বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এক মানচিত্র তৈরি করেছেন। এটির মস্তিষ্কের যে অংশের মানচিত্র তাঁরা তৈরি করেছেন, সেখানে বার্তা পাঠানোর সময় ৮৪ হাজার নিউরনকে (স্নায়ুকোষ) সংযুক্ত করে এমন তারের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এ চিত্র দেখতে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মতোই।

এ মানচিত্র তৈরিতে গবেষকেরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের ছোট এক খণ্ডাংশ ব্যবহার করেছেন, যেটি আকারে একটি পপিবীজের সমান। গবেষণায় তাঁরা হাজার হাজার এসব নিউরন শনাক্ত ও এগুলো শাখা–প্রশাখার মতো ছড়িয়ে থাকা ফাইবারের মতো কীভাবে যুক্ত থেকে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে, তা নিরূপণ করেছেন। যোগাযোগের এ প্রক্রিয়ায় সিন্যাপস নামে পরিচিত বিস্ময়কর ৫০ কোটি সংযোগস্থলের অস্তিত্ব লক্ষ করেছেন গবেষকেরা।

এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত গতকাল বুধবার বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, সে রহস্য উদ্‌ঘাটনে এ গবেষণাকে একধাপ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মানব মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালি নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের আরও গবেষণার পথ উন্মোচন করবে এটি।

এ–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত গতকাল বুধবার বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, সে রহস্য উদ্‌ঘাটনে এ গবেষণাকে একধাপ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মানব মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালি নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের আরও গবেষণার পথ উন্মোচন করবে এটি।

আরও পড়ুন ইঁদুরের মস্তিষ্কের নতুন সংকর কোষের খোঁজ, নড়ে বসেছে নিউরো–দুনিয়া১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ইঁদুরের মস্তিষ্কের মানচিত্র তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া গবেষক দলের প্রধান সিয়াটলের ‘অ্যালেন ইনস্টিটিউট ফর ব্রেইন সায়েন্স’–এর ফরেস্ট কোলম্যান বলেছেন, ‘এটি অবশ্যই একটি বিস্ময়ের অনুভূতি তৈরি করে, যেন আমরা ছায়াপথের ছবি দেখছি।’

এটি (ইঁদুরের মস্তিষ্কের মানচিত্র) অবশ্যই একটি বিস্ময়ের অনুভূতি তৈরি করে, যেন আমরা ছায়াপথের ছবি দেখছি।ফরেস্ট কোলম্যান, গবেষক দলের প্রধান

এই গবেষক আরও বলেন, ‘এটি দেখে আপনি (আপনার মস্তিষ্ক) কতটা জটিল, তা বুঝতে পারবেন। আমরা একটি ক্ষুদ্র অংশ দেখছি.

..একটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের। (এ মানচিত্রে) নিউরনসমূহ ও এসবের মধ্যকার লাখ লাখ সংযোগের সৌন্দর্য এবং জটিল নকশা আপনি দেখতে পাবেন।’

আমরা যেভাবে চিন্তা করি, কিছু অনুভব করি, দেখি, কথা বলি ও নড়াচড়া করি, তা মস্তিষ্কের নিউরন বা স্নায়ুকোষের কারণেই ঘটে। নিউরনগুলো সক্রিয় থেকে একে অপরের কাছে বার্তা পাঠায়।

আমরা যেভাবে চিন্তা করি, কিছু অনুভব করি, দেখি, কথা বলি ও নড়াচড়া করি, তা মস্তিষ্কের নিউরন বা স্নায়ুকোষের কারণেই ঘটে। নিউরনগুলো সক্রিয় থেকে একে অপরের কাছে বার্তা পাঠায়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে জানেন যে সংকেতগুলো একটি নিউরন থেকে অন্যটিতে অ্যাক্সনস ও ডেনড্রাইটস নামক তন্তু হয়ে এগিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে এসব সংকেত সিন্যাপসেস ব্যবহার করে পরবর্তী নিউরনে লাফিয়ে চলে। কিন্তু নিউরনের নেটওয়ার্ক এবং এ তারের জালের ব্যাঘাত কীভাবে আলঝেইমার, অটিজম বা অন্যান্য রোগে ভূমিকা রাখতে পারে, সেসব সম্পর্কে খুব কম জানা যায়।

আরও পড়ুনইঁদুরের ভ্রূণে মানব ডিএনএর পরীক্ষা২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অ্যালেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ক্লে রিড বলেন, ‘মস্তিষ্কের কোষগুলো কীভাবে নিজেদের কাজ করে, সে সম্পর্কে আপনি হাজারো অনুমান করতে পারেন। কিন্তু আপনি সেই অনুমানগুলো পরীক্ষা করতে পারবেন না, যদি না আপনি সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক বিষয়টি জানেন। সেটি হলো, কীভাবে কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।’

