স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান। এই আইনসভার সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অর্থাৎ ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) নির্বাচনী পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। সাংবিধানিক কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই আইনসভা আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি আদায়ে কখনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, যা দেশে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েমে ভূমিকা রেখেছে।

এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবনা অনুসারে, নিম্নকক্ষের নাম হবে জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষের নাম সিনেট। এই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব বা বিল উত্থাপন করবে নিম্নকক্ষ। উচ্চকক্ষের এই ক্ষমতা থাকবে না। কমিশন উচ্চকক্ষকে মূলত একটি পর্যালোচনাকারী সংস্থা হিসেবে প্রস্তাব করেছে, যার কাজ হবে নিম্নকক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত বিলগুলো পর্যালোচনা, সংশোধন এবং অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করা। 

নিম্নকক্ষে পাসকৃত অর্থবিল ব্যতীত সব বিল উচ্চকক্ষে তুলতে হবে। উচ্চকক্ষ সেই বিল পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করবে। যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, সে ক্ষেত্রে উভয় কক্ষে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করে সে ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ সংশোধনের সুপারিশসহ বিল পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে পাঠাবে। নিম্নকক্ষ উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনগুলো সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। নিম্নকক্ষে পরপর দুটি অধিবেশনে পাসকৃত বিল যদি উচ্চকক্ষ প্রত্যাখ্যান করে এবং নিম্নকক্ষ যদি এটি আবারও পরবর্তী অধিবেশনে পাস করে, তবে উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো যাবে। অর্থাৎ উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকাতে পারবে না। এ ছাড়া উচ্চকক্ষ কোনো বিল দুই মাসের বেশি আটকে রাখলে তা উচ্চকক্ষ দ্বারা অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যে উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা থাকবে না এবং কোনো আইন স্থায়ীভাবে আটকানোরও ক্ষমতা থাকবে না, সেই উচ্চকক্ষ করে কী লাভ? নিম্নকক্ষ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বিধায় কমিশনের প্রস্তাবে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধু নিম্নকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলেও উচ্চকক্ষকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা সংসদে এককক্ষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রথমত, জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নিম্নকক্ষের পাশাপাশি উচ্চকক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে। কমিশন এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেমন জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের উদাহরণ দিয়েছে। এসব দেশে চুক্তি অনুমোদনের জন্য আইনসভার উভয় কক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। এ পদ্ধতি জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় আইনসভার নজরদারি নিশ্চিত করে। দ্বিতীয়ত, নিম্নকক্ষে কোনো বিতর্কিত বিল প্রস্তাব করা হলে উচ্চকক্ষ তা বিলম্বিত করতে পারবে। ফলে সেই বিল নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পরিবেশ তৈরি হবে। এতে নিম্নকক্ষের পক্ষে জনস্বার্থবিরোধী বিল বিনা বিতর্কে পাস করা কঠিন হবে। 

তৃতীয়ত, সংবিধান সংশোধনের পূর্বশর্ত হিসেবে কমিশন উভয় কক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সুপারিশ করেছে। উচ্চকক্ষের এ ধরনের ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক সংশোধনী রোধ করবে।

চতুর্থত, কমিশন রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত অথবা অপসারণ করার ক্ষেত্রেও উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সুপারিশ করেছে। এর ফলে অভিশংসন প্রক্রিয়া ন্যায়সংগত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হওয়ার ব্যাপারে উচ্চকক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছে। বিএনপির ৩১ দফা এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দেওয়া ৬২ দফা প্রস্তাবেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা আছে। ফলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা নিয়ে বিএনপির আপত্তি না থাকলেও আপত্তি হলো উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আর পাঁচজন মনোনীত হবেন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে। কিন্তু বিএনপি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ‘ভোটের অনুপাতে’ নয়, প্রাপ্ত ‘আসনের অনুপাতে’ বর্তমানে যেভাবে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন হয়, সেভাবে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন চায়।

বিএনপির এই অবস্থান নানা কারণেই সমস্যাজনক। কারণ উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি ব্যবহার না করা হলে উচ্চকক্ষের মূল উদ্দেশ্যই মাঠে মারা যাবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট যুক্তি এবং ব্যখ্যাও দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন স্থিতিশীল রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার জন্য বর্তমানে প্রচলিত এফপিটিপি পদ্ধতিতেই নিম্নকক্ষ নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। কমিশন সেই সঙ্গে এটাও বলেছে, পদ্ধতিটি সাধারণত বড় দলগুলোর পক্ষে কাজ করে এবং ছোট দলগুলোকে প্রান্তিক করে তোলে। এখন নিম্নকক্ষের মতো উচ্চকক্ষও যদি এফপিটিপি পদ্ধতিতে হয়, তাহলে নিম্নকক্ষের মতো উচ্চকক্ষেও একই দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যটি সফল হবে না। কমিশন তাই মনে করে, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিম্নকক্ষের এফপিটিপি পদ্ধতির কঠোরতা হ্রাস করতে সহায়ক হবে। পিআর পদ্ধতি ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে; ভোটারদের বৈচিত্র্য প্রতিফলিত করবে এবং বিভিন্ন আকারের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও সহযোগিতার পথ সুগম করবে। 

