ভারতে কি উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন তৈরি হচ্ছে
Published: 10th, April 2025 GMT
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতীয় রাজনীতি একটি ইস্যুতে বিতর্কে উত্তাল হয়েছে। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক চলছে, সে ঘটনাটি এখন পর্যন্ত ঘটেনি। সেটি হলো সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি নতুন জনশুমারির পর এটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলো মনে করছে, এই পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য অন্যায্যভাবে উত্তরাঞ্চলের দিকে ঝুঁকে যাবে।
লোকসভায় (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) সাধারণত আসনসংখ্যা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। জনসংখ্যা বেশি হলে আসনসংখ্যাও বেশি হয়। যেহেতু লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নিয়ন্ত্রণ থাকলে সরকার গঠন করা সম্ভব, তাই বৃহত্তর জনসংখ্যা একটি বড় রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেয়। তবে মাত্রাহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে ১৯৭৬ সালে ভারত আসন পুনর্বিন্যাস (সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া) স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে রাজ্যগুলো ধীরগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির নীতি অনুসরণ করলেও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা না থাকে।
প্রথমে এই স্থগিতাদেশ ২০০১ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা ছিল। কিন্তু একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে এর মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়। ফলে বর্তমানে যে সীমারেখা অনুযায়ী আসন ভাগাভাগি হচ্ছে, তা ১৯৭১ সালের জনশুমারির ভিত্তিতে নির্ধারিত।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর নেতারা এর বিরোধিতা করছেন। তাঁদের মতে, শুধু জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করা হলে, সেটি কার্যত উত্তর ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে পুরস্কৃত করবে এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোকে শাস্তি দেবে। কারণ, দক্ষিণের রাজ্যগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে। ইতিমধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলো দেখছে, একই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের কর রাজস্ব থেকে তাদের অংশ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।এই সময়কালের মধ্যে ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলো তাদের জন্মহার প্রতিস্থাপন-হার (রিপ্লেসমেন্ট লেভেল) পর্যন্ত নামিয়ে এনেছে বা তার নিচে নিয়ে গেছে এবং মানব উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এই উন্নতির মধ্যে রয়েছে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস এবং লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলো এই সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া জাতপাতপ্রথা, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকেও উত্তর ভারতের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ। তবে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে।
আসন পুনর্বিন্যাস স্থগিত রাখার নিয়ম ছিল ২০২৬ সালের পর প্রথম জনশুমারি পর্যন্ত। তবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এই স্থগিতাদেশ আর বাড়ানোর পক্ষপাতী নয়। এর পরিবর্তে তারা জনশুমারি পরিচালনা করতে চায় (যে শুমারিটি ২০২১ সালে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বারবার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে) এবং এরপর ভারতের নির্বাচনী মানচিত্র নতুন করে নির্ধারণ করতে চায়।
বিজেপির মতে, এটি ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত। তাদের যুক্তি হলো, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট, এক মূল্য’ হওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রত্যেক সংসদ সদস্যের প্রায় একই সংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা উচিত। তাদের দাবি, কেরালার একজন সংসদ সদস্য যেখানে মাত্র ১৮ লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে উত্তর প্রদেশের একজন সংসদ সদস্যকে ২৭ লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়—এটি অগণতান্ত্রিক।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর নেতারা এর বিরোধিতা করছেন। তাঁদের মতে, শুধু জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করা হলে, সেটি কার্যত উত্তর ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে পুরস্কৃত করবে এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোকে শাস্তি দেবে। কারণ, দক্ষিণের রাজ্যগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে। ইতিমধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলো দেখছে, একই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের কর রাজস্ব থেকে তাদের অংশ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
একটি একজাতীয় সমাজে আসন বণ্টনের ভিত্তি হিসেবে জনসংখ্যা প্রধান মাপকাঠি হতে পারে, কিন্তু বহু বিচিত্র সমাজে এই নিয়ম অনুসরণ সঠিক হবে না। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য (সেখানকার জনসংখ্যা যা–ই হোক না কেন) সিনেটে দুটি আসন পায়। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট দেশগুলোকে তাদের জনসংখ্যার তুলনায় বেশি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য দেয়, যাকে বলা হয় ‘ডিগ্রেসিভ প্রপোরশনালিটি’ বা অসমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। ভারতে গোয়া, উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্য এবং আন্দামান, দিউ ও লাক্ষাদ্বীপের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো জনসংখ্যার তুলনায় বেশি পার্লামেন্ট সদস্য পায়।
