ফরিদপুরে গত দুই বছরে ঈদের আগে-পরে বড় তিনটি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে দুটি কমিটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে একটি বাস দ্রুতগতিতে ওভারটেক করতে গিয়ে সড়কের পাশে থাকা খুঁটিতে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়ে গেলে সাতজন নিহত হন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিন্টু বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

২০২৩ সালের ২৪ জুন ঈদুল আজহার আগে ভাঙ্গার মালিগ্রাম এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর বিভাজকে ধাক্কা লেগে আগুন ধরে গেলে চালকসহ অন্তত আটজন নিহত হন। এ ঘটনায় তৎকালীন এডিএম বিপুল চন্দ্র দাসকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি ২৬ জুন ছয় দফা সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দেয়।

সুপারিশের মধ্যে ছিল এক্সপ্রেসওয়েতে কন্ট্রোল ক্যামেরা বসানো; ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে তদারকি; এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি পয়েন্টে হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি; লাইসেন্সবিহীন চালকদের গাড়ি না চালানো নিশ্চিত করা; যন্ত্রের মাধ্যমে গাড়ির গতি পরিমাপ; গতিসীমার ঊর্ধ্বে চলাচলকারী চালকদের শাস্তির আওতায় আনা এবং বিআরটিএর মাধ্যমে সারা দেশে সব যানবাহনে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গত মঙ্গলবার ফরিদপুরে যে বাস দুর্ঘটনায় সাতজনের প্রাণহানি হয়েছে, সেটির ফিটনেস ছিল না। চালক পালিয়ে যাওয়ায় তাঁর লাইসেন্স ছিল কি না, শনাক্ত করা যায়নি।

আরও পড়ুনহাসপাতালে অসুস্থ স্বজনকে দেখতে যাচ্ছিলেন, বাস পুকুরে পড়ে বাবা–ছেলে নিহত০৮ এপ্রিল ২০২৫

এক্সপ্রেসওয়েতে ক্যামেরা বসানো ও বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার শাহীনূর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে কন্ট্রোল ক্যামেরা বসানোর কোনো সুযোগ হাইওয়ে পুলিশের নেই। আমাদের জনবল–সংকট প্রকট। অবস্থা অনেকটা “ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার”–এর মতো। সাধারণ একটি থানায় যেখানে ৭০ থেকে ৮০ জনের জনবল থাকে, সেখানে আমাদের থানায় দেওয়া হয় ২০ থেকে ২৫ জন। পাশাপাশি যানবাহনের সংকট রয়েছে। এই জনবল দিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোর সুযোগ নেই।’

দুর্ঘটনার পরপরই চালকের নিবন্ধন ও গাড়ির ফিটনেস দেখতে দু-এক দিন মাঠে তদারক করে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ। পরে তেমন কোনো তদারকি দেখা যায়নি। যানবাহনে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো.

নাসির উদ্দীন জানান, সব যানবাহনে গতি কমানোর যন্ত্র স্থাপনের কোনো উদ্যোগ বিআরটিএর নেই।

আরও পড়ুনফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫১৭ এপ্রিল ২০২৪২০২৪ সালের ১৬ এপ্রিল ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ ১৪ জন নিহত হন। ওই দুর্ঘটনায় করা কমিটি প্রতিবেদনে চালকের ঘুম ঘুম ভাব, যানবাহনের অধিক গতি, নিজস্ব লেন ছেড়ে অন্য লেনে চলাচল ও মহাসড়কে অবৈধ অটোরিকশা চলাচলের কারণ উল্লেখ করে। কিন্তু কোনো কারণ সামনে রেখে প্রশাসনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

একইভাবে ২০২৪ সালের ১৬ এপ্রিল ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ ১৪ জন নিহত হন। ওই দুর্ঘটনায় করা কমিটি প্রতিবেদনে চালকের ঘুম ঘুম ভাব, যানবাহনের অধিক গতি, নিজস্ব লেন ছেড়ে অন্য লেনে চলাচল ও মহাসড়কে অবৈধ অটোরিকশা চলাচলের কারণ উল্লেখ করে। কিন্তু কোনো কারণ সামনে রেখে প্রশাসনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অধিক গতি ও মহাসড়কের নিজস্ব লেন অতিক্রম করায় মঙ্গলবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাসটি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও মহাসড়কে হরহামেশা চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।