কমিশন পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের দৃষ্টান্ত দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিনেট (উচ্চকক্ষ) পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে, আর প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্নকক্ষ) এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। ভারতের দ্বিকক্ষ ব্যবস্থাও মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির সুবিধা কাজে লাগায়। রাজ্যসভা (উচ্চকক্ষ) পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়, যা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও সংখ্যালঘু স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়। অন্যদিকে লোকসভা (নিম্নকক্ষ) এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে সহায়ক হয়। 

কাজেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিদ্যমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতিতে নিম্নকক্ষ এবং জনগণের বিভিন্ন অংশের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ নির্বাচন করা হলে আইনসভা ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে মুক্ত তালিকা পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া উচিত। বদ্ধ তালিকা পদ্ধতিতে নির্বাচনের আগে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয় না। মুক্ত তালিকা পদ্ধতিতে নির্বাচনের আগে প্রতিটি দল তাদের প্রার্থীর ক্রমতালিকা ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করবে এবং নির্বাচনে ভোটাররা বিভিন্ন দলের প্রতীকে ভোট দেবেন। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দলের জন্য উচ্চকক্ষে তত শতাংশ আসন বরাদ্দ হবে এবং দলগুলোর পূর্বঘোষিত তালিকা থেকে সেই কয়জন প্রার্থী উচ্চকক্ষের সদস্য হবেন। অবশ্য কোনো দলের প্রার্থীদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে ওই দলকে মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে। 

এ ছাড়া উচ্চকক্ষকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার জন্য ভারতের রাজ্যসভার মতো অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোনো বিল স্থায়ীভাবে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক ও গবেষক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন ন ম নকক ষ র ন শ চ ত কর র প রস ত ব দলগ ল র প র ষ ট রপত আইনসভ র র ক ষমত র সদস য এফপ ট প অন ম দ ত ব কর র জন য ত করত আইন প ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে চায় কারা

কয়েক দিন ধরে বিএনপি সংস্কার নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করছে। সংস্কার নিয়ে বিএনপির এই প্রচেষ্টাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। দলটি সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারছে যে দেশের মানুষ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায় এবং তারা আর পুরোনো বন্দোবস্তে ফেরত যেতে চায় না। কিন্তু যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে আমরা পুরোনো ‘নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা’র মূলে আঘাত করতে পারি, সেগুলো নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী?

বাংলাদেশে যে শাসনব্যবস্থা, সেটিকে রাজনীতিবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘কনস্টিটিউশনাল সুপ্রিমেসি’ বা সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ এখানে সংবিধানকে সুউচ্চে রেখে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা প্রায় সমান্তরাল ক্ষমতা চর্চা করবে।

আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই ক্ল্যাসিক বন্দোবস্তের দর্শন/ধারণাটা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ (আমরা আমজনতা যেটিকে ‘সরকার’ হিসেবে বুঝি) তারা রাষ্ট্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা চর্চা করবে। কিন্তু তারা বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে না, আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করবে না এবং তারা চাইলেই সহজে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে না।

নির্বাহী বিভাগ বা সরকার আইনের মধ্য থেকে রাষ্ট্র চালাবে। অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়/পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। জ্বালানি/বিদ্যুৎ বিভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। ওয়াসা/পানি মন্ত্রণালয় পানি দেবে, সড়ক মন্ত্রণালয় রাস্তাঘাট ঠিক করবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-সীমান্ত রক্ষা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ দেশের নিত্য যেসব প্রয়োজন, সেগুলো আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং দেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু নির্বাচিত লোক (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) এসব মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা মন্ত্রী হিসেবে আমলাদের নেতৃত্ব দেবেন তথা তত্ত্বাবধান করবেন।

আইনসভা বা সংসদের মোটাদাগে কাজ হবে সরকার/নির্বাহী বিভাগ কোন প্রক্রিয়ায় দেশ চালাবে (ঠিক কোন আইনের আওতায়), তা ঠিক করে দেওয়া অর্থাৎ আইন প্রণয়ন করা। পাশাপাশি দেশ চালাতে যে টাকাপয়সা দরকার এবং জনগণের কাছ থেকে কতটুকু ও কীভাবে সেটি আদায় করা হবে এবং কোন কোন খাতে সেটি ব্যয় করা হবে, তা কেবল সংসদই অনুমোদন করবে। সরকার বাজেট প্রস্তাব করার মাধ্যমে এর একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া উপস্থাপন করবে এবং সংসদ সদস্যরা সেটির খুঁটিনাটি যাচাই-বাছাই করবেন, দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে মেলাবেন, বিতর্ক করবেন এবং সংসদে সেটি পাস করবেন।

সংসদ শুধু এগুলো করেই ক্ষান্ত হবে না, তারা সরকার, অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ আইন মেনে কাজ করছে কি না বা সরকারের যে মন্ত্রণালয়/বিভাগকে যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেটি ঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না, কিংবা কোথাও দুর্নীতি/লুটপাট/ জনগণের অর্থের অপচয় হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি করবে (সংসদীয় কমিটিগুলোর স্ক্রুটিনির মাধ্যমে) এবং সরকারের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বিপথে গেলে তাকে ডেকে জবাবদিহি করবে (সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে) কিংবা পুরো সরকার বিপথে চলে গেলে তাকে অপসারণ করবে (আস্থা ভোটের মাধ্যমে)।

অন্যদিকে বিচার বিভাগের মোটাদাগে কাজ হবে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ সংবিধান অনুযায়ী আইনের মধ্যে কাজ করছে কি না বা রাষ্ট্র চালাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা এবং কোনো নাগরিকের সংবিধানস্বীকৃত ও আইনে প্রদত্ত অধিকার সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান (কিংবা ব্যক্তিপর্যায়েও) লঙ্ঘন করলে তার প্রতিকার করা।

সুতরাং সরকার যাতে আইনের বাইরে কাজ না করে, যেমন সরকারি বাহিনী যাতে যাকে-তাকে ধরে বেআইনি নির্যাতন করতে না পারে, খুন করতে না পারে, আটকে রাখতে না পারে কিংবা সরকারি আমলারা যাতে নাগরিকদের যেখানে–সেখানে হয়রানি করতে না পারেন, তার জন্য আপনি বিচার বিভাগের কাছে নালিশ করতে পারবেন ও সুবিচার পাবেন।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কার্যকরভাবে চলার জন্য রাষ্ট্রের ওপরের এই তিন অঙ্গের পরস্পরের প্রভাবমুক্ত থেকে মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করা জরুরি। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে (এমনকি অনেক অনুন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও) এভাবেই রাষ্ট্রব্যবস্থা চলে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ আরেকটি অঙ্গের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না এবং কোনো একটি অঙ্গ যাতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে জনগণের নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পারে, সে জন্য অন্য অঙ্গগুলো সক্রিয়ভাবে তা প্রতিহত করবে।

বাংলাদেশে বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায়/বন্দোবস্তে যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতবে, সেই দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবেন। অর্থাৎ তিনি নির্বাহী বিভাগ বা সরকারপ্রধান হবেন। আবার তিনিই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংসদনেতাও হবেন। অর্থাৎ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কার্যক্রমও প্রায় নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও সংসদনেতা হলে, যে সংসদের সরকারকে জবাবদিহি করার কথা, সেই সংসদ কতটুকু কার্যকর হবে, সংসদনেতা হিসেবে তিনিই সেটা নির্ধারণ করে দেবেন! এটা কি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয়ে গেল না?

চিন্তা করে দেখুন, প্রধানমন্ত্রীদের এই অসীম ক্ষমতা! এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান! কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাহী বিভাগের প্রধান; কিন্তু আইনসভা বা বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এই একচ্ছত্র ক্ষমতাকেই আমরা বলছি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম, যেখানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠেন, যা যেকোনো প্রথাগত গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে।

আবার তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিচারপতিদেরও নিয়োগ দেবেন, অর্থাৎ প্রকারান্তরে বিচার বিভাগকেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন! কীভাবে? তিনি রাষ্ট্রপতিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের ‘পরামর্শ’ দেবেন। সবাই জানেন, আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটকু। তিনি প্রধানমন্ত্রীর এসব পরামর্শ শুনতে বাধ্য, কাজেই অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বিচার বিভাগের উচ্চ আদালতের বিচারকদেরও নিয়ন্তা!

আবার নিম্ন আদালত যেহেতু নির্বাহী বিভাগের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, সেটিও নির্বাহী বিভাগই মূলত বিভিন্ন পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান, তিনি সংসদনেতা, তিনিই বিচার বিভাগেরও নিয়ন্তা! আবার তিনি তাঁর দলেরও প্রধান! অবশ্য এখানেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার শেষ নয়!

প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলে তিনি দেশের সংবিধানও ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারবেন! অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সংবিধান, নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রকাঠামোর প্রায় পুরোটাই নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন!

