ধর্মপাশা উপজেলা সদরের মধ্যবাজারে অবস্থিত মাত্র ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের শয়তানখালী সেতুর পুনর্নির্মাণ কাজ দুই বছরেরও শেষ হয়নি। নির্মাণকাজে অবহেলা ও ধীরগতির কারণে ঠিকাদারের ওপর অসন্তুষ্ট থাকলেও এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত সময়ে সেতুটি নির্মাণ না হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রায় ১৫-২০টি গ্রামের মানুষকে। 

জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অর্ধশত বছরের পুরোনো শয়তানখালী সেতুটি দেবে যেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেতুটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন সেতুটির ওপর দিয়ে পথচারী ও যান চলাচল বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। দেবে যাওয়া পুরোনো সেতুর পরিবর্তে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। ২০২৩ সালে এলজিইডির হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শয়তানখালী সেতু নির্মাণসহ ধর্মপাশা থানার সামনে থেকে বাহুটিয়াকান্দা পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ মিটার সড়ক ও একটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য ৯ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ৪৮০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ কাজ বাস্তবায়নে সুনামগঞ্জের মাহবুব এন্টারপ্রাইজকে ঠিকাদার নিযুক্ত করে ওই বছরের ২৬ মার্চ কার্যাদেশ দেয় এলজিইডি। একই বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সেতু ও সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। কাজে ধীরগতির অভিযোগ এনে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ধর্মপাশা বাজারের ব্যবসায়ীরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু এতেও কোনো হেলদোল নেই ঠিকাদারের। ঠিকাদার আগের মতোই ধীরগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।  

ধর্মপাশা বাজারের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, শয়তানখালী সেতুটি দ্রুত নির্মাণ না হওয়ায় মধ্যবাজারের ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

আরেক ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ বলেন, শয়তানখালী সেতুটির কারণে দীর্ঘ চার বছর ধরে ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করা হলে মধ্যবাজারে ব্যবসায় গতি ফিরে আসবে।  

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল মহসিন মো.

মাহবুবের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। প্রকল্প সাইটে ঠিকাদারের নিযুক্ত ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি রাজধানীর হাতিরঝিলের সেতুর আদলে তৈরি হচ্ছে। শুরুর দিকে মিস্ত্রি পাওয়া যাচ্ছিল না এবং গত বর্ষায় কাজ করতে না পারায় কাজ পিছিয়েছে। মাস দুয়েকের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, অত্যন্ত ধীরগতিতে সেতুটির নির্মাণকাজ চলতে থাকায় প্রকল্প পরিচালক কার্যাদেশ বাতিল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে কাজটি আরও পিছিয়ে যেতে পারে– এমন ভাবনা থেকে তা করা হয়নি। তাই ঠিকাদারকে সতর্ক করে দিয়ে আগামী ২৫ জুনের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে কার্যাদেশ বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ ক জ শ ষ কর ব যবস য় বছর র ই বছর ধ রগত

এছাড়াও পড়ুন:

কোন্দলের খোন্দল থেকে সাবধান

আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে– ‘যদি জড়াও কোন্দলে, পইড়া যাইবা খোন্দলে।’ আঞ্চলিক ভাষায় ‘খোন্দল’ বলতে বড় কোনো গর্তকে বোঝায়। বহু বছর আগে যখন আমাদের এলাকায় লঞ্চে যাতায়াত করতে হতো, তখন দেখতাম ফেরিওয়ালারা একটি বই বিক্রি করত, ‘কী করিলে কী হয়’ নামে। তাতে মানুষের নানা কর্ম-অপকর্মের প্রতিফল লেখা থাকত। ইংরেজিতে একটি প্রবচন আছে– ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল।’ বাংলায় বলা যায়– একতাই বল। 

কথাগুলো ভাবছিলাম ১২ এপ্রিল সমকালের ‘দলীয় কোন্দলে আট মাসে ৫১ নেতাকর্মী নিহত’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদনটি পাঠ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত আট মাসে সংঘর্ষে বিএনপির ৫১ নেতাকর্মী নিহত ও চার শতাধিক আহত হয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৪৮টি সংঘর্ষে এসব নেতাকর্মী হতাহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ১৭ জন নিহত হয়েছেন। একই সময়ে দেশে সংঘটিত ৯৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ৮৮টিই বিএনপির অন্তর্কোন্দলের কারণে ঘটেছে। 
খবরটি স্বস্তিদায়ক নয়। বিশেষত, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে যে দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে দলকে সুরক্ষা দিয়েছেন, মুক্ত পরিবেশে তারা যদি ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হন, তাহলে তার পরিণাম শুভ হতে পারে না। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি এখন দেশে নেই। এমনকি বিএনপির বাইরের সব দল একত্র হলেও বিএনপির জনসমর্থনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। আগামী সংসদ নির্বাচনে (যখনই অনুষ্ঠিত হোক) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দলটির সরকার গঠনের বিষয়টিও এখন মোটামুটি নিশ্চিত। ঠিক সে সময়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তৎপ্রেক্ষিতে হানাহানির খবর সংগত কারণে বিএনপির সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের হতাশ করবে। এমনিতে লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মীর দখল-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের কারণে সাধারণ মানুষের মনে দলটি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিতে শুরু করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব অপরাধের জন্য প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো– তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। 

