ঈদযাত্রায় ৩৫২ প্রাণহানি আগের চেয়ে ২১% কম
Published: 9th, April 2025 GMT
ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১৫ দিনে ৩৪০ সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনায় ৩৫২ জনের প্রাণ গেছে। এ সংখ্যা আগের বছরের রোজার ঈদের তুলনায় ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। গত বছরের তুলনায় দুর্ঘটনা কমেছে ২১ দশমিক ০৬ শতাংশ। দীর্ঘ ছুটির কারণে এ বছর দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগ কমেছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব তথ্য জানিয়েছে।
সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক-মহাসড়কে ৩১৫টি দুর্ঘটনায় ৩২২ জন নিহত ও ৮২৬ জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ২১টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ৪টি দুর্ঘটনায় ১০ জনের প্রাণ গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
সমিতির মহাসচিব মো.
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিকতা এবং ভোক্তা অধিকার ও বিআরটিএ’র তৎপরতায় এবারের ঈদযাত্রা মাফিয়াতন্ত্র মুক্ত ছিল। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যাত্রীবান্ধব সিদ্ধান্তের কারণে মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পেরেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান মোজাম্মেল হক।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ চলাচল, পর্যাপ্ত রোড মার্কিং বা সড়কবাতি না থাকা, সড়ক বিভাজকের অভাব, সড়ক ও যানবাহনের নির্মাণ ত্রুটি, উল্টোপথে যান চলাচল, চালকের অদক্ষতা এবং বেপরোয়া চলাচলকে দায়ী করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঈদকে কেন্দ্র করে গণপরিবহনগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র লোকজনকে বাড়ি যেতে হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় পড়া যানবাহনের ৩২ দশমিক ২৭ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাস, ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ কার-মাইক্রোবাস, ৭ দশমিক ২১ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশ। দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৪১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১ দশমিক ২৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে ও ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ, মহাসড়কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা, দক্ষ চালক ও যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে সার্ভিস লেনের ব্যবস্থা, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ঈদের ছুটি বাড়ানোসহ ১১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সমিতির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, যুগ্ম মহাসচিব তাওহীদুল হক লিটন, অর্থ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল প্রমুখ।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গণহত্যার প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশ
ইসরায়েলি আগ্রাসনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। পৃথিবীর দেশে দেশে মানবিক মানুষেরা সেই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। এবার এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষও। গতকাল শনিবার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন লাখো মানুষ।
‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’-এর ডাকে আয়োজিত এ গণজমায়েতে অংশ নিতে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল সকাল থেকে ট্রেনের ছাদে, বাসে, ট্রাকে ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন অসংখ্য মানুষ। খণ্ড খণ্ড মিছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হয়ে জনসমুদ্র তৈরি করে।
বেলা তিনটায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২টার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। লাখো মানুষ সড়কে নেমে এলে রাজধানীর মূল সড়কগুলোতে যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। অনেকে বাস থেকে নেমে মিছিলের স্রোতে মিশে যান। হাতে হাতে ছিল ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফিলিস্তিনের পতাকা। অনেকের পরনে ছিলে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান-সংবলিত টি-শার্ট।
‘ফিলিস্তিনে হামলা কেন, জাতিসংঘ জবাব চাই’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’, ‘ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগসহ অনেক এলাকা। ‘সেভ গাজা, সেভ হিউম্যানিটি’, ‘টু স্ট্যান্ড উইথ প্যালেস্টাইন ইজ টু স্ট্যান্ড উইথ হিউম্যানিটি’, ‘স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা’, ‘স্টপ জায়োনিস্ট টেরর’—এ ধরনের লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন সমাবেশে যোগ দেওয়া অনেকেই। স্বেচ্ছাসেবীরা নিজ উদ্যোগে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পানি ও জুস বিতরণ করেন।
দুপুর ১২টার পর সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে না পেরে হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ, হাইকোর্ট, টিএসসি, মৎস্য ভবন মোড়সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে অবস্থান নেন।
‘গণহত্যা বন্ধে বিশ্বকে বার্তা দিতে এসেছি’মার্চ ফর গাজার গণজমায়েতে অংশ নিতে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে এসেছেন কলেজশিক্ষার্থী শাখাওয়াত হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন টিভি পর্দায় এ নৃশংসতা দেখলে খুব অসহায় লাগে। ইসরায়েলকে কি কেউ থামাতে পারবে না! আমরা চাই মুসলিম উম্মাহ এ গণহত্যা বন্ধ করুক। এখান থেকে আমরা বিশ্বকে একটা বার্তা দিতে চাই।’
ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো. জুনায়েদ এসেছেন গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে। তিনি চান ফিলিস্তিনি হত্যা বন্ধ হোক। বললেন, মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ছাড়া সেটা কখনো সম্ভব হবে না।
ছিন্নভিন্ন এক শিশুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিরপুর-২ থেকে সমাবেশে এসেছেন ফজিলাতুন নেসা বৃষ্টি। তিনি বলেন, ইসরায়েল ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে। পুরো পৃথিবী দেখছে। কেউ ইসরায়েলকে থামাচ্ছে না। মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু এই ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান নিয়ে তিনি সমাবেশে এসেছেন।
কী বললেন বক্তারাপবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও গাজায় গণহত্যার ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মার্চ ফর গাজা সমাবেশ শুরু হয় বেলা সোয়া তিনটার দিকে। সমাবেশ শুরুর আগে মঞ্চে প্রথম আসেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। একে একে উপস্থিতি হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের নেতারা।
একপর্যায়ে মঞ্চে এসে সবাইকে শৃঙ্খলা মেনে সমাবেশ সফল করার আহ্বান জানান ইসলামি বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি বলেন, ‘আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র ফিলিস্তিনের প্রতি, আল-আকসার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরের হতে পারি, কিন্তু আজকের এ সমাবেশ প্রমাণ করে আমাদের একেকজনের বুকের ভেতরে বাস করে ফিলিস্তিন।’
সমাবেশে বক্তব্য দেন ইসলামি বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মত, পথ ভিন্ন হলেও আজকে আমরা প্রমাণ করেছি, ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবিতে আমরা সবাই এক।’
ঘোষণাপত্র পাঠসমাবেশের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ঘোষণাপত্রে আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার, ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক আদালতে জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধবিরতি নয়, অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘসহ মুসলিম বিশ্বকে দায়িত্ব নিতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মজলুম গাজাবাসীর পাশে খাদ্য, চিকিৎসা ও প্রতিরক্ষা সহায়তা নিয়ে দাঁড়ানো, বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দ ফিরিয়ে আনা, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল ও ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে বলেও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল মালেকের মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।