এটি কাল্পনিক চিত্র নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা এভাবেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চর্চা করে বাংলাদেশে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছেন।

চিন্তা করে দেখুন, প্রধানমন্ত্রীদের এই অসীম ক্ষমতা! এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান! কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাহী বিভাগের প্রধান; কিন্তু আইনসভা বা বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এই একচ্ছত্র ক্ষমতাকেই আমরা বলছি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম, যেখানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠেন, যা যেকোনো প্রথাগত গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে।

জুলাই ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্র এভাবে চলুক, তরুণেরা তা চান না। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে যে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রকে ছাত্র-জনতা উৎখাত করেছে, সেটি পুরোনো রূপে ফিরে আসতে পারে না। আমাদের এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই বর্তমান সংস্কার কমিশন এই অসীম স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের জন্য মোটাদাগে ছয়টি বড় ধরনের সাংবিধানিক সংস্কার সুপারিশ করেছে:

১. একই ব্যক্তি দল, সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের প্রধান হতে পারবেন না। অর্থাৎ যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন এবং তিনি সংসদের নেতাও হতে পারবেন না। এর মাধ্যমে আইনসভার ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।

২. সংসদ সদস্যরা যাতে সরকার বা নির্বাহী বিভাগকে সত্যিকার অর্থে, স্বাধীনভাবে জবাবদিহি করতে পারেন, সে জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা, যাতে সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন। এতে সংসদের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের ওপর আইনসভার জবাবদিহি কিছুটা বৃদ্ধি পাবে।

৩. বিচারপতির নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্টস কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপ কমবে বলে আশা করা যায়।

৪. আইনসভাকে আরও কার্যকর করতে এবং সরকারি দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে ভারসাম্য আনতে আইনসভার উচ্চকক্ষ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠন করা। এর সুফল কী হবে?

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিএনপি ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ৩৩ ও ৪১ শতাংশ ভোট পেয়েও যথাক্রমে প্রায় ৫০ ও ৬০ শতাংশ আসন জিতেছিল। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অর্থাৎ আপনি কোনো আসন জিততে ১০০ ভোটের মধ্যে ৫১ ভোট পেতে হবে না, ৩০ ভোট পেলেও জিতবেন যদি বাকি ভোটগুলো কয়েকজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় (যেমন কেউ ২৮ ভোট, কেউ ২৭ ভোট, আবার কেউ ১৫ ভোট পেল)। এভাবে নিম্নকক্ষে আপনি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০০ আসন পেতে পারেন।

কিন্তু উচ্চকক্ষে যদি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে আপনি উচ্চকক্ষের ১০০টি আসনের মধ্যে আপনার ভোটের অনুপাতে ৩০টি আসন পাবেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনসভায় ক্ষমতার একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বর্তমানে ‘উইনার টেকস অল’ বা ‘জিরো সাম গেম’ যেটা আছে, সেটি আর থাকবে না। যদি উচ্চকক্ষকে যথাযথ ক্ষমতা দেওয়া হয়, যা সংস্কার কমিশনও প্রস্তাব করেছে, তাহলে সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে আইনসভা আরেকটু কার্যকর হবে।

৫. সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। অর্থাৎ ৪ নম্বর পয়েন্টটি বাস্তবায়ন করলে সংসদের দুই কক্ষে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার সম্ভাবনা প্রবল এবং যার ফলে সংবিধান সংশোধনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেই অগ্রসর হতে হবে।

৬. নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহি করার যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন সরকারি কর্ম কমিশন, নির্বাচন কমিশন (সংস্কারের পর মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন প্রভৃতি) সেগুলোর নিয়োগ প্রদানের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন। এখানে সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব নিয়োগ প্রদান।

এই হচ্ছে মোটাদাগে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র রুখতে বা পুরোনো বন্দোবস্ত বাতিল করতে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব। দুঃখজনকভাবে, বিএনপি মোটাদাগে এসব সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটি সত্য যে বিএনপি ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলোয় রাজি, কিন্তু নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র রোধে রাষ্ট্রের ওপরের সংস্কারগুলোয় প্রধানতম। দুঃখজনকভাবে বিএনপির অসহযোগিতা এগুলো বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে তারা কি তাহলে পুরোনো বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে চায়? অথবা তারা কি আগের নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বজায় রাখতে চায়?

সমগ্র জাতির সামনে একটি দারুণ সুযোগ এসেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিগঠনের। কেবল বিএনপি যদি এসব সংস্কারে ‘হ্যাঁ’ বলে, এসব সংস্কার অনেকটাই সম্ভব। কারণ, অন্যান্য বেশির ভাগ মূলধারার দল এসব সংস্কারের ব্যাপারে মোটামুটি একমত। এখন বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা ইতিহাসে নায়ক না খলনায়কের ভূমিকায় থাকবে।

সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে চায় কারা