প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি রয়েছে। এদের একটি বড় অংশকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আল-জাজিরা অনলাইন এ তথ্য জানিয়েছে।

ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতিষ্ঠানের মতে, এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত, ৯ হাজার ৯০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৪০০ জন শিশু এবং ২৭ জন নারী রয়েছেন। এছাড়া  ‘প্রশাসনিক আটক’ নামে পরিচিত একটি আইনের অধীনে কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৮ জন ফিলিস্তিনিকে। এদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি শিশু রয়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রায় ১৬ হাজার ৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত মাসে ইসরায়েলি কারাগারে তিনজন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার পরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কারাগারে মারা যাওয়া বন্দির সংখ্যা ৬৩ জনে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা/শাহেদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

রোহিঙ্গা সংকট– জাতিসংঘ মহাসচিবের বার্তা এবং প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গ

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নির্যাতিত হয়ে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণের আট বছরের মাথায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফর করলেন। উল্লেখ্য, তখনকার পরিসংখ্যান অনুসারে ৮ লাখ ৭১ হাজার ৯২৪ জন রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হলেও ১৯৯১-৯২ সময়ে আশ্রিত রোহিঙ্গার অবশিষ্ট এবং প্রতিবছর ৩০ হাজারেরও বেশি নতুন জন্মসহ বর্তমানে রোহিঙ্গা সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে, যাদের অনেকেই অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে। ২০২০-২২ সময়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির রোহিঙ্গা মানবিক কর্মসূচির দায়িত্ব  (হেড অব অপারেশনস) পালনকালে উখিয়া, টেকনাফ, রামু এমনকি দূরের উপজেলা কুতুবদিয়ায়ও দেখেছি, অনেক রোহিঙ্গা সেখানে স্থানীয়দের মতোই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। ফলে প্রতিনিয়ত স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটে। কারণ রোহিঙ্গারা কম মজুরিতে কাজ করায় স্থানীয়দের রোজগারে ঘাটতি হয়। আরও সমস্যা রয়েছে। যেমন– রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া, স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ, ক্যাম্পে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে রোহিঙ্গাদের প্রাধান্য দেওয়া, স্থানীয় ব্যবসায় রোহিঙ্গাদের জড়ানো, রোহিঙ্গা-স্থানীয় বিয়ে ও তৎসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি। 

রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে নিয়মিত সুবিধা (খাদ্য, চিকিৎসা, অন্যান্য) পেলেও জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ১৫০ বর্গফুটের ছোট্ট একটি ঘর আর কাঁটাতারের সীমানায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত শিশুকিশোরদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরতে ব্যাকুল। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগে অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতায় শুনেছি তাদের এমন ব্যাকুলতার কথা। জাতিসংঘ মহাসচিবও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাঁর সংলাপের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরতে চায়।’ কিন্তু একই সঙ্গে তিনি প্রকারান্তরে তাঁর সীমাবদ্ধতার কথাই ব্যক্ত করলেন, ‘তবে এ প্রত্যাবাসন তখনই সম্ভব হবে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পারবে এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।’ 

রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন এবং তাদের উপস্থিতির ফলে দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে পরিত্রাণ পেতে এ বছরের ৩ জানুয়ারি কক্সবাজারে স্থানীয় অধিবাসীদের এক প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনে সাত দফা দাবি উত্থাপন করা হয়– ১. রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন, ২. নতুন করে অনুপ্রবেশ বন্ধে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা, ৩. ২০২৪ সালে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে এফডিএমএন হিসেবে তালিকাভুক্ত না করে তাদের পুশব্যাকের জন্য কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো, ৪. স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৫. চাকরিসহ ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়দের প্রাধান্য (ন্যূনতম ৫০ শতাংশ) নিশ্চিত করা, ৬. কাঁটাতারের বাইরে রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ ও ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া বন্ধে কঠোর নজরদারি এবং ৭. ক্যাম্পের চাকরির জন্য নিয়োগ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হলে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারের সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুসারে ওই বছরের ডিসেম্বর থেকেই প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ আট বছরে একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হয়নি। বরং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক শাসন এবং পরে জাতিগত দাঙ্গাজনিত কারণে নতুন করে অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই ৩৫ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) হয়েছে। এদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পাইলট প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। কারণ রোহিঙ্গারা এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে শর্ত দেয়– ‘প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ’– যা নিশ্চিত করা দুরূহ। জাতিসংঘ মহাসচিবও প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে এটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘মিয়ানমারে ফেরার পর তাদের যেন কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে না হয়, তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার। তাদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত না হলে প্রত্যাবাসন টেকসই হবে না।’ তিনি জানান, তরুণ রোহিঙ্গারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা জানিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেছে। 

সমকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, বিশেষত গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও খাদ্য সংকটের আবর্তে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক নজর হারানোর পর্যায়ে ছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর এবং তার আগে ইউএনইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডির সফর রোহিঙ্গা সংকট ও তাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মহলের নজর ফেরাতে সক্ষম হবে এমনটা আশা করা যায়। জাতিসংঘ মহাসচিবও আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করাসহ তাদের প্রত্যাবাসন বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরবেন। 

বাংলাদেশকেই এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক সফরের ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মহলে পুনর্জাগরণ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এর আগে তিনি ইস্যুটি গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও উত্থাপন এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল (সেফ জোন) প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তাব করেছেন, যা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে। এ বছরের শেষাংশে কাঙ্ক্ষিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া মিয়ানমারের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি আলোচনা করতে হবে। অনুমিত যে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরের কর্মসূচিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মিয়ানমারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ফোরাম আসিয়ানেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি উত্থাপন করতে হবে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ইস্যুটি আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তিমুর লিসতের নেতৃত্বের কাছে তুলে ধরেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ইমেজ ব্যবহার এবং একটি পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি একটি সুবিধাজনক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে তার বাস্তবায়ন সহজতর হবে। তবে ততদিন পর্যন্ত মানবিক অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদ্যমান সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যে আশ্বাস সদ্য সফরকারী জাতিসংঘ মহাসচিবও ব্যক্ত করেছেন। 

এম. এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