৯ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। সিলেট শহরে চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটায় কিছুদিনের জন্য মুক্ত সিলেটের জেল ভেঙে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কয়েদিকে ছাড়ানো হলো। সবাই তখন কারফিউ ভাঙার কারণে সিলেট ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে লাগলেন। প্রায় জনশূন্য সিলেটে তখন পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ আহত মানুষ দিয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল পরিপূর্ণ। মেডিকেল কলেজের সার্জারির প্রধান অধ্যাপক ডা.

শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালটিকে কয়েক দিন থেকে সারাক্ষণ আগলে ধরে আছেন। সবাই চলে গেছে শুধু একজন তরুণ ডাক্তার শ্যামল কান্তি লালা তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে রেখে কোথাও যাবেন না। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী সারাক্ষণ আহত মানুষকে তুলে আনছেন। নার্স মাহমুদুর রহমান আর ওয়ার্ড বয় মুখলেসুর রহমান অপারেশন থিয়েটারে আর ওয়ার্ডে অধ্যাপককে সহায়তা করতে ব্যস্ত। ডা. শামসুদ্দিন বিপদ বুঝে আগেই অন্য নার্সদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি সৈনিকেরা পাকিস্তানি বিশাল বাহিনীর চাপ সহ্য করতে না পেরে সিলেট ত্যাগ করতে হলো। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার ৯ এপ্রিল শহরে ঢুকেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করল। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আনল অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমেদ ও তার সহকর্মীদের আর কিছু রোগীর; তারপর সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরেই গুলি করে তাঁদের হত্যা করল। শুধু সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে মরার ভান করে বেঁচে গেলেন গুলিবিদ্ধ মুখলেসুর রহমান। হাসপাতালে আহত মানুষের সেবারত চিকিৎসক হত্যা শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে মানবতার বিরুদ্ধে একটি বড় জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করল হানাদার বাহিনী।

ডা. শামসুদ্দিনের এই কর্তব্যবোধ, মানবতাবোধ, অসম সাহসিকতা, পেশার উৎকর্ষ ও সম্মান বৃদ্ধির জন্য আজীবন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাই তিনি হয়ে উঠলেন একটি কিংবদন্তি। অবিভক্ত সিলেটের করিমগঞ্জের বদরপুরে জন্ম। সিলেটে স্কুল ও কলেজে পড়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৪৬–এ পাস করে নতুন পাকিস্তানে চলে আসেন ভেঙে পড়া চিকিৎসা আর মেডিকেল শিক্ষাকে উন্নত করতে। সরকারি চাকরির জন্য যখন যেখানে বদলি হয়েছেন, সেখানেই রেখেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান। জাতীয় পর্যায়ে ও জেলা পর্যায়ে যখন যেখানে গেছেন, সেখানে মানুষ এবং সমাজ উন্নয়নকে সংঘটিত করেছেন। তিনি তরুণ বয়সে ঢাকায় থাকার সময় ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হয়ে তৈরি করলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। যাত্রা শুরু হলো চিকিৎসকদের দিকনির্দেশনা আর পেশার উন্নতির জন্য ন্যায্য সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তান তখন তাদের ডাক্তারদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাত। নতুন রাষ্ট্রে বৈষম্য শুরু হলো সব ক্ষেত্রে। প্রতিবাদ করতে থাকলেন প্রতি পদে। তাই এরপর তাঁকে আর ঢাকায় রাখা ঠিক হবে না। তাতে থামল না তাঁর কণ্ঠ। কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম পাঠানো হতো। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সবখানেই গড়ে তুলতেন মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন আর পেশার উন্নতি ও রোগীদের এবং সবচেয়ে উত্তম ও মানবিক সেবার জন্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন।