মস্তিষ্কের কোষগুলো কীভাবে নিজেদের কাজ করে সে সম্পর্কে আপনি হাজারো অনুমান করতে পারেন। কিন্তু আপনি সেই অনুমানগুলো পরীক্ষা করতে পারবেন না, যদি না আপনি সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক বিষয়টি জানেন। সেটি হলো, কীভাবে কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।ক্লে রিড, অ্যালেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা ইঁদুরের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ডিজিটাল থ্রিডি কপি তৈরি করেছেন, যা অন্য বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণায় কাজে লাগাতে পারবেন।

আরও পড়ুনইঁদুরের স্মৃতি পুনরুদ্ধার২৯ মে ২০১৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর কর ছ ন অন ম ন প রব ন অপর র

এছাড়াও পড়ুন:

সাহিত্যে রন্ধনশিল্পের প্রভাব

মুসলিম সভ্যতায় খাওয়ার সংস্কৃতি কথা তখনকার সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। সাহিত্যিকদের অনেকে রান্নার স্বাদ, রস ও প্রকার বিভিন্ন উপমায় বর্ণনা করেছেন। অনেকে ভোজনশালার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন চটুল ও রহস্যময় বর্ণনায়। কেউ কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনাও করেছেন। তাঁদের বইয়ে রান্নার সঠিক নিয়ম কী হওয়া উচিত এবং সুস্বাদু খাবারের পূর্বশর্ত কী, তা অনুসন্ধান করেছেন। আবু বাকার আল-রাযির (৩১১ হিজরি, ৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) মুনাফি আল-গিজা ওয়াদাফিউল আযমারাহ এ বিষয়ে একটি অনন্য গ্রন্থ।

বাগদাদি লেখক ‘মিসাল বাগদাদ’ বাগদাদের রন্ধনশিল্পের বিশালতা কাব্যিক ঢঙে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে কালো সিসা রুটির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া ছিল, সেটি দেখলে মনে হতো যেন পূর্ণ চাঁদ, এবং তার স্বাদ এত মিষ্টি ছিল যেন এক গ্রাসে খেয়ে ফেলা যেত।’

ইবন তাইফুর মারভেজি (২৮০ হিজরি, ৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর কিতাব বাগদাদ গ্রন্থে মাওমুন নামে এক বাগদাদি বিশেষজ্ঞের বাড়িতে খাবারের সময়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে কী কী দেখেছেন, তার সরস বর্ণনা দিয়েছেন। সে সময় মাওমুনের অতিথিশালায় প্রায় তিন শ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এবং মাওমুন প্রতিটি খাবারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বোঝান।

আরও পড়ুনমন্দ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের উপায়০৬ এপ্রিল ২০২৫

বাদশাদের মতো অনেক মন্ত্রীদেরও খাবারের প্রতি আগ্রহ ছিল গভীর। জাহাজি (২১৬ হিজরি, ৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ) একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, পারস্যের গভর্নর আমর ইবন লাইস তার ব্যক্তিগত রন্ধনশালায় সাড়ে ছয় শ উট ব্যবহার করতেন। এগুলো ছিল মন্ত্রীর প্রাসাদে খাবার প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের বিশাল নির্দেশ।

এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে খাবার প্রতিযোগিতার কথাও শোনা যায়। এই ধরনের প্রতিযোগিতা কেবল যে খাবার প্রস্তুতির জন্য ছিল তা নয়, এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা ছিল, যেখানে রান্নার শৈলী ও খাবারের বৈচিত্র্য চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হতো।

কঠোর নজরদারি ও মান নিয়ন্ত্রণ

ইসলামি সভ্যতায় রেস্তোরাঁয় ও খাদ্য উৎপাদনে কঠোর নজরদারি চালানো হতো। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, তৈরির পাত্রের পরিচ্ছন্নতা, রাঁধুনির ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, উপকরণের বিশুদ্ধতা—এসব ছিল বাধ্যতামূলক।

আলাদা চুলা: আলাদা খাবারের জন্য আলাদা চুলা বরাদ্দ থাকত। যেমন যেখানে মাছ ভাজা হয়, সেখানে রুটি বানানো নিষেধ ছিল। তেল বারবার ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ ছিল।

অপ্রাপ্তবয়স্ক সরবরাহকারী: একটি মজার তথ্য হলো—যেসব রুটি বিক্রেতা ‘সরবরাহকারী’ রাখত, তাদের বলা হতো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদেরই নিয়োগ দিতে, যাতে তারা গৃহস্থালির নারীদের সামনে যাওয়া হলেও কোনো সামাজিক অস্বস্তি না হয়।

আরও পড়ুনসুরা সাফে মন্দ আচরণ নিয়ে আল্লাহর বক্তব্য৩১ জুলাই ২০২৩

ওজনে কারচুপি: তখন বেশির ভাগ খাবার বিক্রি হতো ওজনে। তাই ওজনে কারচুপি ঠেকাতে ‘মুহতাসিব’ বা বাজার তদারকি কর্মকর্তারা নজরদারি করতেন। যেমন, মাংস রান্নার আগে-পরে ওজন করে দেখা হতো, যেন অতিরিক্ত শুকিয়ে না যায় বা ভেতরে লোহা জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে ওজন না বাড়ানো হয়।

ভেজাল-নিরোধ: বিভিন্ন ভেজালের কৌশলও ধরা পড়েছে। কেউ কেউ কিমার ভেতরে ভুঁড়ি, পেঁয়াজ ও বুটলতাও ঢুকিয়ে দিত। কেউবা সমুচার ভেতরে মাছ ও মসলা দিয়ে মাংসের বিকল্প বানাত। এগুলো ধরা হতো ভাজনের আগেই কেটে দেখে।

রসায়ন ব্যবহার: এক ধরনের খাদ্যভিত্তিক ‘রাসায়নিক ভেজাল’ও ছিল। রঙিন মাংস বানানো হতো আসল মাংস ছাড়াই। কলিজা, ডিম, এমনকি মধু বা চিনি ছাড়া মিষ্টিও তৈরি হতো। একজন প্রাচীন চিকিৎসক—ইবন আল-কিন্দি—এমন প্রযুক্তির উল্লেখ করেন তাঁর কেমিস্ট্রি অব কুকিং বইতে। তবে এসব গোপন রাখা হতো, যাতে কেউ শিখে অনৈতিকভাবে না ব্যবহার করে।

ফাতেমি যুগে নারী রাঁধুনিরাও (দাসী) ছিলেন বিশিষ্ট। কেউ কেউ ৮০ রকম ভাজাভুজি বানাতে পারতেন। এমন দক্ষতা দেখে এক তুর্কি রাজা তাঁর রাঁধুনিদের কায়রোতে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনশয়তানের মন্দ প্ররোচনা থেকে বাঁচার দোয়া২৭ এপ্রিল ২০২৩

আধুনিক রান্নার আগমনী

বিখ্যাত ‘বিফ বোর্গুইনিয়ন’ ফরাসি রান্না, যা ধীরে ধীরে রান্না করা হয়, সেটি ৭০০ বছর আগেই আরব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ‘স্কবাজ’ নামে। এতে মাংস, মসলা, খেজুরের রস ও জাফরান দিয়ে ট্যানুরে সারা রাত রান্না হতো।

রমজান উপলক্ষে নানা খাবার, যেমন: কাতায়েফ, হরিরা, কুসকুস, সামোসা, লুকাইমাত (লালমোহন জাতীয় মিষ্টি) ও সোবিয়া (একধরনের মিষ্টি পানীয়)—এই সব খাবার বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত।

আন্দালুসীয়রা খাবার একসঙ্গে পরিবেশন করতেন না। একে একে পরিবেশন করতেন—প্রথমে ডাল, তারপর মিষ্টি, মাঝে মাঝে আচার, সবশেষে পুনরায় মিষ্টি। এ রেওয়াজ এখনো মরক্কোসহ কিছু অঞ্চলে প্রচলিত।

ইরাকের সংগীতজ্ঞ জেরিয়াব শুধু সুর নয়, খাবারের রুচিতেও বিপ্লব এনেছিলেন আন্দালুসিয়ায়। তিনি খাবারের পরিবেশনা, থালার সাজসজ্জা, গ্লাসের ব্যবহার (সোনা-রুপার বদলে কাচের), ও চামচ-কাঁটা ছুরি ব্যবহারে সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেন। তাঁর কৌশল পরবর্তীতে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।

খাদ্য শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, বরং তা সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও নৈতিকতারও বহিঃপ্রকাশ। ইসলামি সভ্যতার রন্ধনশৈলী আমাদের শিখিয়ে দেয়—ভালো খাবার মানে বিশুদ্ধতা, রুচিশীলতা এবং সামাজিক সচেতনতার এক অনন্য মিশেল।

আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনঅহংকারের পরিণতি মন্দ২৬ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