বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এক চরম বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল অনেকের। বাস্তবে তা সফল হয়নি। বরং ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ ক্রমে এক সুবিধাবাদী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়, যেখানে বামপন্থা দুর্বল হতে থাকে।
সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন এখনও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান বৈষম্য, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রমাণ করে– একটি শক্তিশালী বামপন্থি আন্দোলন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ১৯৮০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতন এবং পুঁজিবাদের আগ্রাসনের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। সামরিক শাসন ও বহুজাতিক পুঁজিনির্ভর নীতি এ দেশে ডানপন্থার জন্য উর্বর ভূমি তৈরি করেছে। বামের বিরুদ্ধে ডানপন্থার যে দমন-পীড়ন, তা শুধু প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক দমনেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্ষমতা শুধু দমনমূলক নয়; এটি প্রলুব্ধও করে। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিকৃত করে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করা হয়, যেখানে মানুষ শোষণকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়।
ডানপন্থি শক্তিগুলো নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনৈতিক পুনর্লিখন, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির ব্যবহার, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের চর্চা।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ অত্যন্ত জরুরি। তবে একে ঐতিহ্যগত মার্ক্সবাদী কাঠামোর বাইরে এনে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পরিসরেও বামপন্থার পুনর্গঠন করতে হবে। নতুন শ্রেণিগত বিশ্লেষণ এবং শ্রমিক শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জটিল বাস্তবতা বুঝে নতুন শ্রেণিগত কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতিতে বর্তমানে অনেক দলই সক্রিয়। সক্রিয় বললে হয়তো একটু বাড়িয়ে বলা হয়, বাস্তবে এরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তাদের মধ্যে একসময় সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল উল্লেখযোগ্য শক্তি। সেই শক্তি অনেক খর্ব হয়েছে বটে, এখনও এটি দেশের প্রধান বাম দল। মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে সিপিবি যে বিপ্লবী রাজনীতির পথ অনুসরণ করেছিল, তা ছিল বাংলাদেশের বামপন্থার মূলধারার প্রতিচ্ছবি। তবে সাম্প্রতিক কালে সিপিবির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে।
সিপিবি বারবার নিজেদের নিরপেক্ষ বা তৃতীয় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করলেও কার্যত কোনো বাস্তবধর্মী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সিপিবি আদর্শগত লড়াইয়ের চেয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে বেশি আগ্রহী। এর ফলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলো নিয়ে সিপিবি বরাবরই সীমিত আন্দোলন করেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, শ্রমিক আন্দোলন এবং গ্রামীণ শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি তারা গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের রাজনীতি এক ধরনের আভিজাত্যপূর্ণ বামপন্থার দিকে ঝুঁকে গেছে, যেখানে জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতার চেয়ে মতাদর্শিক বিতর্কই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সত্যিকার পরিবর্তন আনার জন্য সংগ্রামের বদলে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে আপস করে চলেছে।
সিপিবির এই রাজনীতি এক ধরনের ‘ধোঁয়াশা’ সৃষ্টি করেছে। যে কারণে তারা নিজেদের বামপন্থি দাবি করলেও বাস্তবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। তাদের এই ধোঁয়াশামূলক অবস্থান বামপন্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্ষীণ করেছে এবং প্রকৃত বামপন্থি আন্দোলনের পথ আরও জটিল করে তুলেছে।
অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে সিপিবির যতটুকু শক্তি আছে, তাও কাজে লাগাতে পারছে না। এ সমস্যা বাংলাদেশের গোটা বামপন্থি আন্দোলনকেই গ্রাস করেছে। শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণি-গোষ্ঠীকে একটি সাধারণ (কমন) ছাতার নিচে এনে আন্দোলন করার পরিবর্তে তারা অনেক সময় শাসক শ্রেণির সঙ্গে সমন্বয়ের রাজনীতি করে। সেটি নিঃসন্দেহে বামপন্থার মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ক্ষমতা শুধু দমনমূলক নয়, বরং এটি এমনভাবে কাজ করে, যাতে মানুষ স্বেচ্ছায় শাসিত হতে চায়। বাংলাদেশে বামপন্থার পতন এবং ডানপন্থার উত্থান মূলত এ ধরনের ক্ষমতা বিন্যাসের ফলাফল। তবে ইতিহাস সাক্ষী– পরিবর্তন অনিবার্য। বাংলাদেশে বামপন্থার প্রয়োজনীয়তা এখনও অটুট এবং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বামপন্থার উত্তরণই পারে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলতে। এখন প্রয়োজন সত্যিকার বামপন্থার পুনর্জাগরণ, যেখানে জনগণের প্রকৃত সমস্যার ওপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠবে। এই পুনর্গঠনের জন্য নতুন বামপন্থি নেতৃত্বের উত্থান জরুরি, যারা ক্ষমতার জটিলতাগুলো বুঝে লড়াই করবে এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।
রিমেল সরকার: সংগীতশিল্পী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক প ড নপন থ র র ব মপন থ জনগণ র ন র জন র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি মুছে দিল দুর্বৃত্তরা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) সংলগ্ন ছাত্র আন্দোলন চত্বরে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন ‘পাটাতন’ অঙ্কিত গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি সংবলিত গ্রাফিতি রাতের কোনো এক সময় মুছে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাটি জানাজানি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার রাতেও গ্রাফিতিগুলো রঙিন ছিল। রাতের কোনো এক সময় গ্রাফিতির ওপর কালো রঙের স্প্রে দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে।
পাটাতনের সাধারণ সম্পাদক সায়েম মোহাইমিন জানান, গণহত্যার ইতিহাসকে যদি ভুলে যাওয়া হয়, তাহলে গণহত্যা বারবার হবে। তাই পাটাতন থেকে জুলাইয়ের শহীদদের স্মৃতিকে গ্রাফিতি আকারে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন তারা। বিশেষ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকেই এ আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছিল, বাংলা ব্লকেড এখান থেকেই করা হয়। এখানে এমন ঘৃণ্য কাজ করা কেবল গণহত্যার দোসরদের দ্বারাই সম্ভব। এ ধরনের কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি। সেই সঙ্গে জুলাইয়ের স্মৃতিতে ক্যাম্পাসে একটি ‘স্মৃতি মিনার’ তৈরি করতে অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হান্নান রহিম বলেন, ‘গ্রাফিতি মুছে ফেলার মাধ্যমে স্বৈরাচারের দোসররা জুলাইকে মুছতে চায়, ছাত্র আন্দোলন চত্বরকে মুছতে চায়, তারা জানে না– যা কিছু রক্ত দিয়া লেখা হয়, তা মুছা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, পাশাপাশি জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই।’
কুবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভর ভাষ্য, গণআন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তারা। এ আন্দোলনে অনেকে শহীদ হয়েছেন। তাদের স্মৃতিতে গ্রাফিতি অঙ্কনের জন্য ‘পাটাতন’ সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। ছাত্রদলও এমন কিছু করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে যারা এগুলো মুছে দিতে চাইছে, হয়তো তারা ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের দোসর। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, স্বৈরাচার এখনও বিদ্যমান।
কুবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইউসুফ ইসলাহী বলেন, ‘পাটাতন যে গ্রাফিতি অঙ্কন করেছিল, সেগুলো যারাই মুছে দিয়েছে, তারা ফ্যাসিস্টের পদলেহী বলেই আমরা মনে করি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই।’
সহকারী প্রক্টর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ জানান, প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ ও দাবি এলে হয়তো প্রশাসন আমলে নেবে। গণআন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই এর স্মৃতি সংরক্ষণে দাবি-দাওয়া আমলে নিয়ে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. আব্দুল হাকিমের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এখনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আর জুলাই স্মৃতি মিনার করার ব্যাপারে রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত আবেদন করলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব।’