আরও পড়ুনঅতিরিক্ত গতি ও চালকের ঘুম ঘুম ভাবে ফরিদপুরের দুর্ঘটনা২২ এপ্রিল ২০২৪সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়া কঠিন। এবারের কমিটি যেসব সুপারিশ দেবে এবং আগে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল—সেগুলো নিয়ে সমন্বয় করে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাসের মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে একটি সভা করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হবে।মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লা, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক

জানতে চাইলে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশ সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটি তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য, আরেকটি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়া কঠিন। তিনি বলেন, এবারের কমিটি যেসব সুপারিশ দেবে এবং আগে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল—সেগুলো নিয়ে সমন্বয় করে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাসের মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে একটি সভা করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য সব স প র শ দ র ঘটন য় ত মন ক ন সরক র ব আরট

এছাড়াও পড়ুন:

বিনা খরচে আরও কর্মী নেবে জাপান, সমঝোতা স্মারক সই

বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানে আয়ের সুযোগ বেশি। জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিনা খরচে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ আছে। জাপানে ২০১৭ সাল থেকে কারিগরি শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মী যাচ্ছেন। নতুন করে বিনা খরচে আরও কর্মী পাঠাতে দেশটির বেসরকারি একটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার।

আজ বৃহস্পতিবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশি কর্মীরা বিনা মূল্যে জাপানি ভাষা ও কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। প্রশিক্ষিত কর্মীরা বিনা অভিবাসন ব্যয়ে জাপানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। জাপানে বেশি হারে কর্মী পাঠানোর সুযোগ তৈরি হবে।

কেয়ারগিভার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্যাকেজিং, প্লাস্টিক মোল্ডিং, রড বাইন্ডিং, স্ক্যাফোল্ডিং, কার পেইন্টিং, ওয়েল্ডিং ও অটোমোবাইল মেকানিক খাতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন কর্মীরা। চুক্তি শেষে জাপান থেকে ফিরে আসা কর্মীরা দেশীয় শিল্প খাতে তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গত সাত বছরে ৬৯৫ জন টেকনিক্যাল ইন্টার্ন জাপানে গেছেন। নতুন এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে আরও বেশি কর্মীর জাপানে যাওয়ার সুযোগ হবে। নতুন এ সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।

সমঝোতা স্মারকে সই করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া ও জাপানের বেসরকারি কোম্পানি ওনোডেরা ইউজার রান ইনকরপোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট তাকাশি সুগেনো।

বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানে এই সমঝোতা স্মারককে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক আখ্যায়িত করে নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া বলেন, উন্নত দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে।

এর আগে ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ম্যানপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (আইএম) জাপানের সঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় সরকারিভাবে বর্তমানে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে দেশটিতে। দেশের বিভিন্ন জেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে জাপানি ভাষার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।

আরও পড়ুন৮ মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে জাপানে চাকরির সুযোগ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চার মাস মেয়াদি জাপানি ভাষা শেখার এসব প্রশিক্ষণের পর পরীক্ষায় বসেন কর্মীরা। উত্তীর্ণ হলে আইএম জাপানের ব্যবস্থাপনায় আরও চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষানবিশ হিসেবে তাঁদের জাপানে নিয়ে যাওয়া হয়। জাপানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পান কর্মীরা।

জাপানের গড় আয়ু ৮৪ বছর। এসব বয়স্ক মানুষের সেবার জন্য দক্ষ জনবল দরকার। নির্মাণশিল্প, প্রযুক্তি, নার্সিং, কৃষি ও হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম খাতে কাজের সুযোগ আছে সেখানে। তবে বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার ব্যাপারে জাপান বরাবরই রক্ষণশীল। জাপানি ভাষা শিক্ষা ছাড়া দেশটিতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আরও পড়ুনবিনা খরচায় জাপান যেতে যা লাগবে০৬ জানুয়ারি ২০২০

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিনা খরচে আরও কর্মী নেবে জাপান, সমঝোতা স্মারক সই