ঢাকায় থাকার সময় সভাপতি হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রথম রিলিফ অর্গানাইজেশন ‘পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোরের’ তা নিয়ে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ১৯৫৬–এর পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় দেশ যখন দিশাহারা, তখন সরকার পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স করে সভাপতি এই তরুণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেটে রেসিডেন্ট সার্জনের ওপর সারা দেশে মেডিকেল রিলিফ পরিচালনা করার দায়িত্ব দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তাঁর নেতৃত্ব দেশের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। তার অনেক ছাত্র এই অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য পরবর্তী জীবনে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তাঁকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য সম্মান জানাতেন।
লন্ডন থেকে ১৯৬২ সালে সার্জারিতে উচ্চশিক্ষা (এফআরসিএস) নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। সেখানে শুরু হলো তাঁর মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে, ছাত্র, শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে, রোগীসাশ্রয়ী সুচিকিৎসা, হাসপাতালের সার্বিক উন্নতি, সবকিছুই করার জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। দুই ছোট ছেলে নিয়ে যখন রাজশাহীতে তাঁর থাকতে হতো তখন তাঁর সহধর্মিণী অধ্যক্ষ হোসেনে আরা আহমেদ (১৯৪৭ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে মাস্টার্স করা) তিন কন্যা নিয়ে সিলেটে থাকতে হতো। তিনি সিলেট মহিলা কলেজকে প্রতিষ্ঠা করা আর নারীদের ক্ষমতায়ন করার জন্য অনবরত কাজ করে যেতেন। তাঁরা দুজনই ঠিক করেছিলেন তাঁরা আজীবন নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এবং পেশার উন্নতির জন্য সংসার ও জীবনের ভালো সময়গুলো বিলিয়ে দেবেন।

১৯৬৪ সালে শামসুদ্দিন সিলেটে এলেন। সিলেটে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়ে কেন্দ্রীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কনভেনশন করেন। দেশি–বিদেশি চিকিৎসকের সমারোহে কোনো মফস্‌সল শহরে প্রথম অনুষ্ঠিত হলো বিশাল মেডিকেল সম্মেলন। তাঁর বক্তৃতায় সরকার, প্রশাসনসহ চিকিৎসকদের তিনি আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য আহ্বান করেন। তিনি ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের পেশাগত মান বাড়ানোর সঠিক নির্দেশনাসহ, শিক্ষা, রিসার্চ, সমাজসেবার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি সিলেটে টিবি ক্লিনিকটিকে টিবি হাসপাতালে রূপান্তর করেন, তাতে লন্ডনপ্রবাসীরা অর্থায়নও করেন।
উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে তিনি আবার রাজশাহীতে বদলি হয়ে মেডিকেল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক ড. শামসুজজোহাকে গুলিতে আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেন সার্জারির অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। অপারেশন করার সময় অবাক হয়ে দেখলেন শুধু একটি গুলি নয়, সৈন্যরা খুব কাছ থেকে অনেক গুলি করেছে, এমনকি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করেছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না ড. শামসুজজোহাকে। অত্যন্ত দুঃখিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে রিপোর্ট লিখলেন অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। বিশদভাবে সব জখমের বর্ণনা দিলেন। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা এসে অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমেদকে জানালেন তিনি যেন রিপোর্টে লেখেন একটি গুলি ভুলক্রমে লেগে গেছে। এই মার্শাল লর সময়ে তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব যেন পালন করেন। অকুতোভয় ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তিনি তাঁর রিপোর্টে সত্য কথাই লিখবেন। শুধু তা–ই নয়, ড. শামসুজজোহার হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সভা করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর তার সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ।

অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ তার কয়েক মাস পর সিলেট মেডিকেল কলেজে সার্জারির প্রধান হয়ে বদলি হয়ে এলেন। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকল আর ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে বাঙালি সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় লাভ করার পরও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাঁয়তারা করতে লাগল। ডা. শামসুদ্দিন সব ডাক্তার ও ছাত্রদের রক্তপাতের জন্য হুঁশিয়ার থাকতে বললেন এমনকি আলাদা ব্লাড ব্যাংক এবং ইমার্জেন্সি স্কোয়াড নিজ হাতে গঠন করলেন। প্রায় সবাই তখন এই সাবধান বাণী বিশ্বাস করতে পারছিল না। ২৩ মার্চ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেক মুক্তি পাওয়া আসামি ক্যাপ্টেন (অব.) মোত্তালেব মোটরসাইকেল চালিয়ে তার বাসায় হাজির। জেলে অত্যাচারের ফলে আহত তিনি ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি মৃত্যুতালিকা, যেটা সিলেটের খাদিম নগরের গ্যারিসনের একজন বাঙালি সামরিক ইপিআর সদস্য পাকিস্তানিদের পরিকল্পনার সময় হাতে পেয়েছিলেন। সেই মৃত্যুতালিকার প্রথম দিকের নামের মধ্যে লেখা ছিল ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের নাম।
দুই দিন পর ২৫ সে মার্চ পাকিস্তানিরা শুরু করল গণহত্যা। পথেঘাটে নির্বিচার হত্যা করতে লাগল বাঙালিদের। ডা. শামসুদ্দিন তাঁর ডাক্তার আর নার্সদের দিয়ে গুলিবিদ্ধ মানুষের চিকিৎসায় ব্যস্ত থাকলেন। সেই সময়ে গুলিবিদ্ধ পাঞ্জাবি সেনাদের সঙ্গে কর্মরত দুজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা একজন ক্যাপ্টেন মাহবুব আর আরেকজন লেফটেন্যান্ট ডা. সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমদকে গুলি করে হাসপাতালে ফেলে যায়। অপারেশন করেও মাহবুবকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না; কিন্তু ডা. মাইনুদ্দিন আহমেদকে সারিয়ে তুলে গ্রামে শিগগিরই পাঠিয়ে দিলেন। ডা. মাইনউদ্দিন তাঁকে অনেক অনুরোধ করেন সিলেট শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। বলেছিলেন স্যার আমি তাদের ডাক্তার ছিলাম আর তারাই আমাকে গুলি করেছে, তাহলে আপনি তো কোনোভাবেই নিরাপদ নন। কিন্তু ডা. শামসুদ্দিন মৃদু হেসে বলেছিলেন তোমরা তোমাদের কাজ করো আমার হাসপাতালের আহতদের ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই।
ছোট ছেলে আগেই ২ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য চলে গেছেন। সবাই ডা. শামসুদ্দিনকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন; কিন্তু তিনি মৃদু হেসে বলতেন এখনই তো আমাদের হাসপাতাল আগলে ধরে থাকার কথা, এটি আমাদের পেশাগত অঙ্গীকার। তোমরা তোমাদের কাজ করতে চলে যাও। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, আমাদের ছেলেও তো আহত হয়ে হাসপাতালে আসতে পারে। ৯ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণের চাপে সিলেট ছাড়তে বাধ্য হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিলেটে প্রবেশ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢোকে এবং ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ তাঁর ইন্টার্ন শ্যামল কান্তি লালাসহ ৯ জন বা আরও বেশি মানুষকে হাসপাতালের ভেতর গুলি করে হত্যা করে। তিন দিন পর কারফিউ ভাঙলে তাঁর চাচা এবং স্বজনেরা তাঁদের হাসপাতালের প্রাঙ্গণেই তাঁদের সমাহিত করেন।
শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর সহযোগীদের সমাধি আজ সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। বহু বছর বেড়ায় ঢাকা থাকার পর এই সৌধও বানিয়েছেন পারিবারিক অর্থায়নে কর্নেল সালাম বীরপ্রতীকের তত্ত্বাবধানে। তার বহু বছর পরে মেয়র সেখানে উন্নয়ন ঘটান, পারিবারিক ফলকটি ফেলে নিজের নামের সঙ্গে ১৫ জন কাউন্সিলের নামের ফলক লাগান। তাঁদের জন্য যদিও কোনো জাতীয় সম্মান বা পদক কোনো দিন দেওয়া হয়নি, তবে অগণিত মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসায় সিক্ত হয় তাঁদের স্মৃতিসৌধ।

তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর আদর্শকে তাঁদের সন্তানেরা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে চলেছে। সিলেটে এবং আমেরিকাতে তারা বিভিন্ন জনকল্যাণ কাজ করে চলেছে। সিলেটে কিডনি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে ৬ বছর থেকে চ্যারিটি ডায়ালাইসিস সেন্টার চালনার পরে এখন ১২ তলা কিডনি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, কোভিডের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁরা তিনজন চিকিৎসক থেকে কয়েক মিলিয়ন ভ্যাকসিন, ৮৫০টি ভেন্টিলেটরসহ বহু সামগ্রী দেশে পাঠিয়েছিলেন। সিলেটে যখন একটি ১০০ বেডের হাসপাতাল ছাড়া সব মেডিকেল কলেজে আর এমনকি প্রাইভেট হাসপাতাল বন্ধ ছিল, তখন কিডনি ফাউন্ডেশন থেকে তার দুটি কোভিড হাসপাতাল ফাউন্ডেশনের খরচে ৬ মাস সেবা দিয়ে গেছে।
এক প্রজন্ম, শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের নাতনি তার দাদাভাইয়ের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে ধারণ করেছে। সে আমেরিকার একজন চিকিৎসক; কিন্তু নিজের জীবনকে দাদাভাইয়ের আদর্শকে বেছে নিয়েছে। সে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১৫টি দেশে মেডিকেল টিম নিয়ে বারবার গিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে বেশি সেবা প্রয়োজন। তা সে ইয়েমেন, সুদানসহ ইউক্রেনেও সাতবার গিয়েছে। তিনবার গাজার যুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গণহত্যার সংবাদ প্রদান করেছে বিবিসিসহ বিভিন্ন পশ্চিমা মিডিয়ায়। যখন ইসরায়েল কোনো সাংবাদিকদের সত্য সংবাদ পাঠাতে বাধা দিত, সে সময় তার এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তুমি কেন আরামের জায়গা ছেড়ে প্রাণহানি হওয়ার এই ভয়াবহ যুদ্ধের ময়দানে আস। সে বলেছিল ১৯৭১ সালে আমার জন্মের ও বহু বছর আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দাদাভাই হাসপাতাল ভর্তি আহত রোগীদের ছেড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে চলে যাননি। তারা অবাক হয়ে তার দাদা ভাইয়ের কথা শুনে বলল, কথা দিচ্ছি আমরাও তোমার দাদাভাইয়ের মতো আহত রোগী রেখে চলে যাব না।
শহীদ ডা. শামসুদ্দিনের আত্মত্যাগের কাহিনি আজকে বিশ্বজনগণের কাছেও বিস্ময়।
আজ যদি বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের গৌরব আর ঐতিহ্যকে জানতে পারে আর ধারণ করতে পারে, তবেই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন।
বাংলাদেশের সব আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সব তথ্য আজও আমাদের অজানা। তাই এই সব ঘটনার সূত্র ধরে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। এর বিশালতার কোনো তুলনা হয় না। পরবর্তী সব সংগ্রাম এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হোক এই ইতিহাসে সূত্র ধরে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে জনগণ যেভাবে একত্রিত হয়েছিল, তেমনিভাবে সব বিভাজনের ঊর্ধ্বে থেকে ঐকমত্য ও সহমর্মিতা এবং সম্মান দেখাতে পারলে সব শহীদের আত্মদান সার্থক হবে।

অধ্যাপক ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ  কিডনি বিশেষজ্ঞ, টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলাডেলফিয়া। ইমেরিটাস অধ্যাপক ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় ফিলাডেলফিয়া। সভাপতি সিলেট কিডনি ফাউন্ডেশন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ র য় র জন য চ ক ৎসক ক জ কর আম দ র ন কর ন সরক র র সময় প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলিম বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষোভ, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান

ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদে এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে রাজধানীতে র‍্যালি করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর বিএনপি। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই কর্মসূচি।

র‍্যালি–পূর্ব সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘অন্য যেকোনো সভার চেয়ে এই প্রতিবাদ মিছিল অস্বাভাবিক বড় হয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরাও এতে অংশ নিয়েছেন। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।’

ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, তা শুধু তাদের ধ্বংস নয়, এটা বিশ্ব মুসলমানদের নিঃশেষ করার একটি ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন মির্জা আব্বাস। মুসলিম বিশ্ব কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ হলে ইহুদিরা এতটা সাহস দেখাতে পারত না বলে অভিমত দেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনে চলমান সহিংসতার ছবি দেখলে সহ্য করা যায় না বলেও উল্লেখ করেন মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় যেমন জিয়াউর রহমান ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি বেঁচে থাকলে আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে কার্যকর উদ্যোগ নিতেন এবং ইসরায়েল এমন সহিংসতা চালানোর সাহস পেত না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিশ্বের কয়েকটি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে বহু আগেই ফিলিস্তিনে গণহত্যা শুরু হয়েছে। আজ ফিলিস্তিনের মানুষ নিজেদের দেশেই পরবাসী। অথচ মুসলিম বিশ্বের মোড়লদের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। তারা মুখ খুলছে না, অবস্থান নিচ্ছে না।’

গাজায় গণহত্যা বন্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন চলছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে এই নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং গণহত্যা বন্ধের জোর দাবি করছি।’

সালাহ উদ্দিন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বিরোধী দলের ওপর নিপীড়নের সঙ্গে ইসরায়েলের কাছ থেকে আড়িপাতার যন্ত্র কিনেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে জিয়াউর রহমান ইয়াসির আরাফাতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই থেকেই বিএনপি ফিলিস্তিনের জনগণের সংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এসেছে। আজ গাজা যেন অবরুদ্ধ খাঁচা, যেখানে শিশু ও নারীদের ওপর বর্বরতা চালানো হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীকে প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দরকার।’

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটকারীদের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, তারা ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে বলেই মনে করব। তাদের প্রতিহত করতে হবে, তবে কোনোভাবেই মারপিট নয়—পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ফিলিস্তিনে যুগের পর যুগ ধরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছে। নারী-পুরুষ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। এটা সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধ। দেশের সাধারণ মানুষ দল–মতনির্বিশেষে ফিলিস্তিনের পক্ষে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের থেকে তেমন কোনো অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘও নিষ্ক্রিয়—একটি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে গেছে।’

র‍্যালি–পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু। সঞ্চালনায় ছিলেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দীন টুকু। আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

বিএনপির এই কর্মসূচি বিকেল চারটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা আড়াইটা থেকেই নয়াপল্টনে নেতা–কর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। হাতে প্ল্যাকার্ড, ফিলিস্তিনের পতাকা ও কালো ব্যানার নিয়ে নেতা–কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেন নয়াপল্টন এলাকা।

র‍্যালিটি নয়াপল্টন থেকে শুরু হয়ে শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজার হয়ে বাংলামোটরে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে র‍্যালি শুরু হয়। সারা পথজুড়েই ছিল ব্যাপক জনসমাগম ও প্রতিবাদী স্লোগান। বিএনপির নেতা–কর্মীরা ‘ইসরায়েলি পণ্য বয়কট করো, দুনিয়ার মুসলিম এক হও লড়াই করো’, ‘ফিলিস্তিনে হামলা কেন, জাতিসংঘ জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

বিএনপির নেতারা জানান, এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বার্তা দেওয়া হয়েছে—গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জনগণ ফিলিস্তিনের পাশে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভীতি কাটাতে গণিতের চর্চা বাড়াতে হবে
  • গাজীপুরে কৃষক দল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
  • গাজীপুরে কৃষকদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
  • চৈত্রসংক্রান্তি বর্ষবিদায় উৎসব
  • ঢাবিতে ১৫তম স্নাতক গণিত অলিম্পিয়াডে ১০ শিক্ষার্থী বিজয়ী
  • খেলাফত মজলিস নারায়ণগঞ্জ সদর থানা শাখার কমিটি পুনর্গঠন
  • পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে থাকছে আলোর পথে যাত্রার আহ্বান
  • বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট বাতিলের দাবি খেলাফত মজলিসের
  • মুসলিম বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষোভ, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান
  • সিলেটে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত