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যআঙ্গিকের সাঙ্গীকরণ ও নবীকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ আশ্চর্য কারণে অধিকাংশ সমালোচকই সে প্রসঙ্গ বিস্মৃত হন!
দুঃখজনক হলেও রবীন্দ্রনাট্যসমূহের ওপর ‘রূপক, সাংকেতিক, তত্ত্ব’ এরূপ নানা অভিধার সমালোচনাসূচক পোশাক চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই অত্যধিক। শুধু তাই নয়, আমাদের সমালোচনা সাহিত্য এবং গবেষণায় অনেকটা জোরপূর্বক উক্ত ধারণা প্রচার-প্রসারেই অনেককে উদ্ভ্রান্ত ও তৎপর দেখা যায়। এতে রবীন্দ্রনাটক স্বচ্ছন্দ হয় না আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন হয় তা নিয়ে ভাববার ফুরসত নেই!
কলকাতাকেন্দ্রিক সমকালীন নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত নাট্যধারার বিপরীতে যে নতুন আবহ সৃষ্টিতে মনোযোগী ছিলেন তা সাধারণ রঙ্গালয়ের ইউরোপাগত প্রয়োগকৌশলে অভ্যস্ত নাট্যকুশীলব, এমনকি দর্শকের কাছেও সমাদৃত হয়নি। তাই সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাটক উপেক্ষিত এবং স্বল্প-চর্চিতই থাকে। লক্ষণীয়, এ সময় তিনি প্রচলিত নাট্যধারার বিপরীতে দেশীয় ‘পালা’, ‘যাত্রা’, ‘ব্রতকথা’, ‘নাটগীত’, ‘পাঁচালি’ প্রভৃতির প্রেরণাসম্ভূত সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক আধুনিক নাট্যধারা সৃজনে সচেষ্ট হন। রবীন্দ্রনাথের এ প্রয়াস ও তাঁর নাট্যভাবনা সম্পর্কে শারদোৎসব, মালিনী, আমার ছেলেবেলা, রক্তকরবী, রঙ্গমঞ্চ (প্রবন্ধ) প্রভৃতি রচনার মধ্যে বিস্তৃত পরিচয় রয়েছে। রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী, রঞ্জন, কিশোর, রাজা, সর্দার, ফাগুলাল, অধ্যাপক সকলেই ঐতিহ্যচেতনারই উৎসজাত। রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো নাটককে একাধিকবার ‘পালা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসবের মধ্যে রক্তকরবী উল্লেখযোগ্য। রক্তকরবী নাটকের ‘প্রস্তাবনা’য় রবীন্দ্রনাথ এভাবে ‘পালা’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন: “আজ আপনাদের বারোয়ারী সভায় আমার ‘নন্দিনী’র পালা অভিনয় .
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: রব ন দ র আম র প ল প রসঙ গ নন দ ন কর ছ ন আম দ র ন টক র ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
আত্মার অংশ
‘দেবতার সময়ের অভাব নেই, পুজোর জন্য যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে পারেন। মানুষের দুখ মানুষের নাগাল চায় যে, তার তো সময় অল্প।’ সংলাপটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। যতবার ‘রক্তকরবী’ পড়ি, বা কোথাও কোনো আলোচনা শুনি, ঠিক তখনই মনে হয়, আমার ভেতরে অনেক অনেক দিনের জমাট অন্ধকার এখনও আমাকে বেঁধে রেখেছে, ‘এ আমির আবরণে’ এখনও আচ্ছন্ন আমি।
বাংলা ১৩৩০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রক্তকরবী নাটক লেখেন তখন তাঁর বয়েস ষাট বছরের কিছু বেশি। এ নাটকটি তিনি বহুবার সংশোধন করেছেন। খসড়া করার সময় মূল নাম কখনও নন্দিনী রেখেছেন, কখনও রেখেছেন যক্ষপুরী। অনেক সংশোধনের পর শেষতম নামটি দেন রক্তকরবী।