বহিষ্কার, সদস্যপদ স্থগিত ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়েও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দৃশ্যমান করতে পারেননি দলটির নেতারা। এই না পারা,  কর্মী-নেতাদের একাংশের বেপরোয়া হয়ে ওঠাকে সচেতন ব্যক্তিরা দলটির জন্য অশুভ সংকেত বলে মনে করছেন। এরই মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধপক্ষ প্রচারণা চালাতে শুরু করেছে যে, ‘ক্ষমতা’য় না যেতেই যে দলের কর্মীরা এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়, ক্ষমতা হাতে পেলে তারা কী করবে? যারা এমনটি ভাবছেন, তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। কেননা, দলটির নেতাকর্মীর একাংশের কার্যকলাপ জনমনে এ সংশয়ের সৃষ্টি করেছে, যা ধীরে ধীরে বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হতে পারে। যদিও বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে ওয়াকওভার পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছেন, তবে পরিস্থিতি যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে। বিএনপির এক সময়ের মিত্র এবং আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত নতুন দলটির বিএনপিবিরোধী প্রচারণা থেকে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। 

পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিএনপির জন্য গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। এই কোন্দল কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং রাজনৈতিক তত্ত্বে বলা হয়ে থাকে, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা দলের সাংগঠনিক শক্তির বিকাশ ঘটায়। কিন্তু বিএনপিতে এখন যেটা চলছে, তা সাংগঠনিক শক্তির বিকাশের পরিবর্তে বিনাশ ঘটাচ্ছে। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা যখন কোন্দলে রূপান্তরিত হয়, তখন তা রূপ নেয় সংঘাতে, ডেকে আনে বিপর্যয়। যদিও বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ সমকালকে বলেছেন, ‘দলের ভেতর প্রতিযোগিতা থাকবে। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা থেকে কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ কাম্য নয়।’ রিজভী আহমেদ কাম্য নয় বললেও সে ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে বিএনপিতে। দলটিতে এখন প্লাস নয়, মাইনাসের খেলা চলছে। কে কাকে মাইনাস করে জায়গা দখল করবে তা নিয়ে যত গোলমাল।

এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, দেশব্যাপী বিএনপিতে এখন বিরাজ করছে সর্বনাশা বিভক্তি। দলটিকে যারা পছন্দ করেন এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, এই বিভক্তি তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একাধিক গ্রুপ পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে আছে। আমার নিজের এলাকা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর-সিরাজদীখান উপজেলায় কমপক্ষে তিনটি পরস্পরবিরোধী গ্রুপ সক্রিয়। সব জাতীয় ও দলীয় কর্মসূচি তারা পালন করে পৃথকভাবে। এখানে আবার একজনকে বলা হচ্ছে ‘মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের কাণ্ডারি’ হিসেবে। দলটির এক সমর্থক সেদিন বললেন, ‘আমি মনে করি বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী-সমর্থকই একেকজন কাণ্ডারি। সে ক্ষেত্রে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে এই আসনের কাণ্ডারি বলা হবে কেন?’ এই কেনর জবাব তো দলটির বাইরের কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রচার করা হচ্ছে, ওই ব্যক্তিকে নাকি দলের হাইকমান্ড থেকে ওই আসনের এমপি প্রার্থী হিসেবে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হয়েছে। তিনি সে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে নিজের আসন পোক্ত করতে অন্যদের জন্য রেড সিগন্যাল জ্বালিয়ে দিয়েছেন। উপজেলা-ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কমিটিতে শুধু নিজের সমর্থকদেরই ঠাঁই দিয়েছেন। ফলে অনিবার্য কারণে জন্ম নিয়েছে কোন্দল। সমকালের প্রতিবেদনে বিএনপির যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার মূলে রয়েছে এ ধরনের সিগন্যাল।

দীর্ঘদিন নির্যাতিত হওয়ার পর বিএনপির সামনে যে ‘সম্ভাবনার দুয়ার’ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, কোন্দলের খোন্দলে পড়ে তা যেন ধূলিসাৎ না হয়, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সেদিকে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন সচেতন ব্যক্তিরা। 

মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