ভারতে নানা ভাষা, ধর্ম, জনতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য এবং উন্নয়নের স্তর রয়েছে। পাশাপাশি ভারতের ‘আধা মৌলিক’ ফেডারেল ব্যবস্থায় রাজ্যগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা ভোগ করে। তাই সমান প্রতিনিধিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও সংরক্ষণ করতে হবে। এর মানে হলো, কোনো একটি গোষ্ঠী (যেমন উত্তর ভারতের হিন্দিভাষীরা) যেন অন্যদের প্রয়োজন, অগ্রাধিকার, অভিজ্ঞতা ও আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে আশ্বাস দিয়েছেন, নতুন আসন পুনর্বিন্যাসে তারা একটি আসনও হারাবে না। এর মানে হলো, জনসংখ্যা বেশি এবং বিজেপির সমর্থন বেশি—এমন উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর জন্য আরও বেশি আসন তৈরি করা হবে। কেউ কেউ মনে করছেন, নতুন আসনবিন্যাসে লোকসভার আসনসংখ্যা ৫৪৩ থেকে বেড়ে ৭৫৩টিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার অনেকে বলছেন, নতুন পার্লামেন্ট ভবনে ৮৮৮ জন এমপির বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দেয়।
যদি নতুন আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়, তাহলে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে কমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিনের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো একটি যৌথ কার্যক্রম কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আগামী ২৫ বছর বর্তমান পদ্ধতিটি বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছে। যদি দক্ষিণের মানুষ মনে করেন, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাহলে তাঁরা আরও বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজ্যগুলোর জন্য বেশি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে পারেন। আর যদি এসব দাবি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে দক্ষিণের কিছু চরমপন্থী ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো কঠোর দাবিও তুলে বসতে পারেন।
এটি সবার জন্য ক্ষতিকর হবে। কারণ, ভারত একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবেই সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে। উত্তর ও দক্ষিণ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে তুলনামূলক তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে। এই নাগরিকেরা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ ভারতের শিল্প ও সামাজিকভাবে উন্নত রাজ্যগুলোতে কাজ করতে পারেন। এটি সবার জন্যই উপকারী হবে।
এই বিতর্ক ভারতীয় ঐক্য আরও দৃঢ় করার একটি ভালো সুযোগ এনে দিয়েছে।
● শশী থারুর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সংসদ সদস্য এবং টানা চতুর্থবার তিরুবনন্তপুরম লোকসভা আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনস খ য র র জনস খ য র জন ত ক জনশ ম র ল র জন র জন য ক ষমত আরও ব ল কসভ
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষ ভাবতেন আমি কেবল চুমু খেতে পারি, অভিনয় নয়: ইমরান হাশমি
অনুরাগ বসু নির্মিত বহুল আলোচিত বলিউড সিনেমা ‘মার্ডার’। মহেশ ভাট প্রযোজিত এ সিনেমা ২০০৪ সালে মুক্তি পায়। এতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন মল্লিকা শেরাওয়াত ও ইমরান হাশমি। সিনেমাটিতে তাদের রোমান্স, ঘনিষ্ঠ দৃশ্য নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। মূলত, এরপরই বলিউডে ‘সিরিয়াল কিসার’ হিসেবে পরিচিতি পান ইমরান হাশমি।
ইমরান হাশমির সঙ্গে ‘সিরিয়াল কিসার’ তকমা এমনভাবে লেগে গিয়েছিল যে মানুষ ভাবতেন, ইমরান হাশমি কেবল চুমুই খেতে পারেন, অভিনয় নয়। রণবীর এলাহাবাদিয়ার পডকাস্টে উপস্থিত হয়ে এমন মন্তব্য করেন ইমরান হাশমি।
ক্যারিয়ারের শীর্ষ অবস্থানে থাকার সময়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ইমরান হাশমি বলেন, “২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়েছি। যেমন— ‘জান্নাত টু’, ‘রাজ টু’, ‘রাজ থ্রি’, ‘দ্য ডার্টি পিকচার’, ‘মার্ডার টু’। এরপর আমি চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রশংসা পাই।”
আরো পড়ুন:
শ্রীলীলার প্রেমে মজেছেন কার্তিক
সালমানের যত ফ্লপ-ব্লকবাস্টার সিনেমা
সমালোচকদের প্রশংসাসূচক উক্তি উল্লেখ করে ইমরান হাশমি বলেন, “মানুষ ভেবেছিলেন, ইমরান হাশমি পর্দায় শুধু চুমু খেতে পারেন। কিন্তু আসলে সে অভিনয়ও করতে পারেন।’ ‘সাংহাই’ সিনেমা মুক্তির পর আমি সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছি। আমি আমার সেরাটা পেয়েছি। সেই সময়ে আমার ক্যারিয়ার সাফল্যের শীর্ষে ছিল। অভিজ্ঞতা সবসময়ই ভালো; ক্যারিয়ারজুড়ে আমার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে।”
ইমরান হাশমি অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘টাইগার থ্রি’। ‘টাইগার’ ফ্র্যাঞ্চাইজির এ সিনেমা ২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায়। এতে আইএসআই-এর প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেলের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান তিনি।
বর্তমানে ইমরান হাশমির হাতে তেলেগু ভাষার ‘ওজি’ সিনেমার কাজ রয়েছে। সুজিত পরিচালিত এ সিনেমায় আরো অভিনয় করছেন— পবন কল্যাণ, প্রকাশ রাজ, অর্জুন দাস প্রমুখ। ২৫০ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে অ্যাকশনার ঘরানার এই সিনেমা। তা ছাড়াও তেলেগু ভাষার ‘জি-টু’, ‘গ্রাউন্ড জিরো’, ‘আওয়ারাপান টু’ সিনেমার কাজও ইমরান হাশমির হাতে রয়েছে।
ঢাকা/শান্ত