রক্তকরবী কেমন নাটক? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন পালা, মানবিক পালা। যেখানে আছে একটি যক্ষপুরী, সেই যক্ষপুরীর ভূগর্ভে আছে তাল তাল সোনা। ভূগর্ভের সেই সোনা তুলে আনে সাধারণ মানুষেরা। আছে এক রাজা আর আছে রাজার শাসন। রাজাই সেই যক্ষপুরীর ব্যবস্থার অধিকারী। কিন্তু সে রাজা বড়ই বিচ্ছিন্ন রাজা। যে নির্মম শাসনে সকলকে নিষ্পেষণ করছেন, সেই শাসনযন্ত্রই একসময় চলে যাচ্ছে তাঁর নাগালের বাইরে। তাঁর হাতের মরা ব্যাঙ নিয়ে তিনি অনেক আস্ফালন করেন, করেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও, কিন্তু যে প্রাণের স্পর্শ তিনি পেতে চান, তা আর কিছুতে মেলে না।
এ কারণেই তাঁর নন্দিনীকে প্রয়োজন। নন্দিনী হলো পূর্ণ প্রাণের অধিকারী। এক আদিগন্ত খোলা হাওয়া যার চিরসঙ্গী। আনন্দই যার প্রাণশক্তির উৎস। তাই রাজা চান নন্দিনীর সঙ্গে প্রাণের সংযোগ ঘটাতে। কিছুতেই তা পান না রাজা।
পূর্ণ প্রাণে যা চাইতে হয়, তাকে রিক্ত হাতে চাইলে, চাওয়াও অসম্পূর্ণ থাকে আর পাওয়া তো যায়ই না। একসময় রাজা সেকথা বোঝেন, অনুভব করেন তিনি নিজেই নিজের কাছে বন্দি। তাই নন্দিনীর কাছে নেমে আসেন তিনি, তার হাত ধরে মুক্তির স্বাদ পেতে চান তিনি। রাজা তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন, কিন্তু নন্দিনী রাজার সবটুকু বাদ দিয়ে শুধু হাত ধরতে চায় না। সমর্পন কখনও আংশিক হয় না।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় আমার জীবনের অনন্য এক ঘটনা। নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় শুধু অভিনয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল একটি যাত্রা, এক ধরনের আত্মসন্ধান। আজও আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সেই নারী ‘নন্দিনী’, যিনি ‘রক্তকরবী’র অন্ধকার রাজ্যে আলো নিয়ে এসেছিলেন। নন্দিনী কেবল একটি চরিত্র নয়, এক দর্শন, এক প্রতিবাদ, এক আলোকবর্তিকা। নন্দিনী হচ্ছে সেই নারী, যে ভালোবাসে, প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে, আর সাহসের সঙ্গে সত্যকে গ্রহণ করে। তার কণ্ঠস্বর শুধু নাটকে নয়–সমাজেও প্রতিধ্বনিত হয়।
মানুষের আবেগ, ভাবনা ও স্বপ্নপূরণের কথা তো সবচেয়ে বেশি থিয়েটারে ফুটে ওঠে। আমার জীবনেও অনেক কিছু শিখেছি এই থিয়েটারের মাধ্যমে। ২০০১ সালে আমি যখন থিয়েটারে যোগ দিলাম তখন বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সেই সময় একদিন যুবদা [খালেদ খান] ফোন করে বললেন, ‘‘আমরা দল থেকে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আনছি। তোমাকে আমরা ‘রক্তকরবী’তে একটি চরিত্রে ভাবছি।’’ তার এই কথা শোনা মাত্র আমি রাজি হই। যুবদার সঙ্গে কথা শেষ করে আম্মার কাছে গিয়ে বললাম, যুবদা রক্তকরবীতে অভিনয়ের কথা বলেছেন। মা বললেন কোন চরিত্রে। বললাম তা জানতে চাইনি। আমাকে যেতে বলেছেন। তার কিছুসময় পর আবারো ফোন করলেন যুবদা। বললেন, ‘আমরা নন্দিনী চরিত্রের জন্য তোমায় চিন্তা করেছি। তোমার কাছে রক্তকরবী বইটি আছে। থাকলে একটু পড়ে এসো।’ কথাটি শোনার পর খুশিতে আত্মহারা।
আমার অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটকে আলী যাকেরকে রাজা হিসেবে পেলাম। আমার অভিনয় জীবনে অনেক ধরনের চরিত্রে কাজ করেছি–আধুনিক, ক্লাসিক, বাস্তবধর্মী, কিংবা একেবারে প্রতীকী। কিন্তু নন্দিনী একেবারে আলাদা। এই চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমাকে মানসিকভাবে তৈরি হতে হয়েছে। কতবার ‘রক্তকরবী’ পড়েছি। নিজের মধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা খুঁজেছি।
কখনও রাত জেগে নন্দিনীর সংলাপ বলেছি, শুধু অনুভবের জন্য নয়, মুখস্থ করার জন্যও। নন্দিনী যখন বলে, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না’–এই সংলাপটি প্রথম বলেছিলাম একা একা, আমার ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে। শুধু আমি আর শব্দ। কিন্তু সে দিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম–এই চরিত্রের মধ্যে কী অসম্ভব শক্তি লুকিয়ে আছে।
রিহার্সালের সময় শুরুটা সহজ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম নন্দিনীর প্রতিটি অনুভব আমার শরীরী প্রকাশে ফুটে উঠুক। শুধু সংলাপ উচ্চারণ নয়, তার হাঁটা, তাকানো, দাঁড়ানো–সব কিছু যেন সেই প্রতিবাদী, ভালোবাসাময় আত্মা হয়ে ওঠে। সহশিল্পীরা দারুণভাবে সহযোগিতা করেছেন।
‘রক্তকরবী’ করতে গিয়ে আলী যাকের, খালেদ খান, গাজী রাকায়েত, আতাউর রহমানের কাছ থেকে কত কিছু যে শিখলাম। বিশেষ করে আতাউর রহমান এবং খালেদ খানের কাছে ঋণী হলাম। ওনারা যদি রক্তকরবী না দিত তাহলে আমি হয়তো অন্য অপি হতাম। নাটকটির মহড়ার সময় বুয়েট খুলে দিল। সেই সময় দেখা যেত আমি ক্লাসের ফাঁকে ড্রইং করছি, আর নাটকের সংলাপ বলছি। সেই সময় আমি ইউনিভার্সিটি শেষ করে মহড়ায় অংশ নিতাম। একদিন আলী যাকেরের সঙ্গে কাজ করছি। দুপুরে কিছু খাইনি। ফলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। এটি শুনে যাকের আঙ্কেল বললেন, কে আছে ওই মেয়েকে আগে খাওয়া দাও। ওর পেটের গুড়গুড়ানিতে ডায়ালগ ভুলে যাচ্ছি। মঞ্চ নাটকে যখন কাজ করি, তখন থিয়েটারের শিল্পীরা আমায় বলতেন ভাড়া করা নায়িকা। এ নাটকটির প্রথম শো থেকে শুরু করে যতদিন করেছি, ততদিন সবাই আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। অনেকে যেমন প্রশংসা করতেন, ঠিক তেমনি সমালোচনাও করতেন। যুবদার কথাই বলব। একটা শব্দের উচ্চারণ নিয়ে, তাঁর কাছে জানতে চাইলে, তখন তিনি এই শব্দের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সবই বলেছেন। এগুলো ছিল আশীর্বাদের মতো। একটি ঘটনা আজও মনে পড়ে–একদিন আমরা চূড়ান্ত দৃশ্যের মহড়া করছিলাম। রাজাকে যখন নন্দিনী যখন বলে, ‘জাগো, উঠে দাঁড়াও’–আমি সংলাপ বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম। গলা কেঁপে উঠেছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি অপি নই, আমি নন্দিনী এবং আমি কোনো মঞ্চে নয়, সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি ‘জেগে ওঠো!’ সেই মুহূর্তটি আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার সঙ্গে বোঝাপড়া করাও ছিল একটা বড় কাজ। তাঁর প্রতিটি সংলাপের গতি, ছন্দ, থেমে যাওয়ার সময়–সব নিয়ে বারবার আলোচনা করেছি। নন্দিনীর ভাষায় যে কাব্যিকতা, সেটি বজায় রেখেও অনুভূতিকে বাস্তব করে তোলা–এটি ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে বলেন, মঞ্চে অভিনয় সিনেমা বা টিভির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আমি বলবো, সেটি শুধু মঞ্চে সরাসরি অভিনয়ের জন্য নয়, মঞ্চের চরিত্রগুলোর জন্যও। তারা আপনাকে নিংড়ে নেয়। এবং নন্দিনী তো একেবারে তেমন একটি চরিত্র। সে যেন আমার আত্মাকে নিজের রূপে রাঙিয়ে দিয়েছিল।
১১৭ বার মঞ্চায়িত হয়েছে নাগরিকের ‘রক্তকরবী’। অন্যদিকে নাটকটি রচনার শতবর্ষ পূর্তি হলো এ বছর। বাংলা ভাষার চিরকালের সম্পদ ‘রক্তকরবী’।